পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ -এর সময়কাল, অবস্থান, বিবাদমান পক্ষ, মারাঠা বাহিনী, আফগান বাহিনী, যুদ্ধের বর্ণনা ও গুরুত্ব, ভয়ঙ্কর ও বৃহত্তম যুদ্ধ ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবো।

ঐতিহাসিক পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

সময়কাল১৪ জানুয়ারি ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ
স্থানপানিপথ, বর্তমানে ভারত -এর হরিয়ানা
বিবাদমান পক্ষমারাঠা সাম্রাজ্য ও আহম্মদ শাহ আবদালির বাহিনী
ফলাফলআহম্মদ শাহ আবদালি জয়ী
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

ভূমিকা :- ঔরঙ্গজেব -এর পর মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের যুগে নবজাগ্রত মারাঠা শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যে পানিপথের প্রান্তরে ইতিপূর্বে দুবার ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তৃতীয়বারের জন্যও সেই পানিপথ ভারত ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে দিল ।

পানিপথ

ভারতের রাজধানী দিল্লীর উত্তরে অবস্থিত পানিপথ ভারতের হারিয়ানা প্রদেশের একটি শহরের নাম। মহাভারত অনুযায়ী পানিপথ পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি শহরের মধ্যে অন্যতম। মহাভারতের ইতিহাস ছাপিয়ে পানিপথ মুখ্য হয়ে আছে মূলত পানিপথ প্রান্তরে ঘটে যাওয়া তিনটি বড় যুদ্ধের কারণে। এই যুদ্ধ গুলি পানিপথের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

পানিপথে তিনটি যুদ্ধ

পানিপথের প্রান্তরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

(১) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোঘল অধিপতি বাবর এবং সুলতান ইব্রাহিম লোদির মধ্যে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বাবর জয়লাভ করে ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন।

(২) পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ -এ সম্রাট আকবর এবং উত্তরের রাজা হেমচন্দ্র মুখোমুখি হন। যুদ্ধ জয়ী আকবর মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন।

(৩) পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ তথা সর্বশেষ যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন আহমদ শাহ আবদালী। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে মারাঠা সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যায়।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময়কাল

১৪ই জানুয়ারি ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের স্থান

দিল্লির ৯৭ কিলোমিটার উত্তরে পানিপথ নামক স্থানে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ

মারাঠাদের সাথে দোয়াবের আফগান রোহিলা ও আয়ুব এর সম্রাট সুজা-উদ-দৌল্লার যৌথ সমর্থনে আফগানিস্থান -এর সম্রাট আহম্মদ শাহ আবদালির মধ্যে সংঘটিত হয় এই যুদ্ধ।

ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

এই যুদ্ধটি মারাঠা অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনীর সাথে আবদালি এবং নাজিব-উদ-দৌলাহের নেতৃত্বে আফগান ও রোহিলাদের (যারা আফগান) অশ্বারোহী ও পর্বতারোহী গোলন্দাজ বাহিনীর মধ্যে ভয়ঙ্কর রুপে সংঘটিত হয়।

বৃহত্তম যুদ্ধ পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

যুদ্ধটি ১৮ শতকের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। এবং মৃত্যুর সংখ্যা ধরলে সম্ভবত দুটি বাহিনী মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে একটি একক দিনে মৃত্যুর সংখ্যায় বৃহত্তম।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠা বাহিনী

মারাঠাদের সাথে সিন্ধিয়া, বুন্দেল, হোলকার, ইব্রাহিম খান গার্দির গোলন্দাজ বাহিনী এবং গাইখন্দের যোদ্ধারা যোগ দেয়। ফলে মারাঠারা বেশ শক্তিশালী ফৌজ গঠন করতে সক্ষম হয়।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে আফগান বাহিনী

রোহিলার নজিব-উদ-দৌলা এবং অযোদ্ধার নবাব সুজা-উদ-দৌলা আফগানদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করে। আবদালীর নেতৃত্বে সুদক্ষ গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে উঠে।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের বর্ণনা

১৪ জানুয়ারি, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে সকাল থেকেই দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া শুরু করে।

  • (১) প্রথমে আহমেদ শাহ আবদালী তার সেনাদলকে যুদ্ধের ময়দানে অগ্রসর হতে আদেশ দেন। আফগানদের হুংকারের প্রতি উত্তরে মারাঠারাও গগণবিদারী হুংকার দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। শুরু হয় পানিপথের ঐতিহাসিক যুদ্ধ।
  • (২) প্রথমেই মারাঠারা রোহিলা বাহিনীর উপর চড়াও হয়। হাজার হাজার মারাঠা সেনার মুহুর্মুহু আক্রমণে রোহিলা বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। অপরদিকে আফগান বাহিনীও সমান তালে মারাঠাদের আক্রমণ করতে থাকে।
  • (৩) আবদালীর পদাতিক বাহিনী মারাঠাদের মধ্যভাগ ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়। দু’দলই সমান তালে একে অপরকে আক্রমণ করতে থাকে। শত শত সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে।
  • (৪) পানিপথ প্রান্তর পুনরায় সৈনিকদের রক্তে লাল হয়ে যায়। যুদ্ধের কিছু সময় পর মারাঠা শিবিরে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃসংবাদের আগমন ঘটে যে, হোলকারের সেনাপতি মালহার রাও তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ময়দান হতে পলায়ন করেছেন।
  • (৫) সদাশিব রাও এই সংবাদে হতভম্ব হয়ে যান। অন্যদিকে আবদালীর গোলন্দাজরা আক্রমণ করে মারাঠাদের পিছু হটাতে থাকে। মারাঠা গোলন্দাজ বাহিনী ইব্রাহিম খান গার্দির নেতৃত্বে আক্রমণ শুরু করে। তার দক্ষ আক্রমণের ফলে আফগানদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
  • (৬) কিন্তু মারাঠারা যুদ্ধ ময়দানে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সদাশিব রাও তার মিত্রবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেতে থাকেন। আবদালী এই সুযোগে চারদিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন।
  • (৭) মারাঠারা পরাজয়ের ভয়ে পিছু হটতে শুরু করে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে মারাঠারা চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে। সুসজ্জিত মারাঠা বাহিনীর লাশে পানিপথ প্রাঙ্গন হাহাকার করে উঠে। অন্যদিকে আবদালী বাহিনীর বিজয়োল্লাস পানিপথের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব

ভারতের ইতিহাসে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যেমন-

মরাঠাদের অপূরণীয় ক্ষতি

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয়, বহু মারাঠা সৈন্যের মৃত্যু ও সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল। এককথায় বলা যেতে পারে এই যুদ্ধ মারাঠাদের কাছে ছিল অপূরণীয় ক্ষতি।

মারাঠা সাম্রাজ্যের অগ্রগতি ব্যাহত

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ভারতে মারাঠা সাম্রাজ্যের অগ্রগতি বা গঠনের প্রক্রিয়ায় চরম আঘাত করেছিল। উপরন্তু এই যুদ্ধ মারাঠা সংঘের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

মারাঠাদের মানসিক বিপর্যয়

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ফলে মারাঠাদের বস্তুগত ক্ষতি অপেক্ষা মানসিক বিপর্যয় আরও ক্ষতিকর হয়েছিল। পেশোয়ার সম্মান যেমন ম্লান হয়ে গিয়েছিল তেমনই মারাঠাদের আত্মবিশ্বাস ও সংহতি বিনষ্ট হয়েছিল।

হায়দার আলি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানের পথ প্রশস্ত

এই যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ ভারতে হায়দার আলি ও ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল।

পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে যদুনাথ সরকারের বক্তব্য

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার -এর মতে, “If plasscy had sown the seeds of British supremecy in India, Panipath, afforded time for their maturing and striking roots.”

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ

ভারতে ২০১৯ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পটভূমিতে আশুতোষ গোয়াড়িকরের পরিচালনায় নির্মিত হয় চলচ্চিত্র “পানিপথ”। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অর্জুন কাপুর, সঞ্জয় দত্ত এবং কৃতি শ্যানন।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় যে, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ছিল মারাঠাদের কাছে এক বিপর্যয় স্বরূপ এবং ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণকারী একটি যুদ্ধ।

(FAQ) পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কবে হয়েছিল?

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি।

২. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়?

আফগানিস্তানের আহমেদ শাহ আবদালি ও মারাঠা বাহিনীর মধ্যে।

৩. পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সময় পেশোয়া কে ছিলেন?

দ্বিতীয় বাজিরাও।

৪. তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ কাদের মধ্যে হয়েছিল?

আফগানিস্তানের আহমেদ শাহ আবদালি ও মারাঠা বাহিনীর মধ্যে।

Leave a Comment