হিটলারের উত্থান

এডলফ হিটলারের উত্থান প্রসঙ্গে যুদ্ধে হিটলারের বীরত্ব প্রদর্শন, ভার্সাই সন্ধি, নাৎসি দল, বিয়ার হল অভ্যুত্থান, হিটলারের সুদক্ষ প্রচার, নতুন মন্ত্রিসভা গঠন ও একচ্ছত্র নেতা হিসেবে হিটলারের সম্পর্কে জানবো।

এডলফ হিটলারের উত্থান

ঐতিহাসিক ঘটনাহিটলারের উত্থান
সময়প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল
স্থানজার্মানি
উপাধিফ্যুয়েরার
পতনদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে
এডলফ হিটলারের উত্থান

ভূমিকা :- এক দরিদ্র চর্মকারের গৃহে জন্মগ্ৰহণ করে নিজ ক্ষমতা বলে হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন। ওয়েমার প্রজাতন্ত্রের পতন-এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত হিটলার ও নাৎসি দল -এর আধিপত্য বজায় ছিল।

এডলফ হিটলারের জন্ম

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল অস্ট্রিয়ার অন্তর্গত ব্রাউনাউ গ্রামে এক দরিদ্র চর্মকারের গৃহে জার্মান জাতির ‘ফ্যুয়েরার’ অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম।

এডলফ হিটলারের পরিবার

তাঁর মা ক্লারা ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক রমণী। বাল্যেই তিনি তাঁর পিতাকে হারান এবং এর কিছুদিন বাদে তাঁর মা-ও মারা যান। অনেকগুলি ভাই-বোনকে নিয়ে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলি অতিবাহিত হয়।

এডলফ হিটলারের শিক্ষা

লিনৎস বিদ্যালয়ের পাঠ সাঙ্গ করে তিনি ভিয়েনার ‘অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস’-এ ছাত্র হিসেবে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই সময় সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ছবি এঁকে এবং হোটেলে পরিচারকের কাজ করে তাঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কাজের ফাঁকে তিনি ভিয়েনার সরকারি পাঠাগারে পড়াশোনা করতেন।

যুদ্ধে হিটলারের বীরত্ব প্রদর্শন

এই সময় তাঁর মনে ইহুদি-বিদ্বেষ ও প্যান-জার্মান বা জার্মান জাতীয়তাবাদের আদর্শ জাগ্রত হয়। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জার্মান সেনাদলে যোগদান করেন এবং যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ‘আয়রন ক্রস’ লাভ করেন।

ভার্সাই সন্ধি

ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরকালে তিনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন। ইতিমধ্যে সম্পাদিত হওয়া অপমানজনক ভার্সাই সন্ধি দেশবাসীকে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ করে এবং সারা দেশে ওয়েমার প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়।

জার্মান শ্রমিকদলে হিটলারের যোগদান

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ (German Workers’ Party) বা জার্মান শ্রমিক দলে যোগ দেন। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডেক্সলার নামে জনৈক জার্মান।

হিটলারের নাৎসি দল

বাগ্মিতার জোরে হিটলার অল্পদিনের মধ্যেই শ্রমিক দলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন। কিছুদিন পর এই দলের নতুন নামকরণ হয় ‘ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা নাৎসি দল। হিটলারের বাগ্মিতায় দলে দলে বিক্ষুব্ধ মানুষ এই দলের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে।

হিটলার সম্পর্কে এলান বুলকের মন্তব্য

ঐতিহাসিক এলান বুলক হিটলারকে ইতিহাসের ‘শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, হিটলারের মধ্যে নেতা ও অভিনেতার আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

হিটলারের নাৎসি দলের লক্ষ্য

  • (১) ঐতিহাসিক রবার্ট এরগ্যাং বলেন যে, নাৎসি দলের সফলতার অন্যতম কারণ হল এই দলের মিথ্যা প্রচারের ক্ষমতা। এই দলের লক্ষ্য ছিল ভার্সাই সন্ধি বাতিল করে এক শক্তিশালী জার্মান রাষ্ট্র গঠন।
  • (২) ইহুদি বিরোধিতা, ক্যাথলিক বিরোধিতা, কমিউনিস্ট বিরোধিতা ছিল এই দলের ঘোষিত লক্ষ্য। এছাড়া বেকার সমস্যার সমাধান, আমুল ভূমি-সংস্কার, শিশু ও নারীকল্যাণ এই দলের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আধা সামরিক বাহিনী গঠন

নাৎসি দলের প্রচারকার্য, সঙ্গীত ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হিটলার তাঁর দলের বেকার যুবকদের নিয়ে একটি আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন। বাদামি পোশাকে সজ্জিত এই বাহিনী বিরোধীদের সভা-সমিতি ভেঙে দিত এবং নেতাদের উপর হামলা চালাত।

শিল্পপতি ও জনগণের সাহায্য

কমিউনিস্টদের উপর বীতশ্রদ্ধ শিল্পপতি ও জনসাধারণ কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে এই দলকে প্রচুর অর্থসাহায্য করত। এইভাবে এই দলের অর্থভাণ্ডার স্ফীত হয়ে ওঠে।

বিয়ার হল অভ্যুত্থান

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বিখ্যাত জার্মান সেনাপতি লুডেনড্রফের সহযোগিতায় বলপূর্বক ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে হিটলার ‘বিয়ার হল অভ্যুত্থান’ ঘটান। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় এবং দেশদ্রোহিতার অপরাধে তাঁর বিচার শুরু হয়।

হিটলারের মন্তব্য

তিনি বলেন যে, “১৯১৮-র বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে ঘোর দেশদ্রোহিতা বলে কিছু থাকতে পারে না।” এই উক্তি জনমনে প্রবল আলোড়ন তোলে।

কারারুদ্ধ হিটলার

বিচারে পাঁচ বছরের জন্য তাঁর কারাদণ্ড হয় – যদিও তেরো মাসের মধ্যেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তাঁর মুক্তির শর্ত ছিল যে, তিনি কোনও জনসভায় ভাষণ দেবেন না।

হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেঁই ক্যাম্ফ’

কারাকক্ষের নির্জনতায় তিনি রচনা করেন তাঁর আত্মজীবনী – ৭৮২ পৃষ্ঠার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মেঁই ক্যাম্ফ’ বা ‘আমার সংগ্রাম’। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে নাৎসি দলের মতাদর্শ, ভাবধারা ও কর্মসূচি বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। ‘নাৎসি দলের বাইবেল’ বলে চিহ্নিত এই গ্রন্থটির নয় লক্ষ কপি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি হয়। এই গ্রন্থে তিনি ফ্রান্সকে সরাসরি জার্মান জাতির চিরন্তন শত্রু’ বলে অভিহিত করেন।

হিটলারের নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বব্যাপী মহামন্দা, মিত্রপক্ষকে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য কারণে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করে। ফলে নাৎসি দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যেমন –

(১) নাৎসি দলের প্রতি আকৃষ্ট ও যোগদান

নাৎসি দলের ঘোষিত লক্ষ্য ও কর্মসূচিতে আকৃষ্ট হয়ে বেকার যুবক, করভারে নিপীড়িত জার্মান কৃষক, ইহুদি বণিক ও শিল্পপতিদের একাধিপত্যে বীতশ্রদ্ধ জার্মান ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নাৎসি দলে যোগদান করে।

(২) হিটলারের সুদক্ষ প্রচার

সুদক্ষ প্রচারের মাধ্যমে হিটলার সবার মনে তাদের আশাপূরণের স্বপ্ন জাগিয়ে দেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি, বেকার যুবক-যুবতী, কর্মচ্যুত সৈনিক অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ভূস্বামী ও শিল্পপতিরা মনে করে যে, একমাত্র হিটলারই কমিউনিস্টদের অত্যাচার থেকে তাদের রক্ষা করতে সক্ষম।

(৩) নাৎসি দলের শাখা

ভূস্বামী ও শিল্পপতিদের অর্থানুকূল্যে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে নাৎসি দলের শাখা গড়ে উঠতে থাকে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এই দলের সদস্য ছিল ৫৫০০০। ১৯২৮ সালে তা হয় ১,০৯,০০০। ১৯৩০-এ তা দুই লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।

(৪) ১৯৩০-এর নির্বাচন

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে জার্মান সংসদ বা ‘রাইখস্ট্যাগ’-এর নির্বাচনে এই দলের আসন সংখ্যা ১২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৭-এ পৌঁছয়। তাদের মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ৬০ লক্ষ।

(৫) একক বৃহত্তম দলে পরিণত

১৯৩২ সালের জুলাই মাসের নির্বাচনে ৬০৮টি আসনের মধ্যে নাৎসিরা ২৩০টি আসন লাভ করে একক বৃহত্তম দলে পরিণত হয়।

বহুদলীয় সরকার গঠন

জার্মান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে সরকার গঠনের আহ্বান জানালে তিনি একটি বহুদলীয় সরকার গঠন করেন এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ফন পেপেন-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে চ্যান্সেলার বা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

জার্মান সংসদ অগ্নিদগ্ধ

বহুদলীয় সরকারের শাসন পরিচালনায় নানা অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ায় হিটলারের পরামর্শে বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে জার্মান সংসদ বা রাইখস্ট্যাগ ভবনটি রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়।

কমিউনিস্টদের উপর হিটলারের অত্যাচার

হিটলার প্রচারের মাধ্যমে এর সমস্ত দায় তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ কমিউনিস্টদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর প্রবল অত্যাচার শুরু করেন। এর ফলে সব বিরোধী দলই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

হিটলারের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন

এত চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মার্চ নির্বাচনে নাৎসি দলের আসন সংখ্যা হয় মাত্র ২৮৮। তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়। তাই পুনরায় অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিটলারের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

জার্মানিতে সর্বেসর্বা হিটলার

দেশের দুর্দিনে শাসন পরিচালনার সুবিধার জন্য জার্মান সংসদ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ এক বিশেষ আইন পাস করে সংসদের অনুমোদন ছাড়াই হিটলারকে শাসনকাজ পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়। এর ফলে কার্যত জার্মানিতে তিনি সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।

একচ্ছত্র নেতা হিটলার

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২রা আগস্ট রাষ্ট্রপতি হিন্ডেনবার্গের মৃত্যু ঘটলে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি দুটি পদ নিজে গ্রহণ করে জার্মান রাষ্ট্রে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন এবং নিজেকে ‘ফ্যুয়েরার বা প্রধান নেতা বলে ঘোষণা করেন।

উপসংহার:- ক্ষমতা দখলের পর বিরোধী দল ও নেতৃবৃন্দ বিশেষত ইহুদি ও কমিউনিস্টদের উপর নানা দমন-পীড়ন শুরু হয়। গ্রেপ্তার, গুপ্তহত্যা ও অপরাপর নির্যাতন তাদের উপর নেমে আসে। এইভাবে সব বিরোধিতাকে স্তব্ধ করে দিয়ে হিটলার জার্মানির একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন।

(FAQ) এডলফ হিটলারের উত্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. জার্মানির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে হিটলার কি উপাধি ধারণ করেন?

ফ্যুয়েরার।

২. হিটলার কবে জার্মানির ক্ষমতা দখল করেন?

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে।

৩. হিটলারের লেখা গ্ৰন্থের নাম কি?

মেঁই ক্যাম্ফ বা মেইন ক্যাম্ফ বা আমার সংগ্ৰাম।

Leave a Comment