মুসোলিনির উত্থান

ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির উত্থান প্রসঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সূচনা, আভান্তি পত্রিকা প্রকাশ, ফ্যাসিস্ট দল গঠন, ব্ল্যাক শার্টস বাহিনী গঠন, রোম দখল ও ইতালির ক্ষমতা দখল সম্পর্কে জানবো।

মুসোলিনির উত্থান

ঐতিহাসিক ঘটনামুসোলিনির উত্থান
স্থানইতালি
সময়কালপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল
রোম দখল২৮ অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ
মুসোলিনির উত্থান

ভূমিকা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির জাতীয় জীবনের এক সংকটময় পরিস্থিতিতে বেনিতি মুসোলিনি নামে এক নেতার আবির্ভাব হয়। তিনি ও তার ফ্যাসিস্ট দল ইতালিকে নব বলে বলিয়ান করে, নতুন পথে পরিচালিত করেন।

মুসোলিনির জন্ম

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই উত্তর ইতালির প্রোল্লিও গ্রামে এক দরিদ্র কর্মকারের গৃহে মুসোলিনির জন্ম। তাঁর মা ছিলেন একজন শিক্ষয়িত্রী। তাঁর পিতা ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী।

মুসোলিনির রাজনৈতিক চেতনার সূচনা

তাঁর পিতার কর্মশালায় প্রতি সন্ধ্যার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক নেতারা সমবেত হতেন। তাই মুসোলিনির রাজনৈতিক চেতনার প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল পিতার কর্মশালায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো

আঠারো বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পর উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ডের লুসান ও জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

সুইজারল্যান্ড থেকে বহিস্কার

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং শ্রমিক ধর্মঘটে প্ররোচনা দানের জন্য তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে বহিষ্কৃত হন।

মুসোলিনির কারারুদ্ধ

দেশে ফিরে তিনি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক কাজকর্মে যুক্ত হয়ে যান। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সরকার তাঁকে ‘বিপজ্জনক বিপ্লবী’ বলে চিহ্নিত করে চার বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে।

আভান্তি পত্রিকা

কারামুক্তির পর ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক দলের মুখপত্র ‘আভান্তি’ (‘প্রগতি’) পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানে মত প্রকাশ

ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইতালির সমাজতান্ত্রিক দল যুদ্ধের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে। মুসোলিনিও প্রথমে ইতালির যুদ্ধে যোগদানের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি অচিরেই ইতালির যুদ্ধে যোগদানের পক্ষে মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন।

সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যোগদান

তিনি বলেন, “এই যুদ্ধ জনগণের বুদ্ধ। আজকের যুদ্ধ আগামীকালের বিপ্লবে পরিণত হবে।” যুদ্ধ-সংক্রান্ত মতামতের জন্য তিনি সমাজতন্ত্রী দল থেকে বহিষ্কৃত হন। একজন সৈনিক হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগদান করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হয়ে দেশে ফিরে আসেন।

অরাজকতা সৃষ্টি

বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ইতালির সর্বত্র ঘোরতর দুর্যোগ নেমে আসে। দেশজুড়ে সাম্যবাদীদের নিরন্তর ধর্মঘট, রাস্তাঘাটে খণ্ডযুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা এবং অপরদিকে এই বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে অক্ষম গণতন্ত্রীদের অপদার্থতায় সর্বস্তরের মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে।

মুসোলিনির প্রচার

এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে মুসোলিনি প্রচার করতে থাকেন যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির ভূমিকাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় নি এবং ইতালি তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার রচনা ও বক্তৃতা সেনাবাহিনীর অফিসার এবং হতাশ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী তরুণদের প্রবলভাবে আকর্ষিত করে।

ফ্যাসিস্ট দল গঠন

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ মিলান শহরে ১১৮ জন কর্মচ্যুত সৈনিক ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তির এক সমাবেশে মুসোলিনি ‘ফ্যাসিস্ট দল’ গড়ে তোলেন। ল্যাটিন শব্দ ‘ফ্যাসেস’ থেকে ‘ফ্যাসিস্ট’ কথার উৎপত্তি। ‘ফ্যাসেস’ কথার অর্থ হল ‘শক্তি’। এই দলের প্রতীক ছিল ‘ফ্যাসিস’ বা দড়িবাঁধা কাষ্ঠদণ্ড বা আঁটি।

প্রতীক গ্ৰহণে উদ্দেশ্য

প্রাচীন রোমের রাজশক্তির প্রতীক ছিল এই ‘ফ্যাসিস’। প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রতীক গ্রহণ করেন।

মুসোলিনির ঘোষণা

তিনি ঘোষণা করেন যে, বামপন্থী বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে দেশে আইন-শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই হল এই দলের লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী ভাবধারার বিরুদ্ধে তিনি ইতালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিস্তারে সচেষ্ট হন।

রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাস

এই দল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাস করত। তারা মনে করত যে, “রাষ্ট্রই সকল শক্তির আধার, রাষ্ট্রের বাইরে কিছু নেই এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই।” এই মত অনুসারে রাষ্ট্রই সব এবং এখানে ব্যক্তির কোনও মূল্য নেই।

ফ্যাসিস্ট দলের লক্ষ্য

এই দলের লক্ষ্য ছিল –

  • (১) রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করা,
  • (২) বিশ্বসভায় ইতালিকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে বলিষ্ঠ বিদেশ নীতি গ্রহণ করা,
  • (৩) কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং
  • (৪) ব্যক্তিগত ধন-সম্পত্তি রক্ষা করা।

ঘোষিত লক্ষ্য

বলা হয় যে, শৃঙ্খলা রক্ষা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গই হল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ঘোষণা করা হয় যে, এই দলের লক্ষ্য হল নতুন জাতীয় সভা গঠন, গির্জার সম্পত্তি জাতীয়করণ, শ্রমিকদের জন্য আট ঘণ্টা কাজ এবং ভার্সাই সন্ধি সংশোধন করে ইতালির কাঙ্ক্ষিত স্থানগুলি লাভ করা।

দলের সদস্য ও শাখা

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ মিলানে দলের প্রতিষ্ঠার পর অচিরেই এর সদস্য সংখ্যা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং ইতালির প্রায় ৭০টি শহরে দলের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দলের তৃতীয় সম্মেলনের প্রাকালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ।

কার্যকলাপ পরিচালনা

দেশের নানা স্থানে বিভিন্ন ক্লাব ও সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে তিনি এই দলের কার্যকলাপ চালাতে থাকেন। এইভাবে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট আন্দোলন অচিরেই একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

সমর্থন

কর্মহীন হতাশ যুবক, ভীত-সন্ত্রস্ত্র বুর্জোয়া শ্রেণি এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায় শঙ্কিত শিল্পপতিরা এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে থাকে।

‘ব্ল্যাক শার্টস্’

কর্মচ্যুত সৈনিক ও বেকার যুবকদের নিয়ে তিনি অচিরেই একটি আধা-সামরিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন। অবিলম্বেই এটি একটি সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল সেনাদলে পরিণত হয়। এই দলের সদস্যরা কালো পোশাক পরত বলে তাদের ‘ব্ল্যাক শার্টস্’ বলা হত।

‘ব্ল্যাক শার্টস্’ বাহিনীর কার্যকলাপ

এই ‘ব্ল্যাক শার্টস্’ বাহিনী সমাজতন্ত্রী ও অপরাপর বিরোধী দলগুলির সভা-সমিতির উপর হামলা চালিয়ে সেগুলি ভেঙে দিত, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ওইসব দলের ধর্মঘট বানচাল করত – এমনকী বিরোধী নেতাদের হত্যাও করত।

‘স্কোয়াড্রিজম’

এইভাবে দেশের সর্বত্রই কমিউনিস্ট ও অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে তাদের খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। তাদের এই আক্রমণাত্মক নীতিকে ‘স্কোয়াড্রিজম’ বলা হয়।

ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি

দেশের কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা দমন করার দায়িত্ব ফ্যাসিস্ট দল নিজেদের হাতে তুলে নেয়। তাদেরকে বলা হত ‘সকল সমস্যার সমাধানকারী’। যাই হোক, এইভাবে ফ্যাসিস্ট দল সারা দেশে এক ভীতির পরিবেশ গড়ে তোলে।

অন্যান্য দলের বিলুপ্তি

সমাজতন্ত্রীদের উপদ্রব ও গণতন্ত্রীদের অপদার্থতায় বীতশ্রদ্ধ ধনবান ব্যক্তি, শিল্পপতি ও সাধারণ মানুষ মুসোলিনিকে তাদের ত্রাণকর্তা বলে মনে করে তাঁর দলকে অর্থসাহায্য করতে থাকে। ফ্যাসিস্টদের হাঙ্গামায় ওই দলগুলি একরকম বিলুপ্ত হয়ে যায়।

নির্বাচনে ব্যর্থতা

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে এই দল একটিও আসন পায় নি। ১৯২১ সালের নির্বাচনে ভোটারদের ভীতিপ্রদর্শন ও অন্যান্য উপায়ে এই দল ৩১টি (মতান্তরে ৩৫টি) আসন পায়। সরকার পক্ষ মুসোলিনিকে মন্ত্রিসভায় যোগদানের আহ্বান জানালে ক্ষমতালাভ তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দুর্বল সংসদীয় শাসন উচ্ছেদ করে স্বহস্তে দেশের শাসনভার গ্রহণ।

ফ্যাসিস্ট দলের উত্থান

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সমাজতন্ত্রীরা সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দিলে ফ্যাসিস্ট দলের উত্থান-পর্ব শুরু হয়। ইতালীয়রা ধর্মঘটের নামে অরাজকতা মানতে রাজি ছিল না। এর সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিস্টরা সমাজতন্ত্রীদের উপর ব্যাপক আঘাত হানতে শুরু করে। বিভিন্ন শহরে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসোলিনির রোম অভিযান

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে অক্টোবর মুসোলিনি তাঁর ‘ব্ল্যাক শার্টস্’ বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য নিয়ে রাজধানী রোম অভিমুখে অগ্রসর হন।

মন্ত্রীসভার পদত্যাগ

ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লুইজি ফ্যাক্টা সামরিক আইন জারি করে এই অভিযান বন্ধ করতে চাইলে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল সম্মত হন নি। এর ফলে রোমের ফ্যাক্টা মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে।

উপসংহার:- মুসোলিনি ২৮শে অক্টোবর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে রোম দখল করেন। ২৯শে অক্টোবর রাজা তাকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান এবং পরদিন তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এইভাবে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর মুসোলিনি ও তাঁর দল ক্ষমতা দখল করে।

(FAQ) মুসোলিনির উত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ইতালি কোন পক্ষে যোগদান করে?

ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে।

২. ফ্যাসিস্ট দল কে প্রতিষ্ঠা করেন?

বেনিতো মুসোলিনি।

৩. ফ্যাসিস্ট কথার উৎপত্তি কোথা থেকে? এর অর্থ কি?

ল্যাটিন শব্দ ফ্যাসেস থেকে। এর অর্থ শক্তি।

৪. মুসোলিনির সেনাবাহিনীর নাম কি?

ব্ল্যাক শার্টস বাহিনী।

Leave a Comment