দ্বিতীয় পুলকেশী

বাতাপি বাদামির চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট দ্বিতীয় পুলকেশীর সিংহাসনে আরোহণ, আইহোল লিপি, রাজ্যবিস্তার নীতি, হর্ষ-পুলকেশী দ্বন্দ্ব, দক্ষিণী নীতি, পল্লব নীতি, পল্লবদের সাথে যুদ্ধ, তার মৃত্যু ও দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতের বাতাপির চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট দ্বিতীয় পুলকেশী প্রসঙ্গে চালুক্যদের শাখা, বাতাপির চালুক্য, বেঙ্গির চালুক্য বংশ, কল্যাণের চালুক্য বংশ, বাতাপির চালুক্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা, দ্বিতীয় পুলকেশীর সিংহাসনে আরোহণ, দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবীকীর্তি, দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল লিপি, দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্য বিস্তার নীতি, দ্বিতীয় পুলকেশীর সময় হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ, দ্বিতীয় পুলকেশী-হর্ষবর্ধন দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় পুলকেশীর দক্ষিণী নীতি, দ্বিতীয় পুলকেশীর পল্লব নীতি, পল্লব-চালুক্য দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব ও দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যু।

সম্রাট দ্বিতীয় পুলকেশী

ঐতিহাসিক চরিত্রদ্বিতীয় পুলকেশী
বংশবাতাপির চালুক্য
রাজত্বকাল৬১০-৬৪২ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিমঙ্গলেশ
উত্তরসূরিপ্রথম বিক্রমাদিত্য
দ্বিতীয় পুলকেশী

ভূমিকা:- দ্বিতীয় পুলকেশী চালুক্য বংশ -এর সর্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন তাই নয়, সমগ্ৰ প্রাচীন ভারত -এর ইতিহাসে একজন নরপতি হিসেবে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।

চালুক্যদের শাখা

দক্ষিণ ভারতের চালুক্য বংশের কয়েকটি শাখার কথা জানা যায়। যথা –

  • (১) বাতাপি বা বাদামির চালুক্য বা পশ্চিম চালুক্য। ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি এরা রাজত্ব করেন।
  • (২) বেঙ্গীর চালুক্য বংশ বা পূর্ব চালুক্য। এটি ছিল পশ্চিম চালুক্যের শাখা। সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক এঁরা রাজত্ব করেন।
  • (৩) কল্যাণের চালুক্য বংশ। দশম শতক হতে এঁরা রাজত্ব করেন। এবং (৪) গুজরাটের চালুক্য বংশ।

দ্বিতীয় পুলকেশী

বাতাপি বা বাদামির চালুক্য বংশের নরপতি ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী। তিনিছিলেন সমগ্ৰ চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট।

দ্বিতীয় পুলকেশীর সিংহাসনে আরোহণ

দ্বিতীয় পুলকেশী তাঁর পিতৃব্য মঙ্গলেশের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে পৈত্রিক সিংহাসন পান। এই গৃহযুদ্ধের সময় চালুক্য সাম্রাজ্য -এর বিভিন্ন অংশে অরাজকতা দেখা দেয়। দ্বিতীয় পুলকেশী সিংহাসনে বসার পর এই বিদ্রোহগুলি দমন করেন।

আইহোল লিপি

৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে সভাকবি রবিকীর্তির রচিত আইহোল শিলালিপি থেকে দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্বের কথা জানা যায়।

দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্যবিস্তার নীতি

  • (১) দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী। তিনি তাঁর প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে অধিকার করার কাজে প্রথম থেকেই দৃষ্টি দেন। তিনি দক্ষিণে মহীশূরের গঙ্গ রাজ্য, মালাবারের অলুপঅঞ্চল জয় করেন।
  • (২) তিনি কোঙ্কনের মৌর্য রাজ্যটিও জয় করেন এবং মৌর্য রাজধানী পুরী অধিকার করেন। অধুনা এলিফ্যান্টা দ্বীপটির প্রাচীন নাম ছিল পুরী। এর পর তিনি আরও উত্তরে এগিয়ে লাট অর্থাৎ গুজরাট, কোঙ্কন ও বলভী জয় আক্রমণ করেন।
  • (৩) গুজরাটে এই সময় বলভী বংশ রাজত্ব করত। ঝড়ের দাপটে যেমন বেত গাছ নুয়ে পড়ে, তেমনি পুলকেশীর আক্রমণে বলভী বশ্যতা স্বীকার করে। গুজরাটে পাওয়া ভূমি পট্রলীগুলি হতে গুজরাটে এই যুগে চালুক্য আধিপত্য প্রমাণিত হয়।
  • (৪) ডঃ মজুমদারের মতে, গুজরাট জয় ছিল পুলকেশীর জীবনের একটি বিরাট ঘটনা। কারণ এর ফলে উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধন -এর সঙ্গে চালুক্য দ্বিতীয় পুলকেশীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হয়।

হর্ষ-পুলকেশী দ্বন্দ্ব

  • (১) গুজরাট ও মালব বা রাজপুতানার ওপর হর্ষ আক্রমণের উদ্যোগদেখালে এই স্থানের শাসকরা চালুক্য পুলকেশীর অধীনতায় আশ্রয় নেন। হর্ষ তাঁর অভীষ্ট অঞ্চলে পুলকেশীর হস্তক্ষেপকে অনুচিত বলে মনে করতেন।
  • (২) স্মিথের মতে, নর্মদা তীরে হর্ষ-পুলকেশীর শক্তি পরীক্ষা হয়। ডঃ মজুমদারের বলেন যে, নর্মদার আরও উত্তরে এই যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে হর্ষ পরাজয় বরণ করেন এবং বিজয়ী দ্বিতীয় পুলকেশী “পরমেশ্বর” উপাধি নেন।
  • (৩) এর ফলে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে হর্ষের রাজ্য বিস্তার রদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পুলকেশী এরপর দাক্ষিণাত্যের পূর্বভাগে ও সুদূর দক্ষিণে তাঁর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন।

দ্বিতীয় পুলকেশীর দক্ষিণী নীতি

তিনি পূর্ব দিকে গোদাবরী জেলার পিঠাপুরম জয় করে,এলোর ও কুণাল পর্যন্ত এগিয়ে যান। দাক্ষিণাত্যের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ কৃষ্ণা-গোদাবরী অঞ্চলে তিনি তাঁর কুব্জ বিষ্ণুবর্ধনের অধীনে রাখেন। বিষ্ণুবর্ধনের নেতৃত্বে বেঙ্গীর পূর্ব চালুক্য বংশ স্থাপিত হয়।

দ্বিতীয় পুলকেশীর পল্লব নীতি

  • (১) দ্বিতীয় পুলকেশী এরপর তুঙ্গভদ্রা পার হয়ে সুদূর দক্ষিণে ঢুকে পড়েন। এই সময় দক্ষিণে পল্লব বংশ খুব প্রতাপশালী ছিল। চালুক্য পুলকেশী তুঙ্গভদ্রা পার হলে দীর্ঘ চালুক্য-পল্লব দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়।
  • (২) এই দ্বন্দ্ব কয়েক পুরুষ ধরে চলে। এই দ্বন্দ্বের লক্ষ্য ছিল চালুক্য শক্তিকে তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণে প্রতিষ্ঠা করা।অপর দিকে পল্লব শক্তির লক্ষ্য ছিলতুঙ্গভদ্রার উত্তর তীরে রাজ্য বিস্তার করা।
  • (৩) দ্বিতীয় পুলকেশী, পল্লব প্রথম মহেন্দ্রবর্মনকে পরাস্ত করে তাঁর রাজধানী কাঞ্চী নগরীকে বিপন্ন করেন। তিনি আরও দক্ষিণে এগিয়ে কাবেরী নদী পার হয়ে চোল শক্তির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। এর ফলে পল্লব শক্তি দুদিক থেকে বেষ্টিত হয়ে পড়ে। এই বিজয় সম্পন্ন করে পুলকেশী তাঁর রাজধানী বাতাপিতে ফিরে আসেন।
  • (৪) ডঃ মহালিঙ্গম চালুক্য দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল লিপির বক্তব্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ডঃ মহালিঙ্গমের মতে, আইহোল লিপির সাক্ষ্যের সঙ্গে মহেন্দ্রবর্মনের কাকাক্কুটি পট্টের দেওয়া তথ্যের বহু অসঙ্গতি আছে।
  • (৫) আইহোল লিপিতে পল্লব মহেন্দ্রবর্মনের নাম নেই। এতে “পল্লবদের অধিপতির” কথা বলা হয়েছে। তিনি প্রথম নরসিংহ বর্মনও হতে পারেন।পাল্লাপুরের যুদ্ধ তাঁর মতে দ্বিতীয় পুলকেশী ও প্রথম নরসিংহবর্মনের সঙ্গে হয়।
  • (৬) মহেন্দ্রবর্মনের কাকাক্কুটি পট্রে বলা হয়েছে যে, পাল্লাপুরের যুদ্ধে তিনি তাঁর “প্রধান শত্রুদের” ধ্বংস করেন। এক্ষেত্রে বহু বা একাধিক শত্রুর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। সুতরাং পাল্লাপুরের যুদ্ধে মহেন্দ্রবর্মনের তথাকথিত “প্রধান শত্রুদের” মধ্যে দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন না। এঁরা হয়ত চোল রাজা ও তাঁর মিত্র শক্তি ছিলেন।
  • (৭) চালুক্য-পল্লব দ্বন্দ্ব মহেন্দ্রবর্মনের পরে আরও তীব্রতর হয় বলে আইহোল লিপি থেকে জানা যায়। ডঃ মহালিঙ্গমের মতে, প্রথম নরসিংহবর্মন তাঁর রাজত্বের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে পরাস্ত হন। আইহোল লিপিতে তাঁর উল্লেখ আছে।
  • (৮) এরপর পুলকেশী পুনরায় পল্লব রাজ্য আক্রমণ করলে নরসিংহবর্মন তাকে মনিমঙ্গলমের যুদ্ধে পরাস্ত করে তুঙ্গভদ্রা পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য করেন। নরসিংহবর্মন পুলকেশীর পিছু নিয়ে তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণে পরিয়ালের যুদ্ধে পুনরায় পুলকেশীকে পরাস্ত করেন।
  • (৯) এর পর পল্লব সেনা বাতাপি রাজ্যে ঢুকে, বাতাপি নগরী পুড়িয়ে দেয়। সম্ভবতঃ বাতাপির যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যু হয়। নরসিংহবর্মন বাতাপিতে একটি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন ও লিপি খোদাই করেন।

দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যু

৬৪২ খ্রীঃ দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যু হয়।

দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব

  • (১) দ্বিতীয় পুলকেশী কেবলমাত্র শক্তিশালী রাজা ছিলেন না, প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা বলে তাকে গণ্য করা যায়। তিনি বাহুবলে ক্ষুদ্র চালুক্য রাজ্যকে উত্তরে গুজরাট হতে দক্ষিণে পাণ্ড্য রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।
  • (২) তিনি পারসিক সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর দরবারে দূত পাঠান এবং তাঁর দরবারে পারসিক দূত পাঠানো হয়। অজন্তা গুহার দেওয়ালে এক বিষণ্ণ সুন্দরকান্তি পুরুষের চিত্র দেখা যায়। অনেকের মতে, এই চিত্রটি দ্বিতীয় পুলকেশীর।
  • (৩) হিউয়েন সাঙ তাঁর রাজত্বকালে মহারাষ্ট্র ভ্রমণ করে তার শাসনব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে, পুলকেশী বহু জনহিতকর কাজ করেন। লোকে তাকে শ্রদ্ধা করত। তাঁর রাজ্য ছিল ৮৩৬ বর্গমাইল। কৃষির কাজ নিয়মিতভাবে চলত। জনসাধারণ ছিল সৎ, পরিশ্রমী ও শিক্ষাপটু। তারা ছিল যুদ্ধপ্রিয় ও প্রতিহিংসাপরায়ণ।

উপসংহার:- যদি হর্ষবর্ধনকে উত্তরাপথনাথ বলা হয়, তবে দ্বিতীয় পুলকেশীকে দক্ষিণাপথনাথ’ বলা চলে। তিনি ছিলেন হর্ষের সমকালীন। তাঁর মৃত্যুর পর চালুক্য শক্তি খুবই হীনবল হয়ে পড়ে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “দ্বিতীয় পুলকেশী” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) দ্বিতীয় পুলকেশী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দাক্ষিণাত্যে চালুক্যদের কতগুলি শাখা ছিল?

৪ টি।

২. বাতাপির চালুক্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

প্রথম পুলকেশী।

৩. বাতাপির চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে ছিলেন?

দ্বিতীয় পুলকেশী।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment