সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রসঙ্গে শান্তির জন্য আকুলতা, উদ্যোগ, পটভূমি, প্রতিষ্ঠা, উদ্দেশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য, নীতি, সংগঠন, কার্যাবলী, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে জানবো।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ

বিষয়সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ
প্রতিষ্ঠা২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
উদ্দেশ্যবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা
প্রেক্ষাপটদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানজাতিসংঘ
প্রেক্ষাপটপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ

ভূমিকা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ও হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে ‘জাতিসঙ্ঘ’ বা ‘লিগ অব নেশনস্’ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বলা বাহুল্য, জাতিসঙ্ঘ তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয় এবং ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটির বিলুপ্তি ঘটে।

শান্তির জন্য আকুলতা

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়, যার ভয়াবহতা ও ধ্বংসলীলা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা বহুগুণ বেশি। বিশ্ববাসী তখন শান্তির জন্য আকুল হয়ে ওঠে এবং এই আকুলতা থেকেই জন্ম নেয় নতুন এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান— ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ বা ‘ইউনাইটেড নেশনস্ অরগানিজেশন’।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা

‘লিগ অব নেশনস্’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন যেমন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন, তেমনি ‘ইউনাইটেড নেশনস্’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন আর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

মূলত ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া – এই তিনটি শক্তির উদ্যোগে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠার পটভূমি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হলেও, এর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর পূর্বেই। ‘লন্ডন ঘোষণাপত্র’ আটলান্টিক সনদ, ওয়াশিংটন সম্মেলন, মস্কো ঘোষণা, তেহরান ঘোষণা, ইয়াল্টা সম্মেলন এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠা

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৪ অক্টোবর তারিখটি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ধরা হয়।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আদর্শ ও লক্ষ্যের উল্লেখ

১১১টি ধারা সম্বলিত জাতিপুঞ্জ সনদের মুখবন্ধ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় ধারায় জাতিপুঞ্জের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের প্রস্তাবনা

জাতিপুঞ্জ সনদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, “আমরা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের জনগণ এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে, আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের মড়ক থেকে, যে যুদ্ধ পরপর দু’বার মানবজাতির অশেষ দুঃখ-দুর্দশার সৃষ্টি করেছে, রক্ষা করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংঘ, যার নাম জাতিপুঞ্জ, তা গঠন করলাম।”

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য

জাতিপুঞ্জ সনদের ১ নং ধারায় চারটি মৌলিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলি হল –

  • (১) আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সমস্ত সম্ভাবনা দূর করা,
  • (২) সমস্ত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সমানাধিকার মেনে নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য স্থাপন,
  • (৩) পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানবজাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও কৃষ্টিমূলক সব সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো এবং
  • (৪) এইসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্য বিভিন্ন দেশ যে সমস্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে জাতিপুঞ্জ কর্তৃক সেগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নীতি

জাতিপুঞ্জ সনদের ২ নং ধারায় সাতটি মৌলিক নীতি আছে। যথা –

  • (১) ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমস্ত সদস্য-রাষ্ট্রের সমান সার্বভৌম মর্যাদা থাকবে,
  • (২) সমস্ত সদস্য সনদ অনুযায়ী তাদের দায়িত্বগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবে,
  • (৩) শাস্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিরোধের মীমাংসা করবে,
  • (৪) অপর কোনও রাষ্ট্রের সংহতি বা স্বাধীনতা বিপন্ন হয় এই ধরনের ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করা থেকে সব সদস্য রাষ্ট্রই বিরত থাকবে,
  • (৫) সনদ অনুযায়ী সমস্ত রাষ্ট্রই জাতিপুঞ্জকে বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য করবে এবং জাতিপুঞ্জ যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে,
  • (৬) আন্তর্জাতিক শান্তির স্বার্থে জাতিপুঞ্জের সদস্য নয় এমন রাষ্ট্রগুলিকেও এই নীতিগুলি মেনে চলতে সাহায্য করা হবে, এবং
  •  (৭) জাতিপুঞ্জ কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য

  • (১) যে ৫১টি দেশ জাতিপুঞ্জের সনদে প্রথম স্বাক্ষর করেছিল তাদের ‘সনদ-সদস্য’ (Charter Member) বলা হয়। এই ‘সনদ-সদস্য ছাড়াও জাতিপুঞ্জে অন্য সদস্য গ্রহণেরও ব্যবস্থা ছিল।
  • (২) জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ সভার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সমর্থিত হলে যে কোনও রাষ্ট্রকে এই সংস্থার সদস্যপদ দেওয়া যায়।
  • (৩) নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের (আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত রাশিয়া ও কুয়োমিনতাং চিন) সকলেরই ‘ভেটো’ বা প্রস্তাব নাকচ করার ক্ষমতা আছে। সুতরাং নতুন কোনও রাষ্ট্রকে সদস্য পদপ্রার্থী হতে গেলে এই পাঁচটি রাষ্ট্রকেই একমত হতে হবে।
  • (৪) সদস্য পদপ্রার্থী সব রাষ্ট্রকে শান্তিপ্রিয়’ হতে হবে, সনদে উল্লিখিত সমস্ত নীতি মেনে চলতে এবং সমস্ত দায়িত্ব পালনে সম্মত হতে হবে। অনুরূপভাবে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ খারিজের বন্দোবস্তও আছে।
  • (৫) কোনও সদস্য-রাষ্ট্র রাষ্ট্রের মর্যাদাচ্যুত হলে বা বারবার জাতিপুঞ্জের সনদের শর্তাবলী ভঙ্গ করলে নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ সভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সেই রাষ্ট্রের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সংগঠন

জাতিপুঞ্জ ছয়টি প্রধান সংস্থার মাধ্যমে তার কার্যাবলী পরিচালনা করে থাকে। জাতিপুঞ্জ সনদের ৭ নং ধারায় এই সংস্থাগুলির উল্লেখ আছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সংগঠন -এর সংস্থাগুলি হল –

  • (ক) সাধারণ সভা
  • (খ) নিরাপত্তা পরিষদ
  • (গ) অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ,
  • (ঘ) অছি পরিষদ,
  • (ঙ) আন্তর্জাতিক বিচারালয় এবং
  • (চ) দপ্তর।

জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য

বিশ্বের আধুনিক ইতিহাস-এ জাতিসংঘ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ দুটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জের তুলনা করলে উৎপত্তি, সংগঠন, কার্যকলাপ, দোষ-ত্রুটি প্রভৃতি নানা দিক থেকে তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কার্যাবলী

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কার্যাবলীর মধ্যেই তার সাফল্য ও ব্যর্থতা নিহিত রয়েছে। যেমন –

(ক) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাফল্য

ইরান থেকে রুশ সেনা অপসারণে, সিরিয়া ও লেবাননে শান্তি প্রচেষ্টায়, গ্রিস -এ শান্তি প্রতিষ্ঠায়, ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতায়, পোল্যাণ্ড সমস্যা সমাধান, বার্লিন সমস্যার সমাধান, কোরিয়া সমস্যার সমাধান প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের সাফল্য ছিল অভাবনীয়।

(খ) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা

চেকশ্লোভাকিয়াতে রুশ প্রভাব, ভারত -এর কাশ্মীর সমস্যা, এসইউ ভূখণ্ডে সমস্যা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে।

উপসংহার :- নানা ত্রুটি ও ব্যর্থতা সত্বেও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিপুঞ্জের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। দিন দিন এর সদস্য সংখ্যা ও কর্মের পরিধি বিস্তৃততর হচ্ছে। আশা করা যায় যে, নতুন পৃথিবী গড়ার কাজে এই সংস্থা পথ নির্দেশকের কাজ করবে।

(FAQ) সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয় কবে?

২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।

২. কি উদ্দেশ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়?

আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা।

৩. কোন যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটে জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

Leave a Comment