বাংলার নবজাগরণ

বাংলার নবজাগরণ প্রসঙ্গে বাংলার শিক্ষা সংস্কৃতির অগ্ৰগতি, বাংলার নবজাগরণের জনক, নবজাগরণের প্রসার, যদুনাথ সরকারের অভিমত, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতা, নবযুগের সূচনা, আধুনিক আদর্শের প্রসার, পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মতাদর্শ, প্রাচ্যবিদ্যার চর্চা, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, জ্ঞানের বিকাশ, জাতীয়তাবাদের প্রসার, বিজ্ঞানের অগ্ৰগতি, সংগঠন স্থাপন, নবজাগরণ অভিধা নিয়ে বিতর্ক ও বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানবো।

বাংলার নবজাগরণ

ঐতিহাসিক ঘটনাবাংলার নবজাগরণ
সময়কালউনবিংশ শতক
স্থানবাংলা
প্রধান কেন্দ্রকলকাতা
বাংলার নবজাগরণ

ভূমিকা:- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবল আগ্রহ ভারত-এর, বিশেষ করে বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সদর্থক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির অগ্ৰগতি

পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে ঊনবিংশ শতকে বাংলায় শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি শুরু হয় এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।

বাংলার নবজাগরণ

পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রভাবে বাংলায় এক নবযুগের সূচনা হয়। এই ঘটনা ‘বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত।

নবজাগরণের ধারা অব্যাহত

বাংলার নবজাগরণের ধারা রাজা রামমোহন রায় -এর (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.) সংস্কার কর্মসূচি থেকে শুরু করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি.) সৃজনশীল কাজকর্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

বাংলার নবজাগরণের জনক

স্যার যদুনাথ সরকার, অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমুখ ঐতিহাসিক বাংলার নবজাগরণের জনক হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

নবজাগরণের প্রসার

বাংলার নবজাগরণের অগ্রগতি পরবর্তীকালে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের অন্যান্য প্রান্তে, এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যত্রও প্রসারিত হয়।

যদুনাথ সরকারের অভিমত

স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন যে, “পেরিক্লিসের যুগের এথেন্স যেমন সমগ্র গ্রিস-এর শিল্প ও সংস্কৃতির শিক্ষাকেন্দ্র ও জন্মদাত্রী ছিল, তেমনি ব্রিটিশ শাসনাধীনে সমগ্র ভারতের কাছে বাংলাও ছিল ঠিক তাই।”

যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক

ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার ব্যাপক প্রসার ঘটে। পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা, চিরাচরিত প্রথা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতির বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে।

নবযুগের সূচনা

প্রাচীন ও মধ্যযুগের অবৈজ্ঞানিক শিক্ষার পরিবর্তে বাংলার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কিছুটা অংশ পাশ্চাত্য ইংরেজি ও বিজ্ঞান শিক্ষাগ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মধ্যবিত্তদের মধ্যে অতি দ্রুত পাশ্চাত ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে ও বাংলায় এক নবযুগের সূচনা হয়।

আধুনিক আদর্শের প্রসার

নবজাগরণ-এর প্রভাবে বাংলায় যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগিতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, ডারউইনবাদ প্রভৃতি আধুনিক আদর্শের প্রসার ঘটে।

পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মতাদর্শ

জেরেমি বেথাম (১৭৪৮-১৮৩২ খ্রি.), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯ খ্রি.), চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২ খ্রি.), জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩ খ্রি.) প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তাবিদের মতাদর্শ বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।

প্রাচ্যবিদ্যার চর্চা

পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে যুক্তি ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলায় প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে এই চর্চা শুরু হয়।

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা

প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে স্যার উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব

ম্যাক্সমুলার, কানিংহাম, প্রিন্সেপ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখের গবেষণা ভারতবাসীর সামনে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে তুলে ধরে। ফলে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে দেশবাসী সচেতন হয়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ

পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত বহু শিক্ষিত বাঙালি বাংলার সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার ভাবধারার সংস্কার ঘটান।

জ্ঞানের বিকাশ

নবজাগরণের প্রভাবে বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, চিত্রকলা, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি সার্বিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যেরও অগ্রগতি ঘটতে থাকে।

জাতীয়তাবাদের প্রসার

বঙ্কিমচন্দ্র তার সাহিত্যের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটান। এই সময় বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র এবং সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। বাংলার জ্ঞানবিজ্ঞান ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের চর্চার অগ্রগতি ঘটে। ফলে বাঙালির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি

বিভিন্ন বাঙালি বিজ্ঞানী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে খ্যাতি অর্জন করেন। যেমন –

  • (১) বিখ্যাত পদার্থবিদ, জীববিদ ও উদ্ভিদতত্ত্ববিদ জগদীশ চন্দ্র বসু ক্রেস্কোগ্রাফ আবিষ্কার করেন এবং বেতারযন্ত্রের গবেষণার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটান।
  • (২) পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু কোয়ান্টাম তত্ত্বের গবেষণা করে এবং বোসন কণা আবিষ্কার করে খ্যাতি অর্জন করেন।
  • (৩) বিখ্যাত চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বরের ঔষধ আবিষ্কার করে খ্যাতি অর্জন করেন।
  • (৪) বিখ্যাত পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা ‘সাহা সমীকরণ’ প্রকাশ করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাম চারবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।

সংগঠন স্থাপন

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে বাংলায় বিভিন্ন শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০ খ্রি.), কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ খ্রি.), হিন্দু কলেজ (১৮১৭ খ্রি.), ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটি (১৮১৭ খ্রি.), কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রি.) প্রভৃতি।

‘নবজাগরণ’ অভিধা নিয়ে বিতর্ক

উনিশ শতকে বাংলার জাগরণকে নবজাগরণ” বলা যায় কি না তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। যেমন –

(১) বাস্তব নবজাগরণ

উনিশ শতকে বাংলায় প্রকৃতই নবজাগরণ ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন। বাংলার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জাগরণকে স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর ‘History of Bengal’গ্ৰন্থে দ্বিধাহীনভাবে ‘Renaissance বা ‘নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বাংলার নবজাগরণকে ইতালির নবজাগরণের চেয়েও ব্যাপক, গভীর ও বৈপ্লবিক বলে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক সুশোভন সরকার, অম্লান দত্ত প্রমুখ বাংলার জাগরণের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করেও একে ‘নবজাগরণ’ বলে মেনে নিয়েছেন।

(২) তথাকথিত নবজাগরণ

সেন্সাস কমিশনার অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারি রিপোর্টে বাংলার এই জাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ (so-called renaissance) বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, এই জাগরণ কলকাতার মানুষের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, গ্রামীণ বাংলার জনগণকে তা স্পর্শ করতে পারেনি। সুপ্রকাশ রায়, ড. বরুণ দে, ড. সুমিত সরকার, অরবিন্দ পোদ্দার, ড. অশোক সেন প্রমুখও এই অভিমত সমর্থন করেছেন। পণ্ডিত বিনয় ঘোষ বঙ্গীয় নবজাগরণকে একটি ‘অতিকথা’ বা ‘myth’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৩) নবজাগরণের স্রষ্টা

বাংলার নবজাগরণের প্রকৃত স্রষ্টা কারা তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। বাংলার নবজাগরণে রামমোহন বা ডিরোজিওর কৃতিত্বকে মার্কিন গবেষক ডেভিড কফ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু এই অভিমত যথার্থ নয়। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সমন্বয়ে ভারতবাসীর অন্তরে নবজাগরণের সূচনা হয়।

বাংলার নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা

উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণে কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। যেমন –

(১) উচ্চস্তরে আবদ্ধ

বাংলার নবজাগরণ মূলত সমাজের উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই প্রসারিত হয়েছিল। শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। গ্রামের নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষকে এই নবজাগরণ স্পর্শ করতে পারেনি। এজন্য ড. অনিল বিষয়ে শীল একে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন।

(২) মুসলিম বিচ্ছিন্নতা

বাংলার নবজাগরণ মূলত হিন্দুসমাজের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, এর সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশেষ সম্পর্ক ছিল না।

(৩) ইংরেজ-নির্ভরতা

মূলত ব্রিটিশ সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে বাংলায় জাগরণ এসেছিল। নবজাগরণের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন যে, ইংরেজ শাসনই ভারতীয় সভ্যতার সার্বিক মঙ্গল করতে পারে।

উপসংহার:- সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানতে হবে যে, নবজাগরণ ভারতের মাটিতে এক সর্বব্যাপী বৌদ্ধিক জাগরণ এনে দেয়। এর ফলেই জন্ম নেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, যা ভারত ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে।

(FAQ) বাংলার নবজাগরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন শতকে বাংলায় নবজাগরণ শুরু হয়?

উনিশ শতকে।

২. বাংলার নবজাগরণের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

কলকাতা।

৩. বাংলার নবজাগরণকে এলিটিস্ট আন্দোলন বলেছেন কে?

ড. অনীল শীল।

৪. বাংলার নবজাগরণকে তথাকথিত নবজাগরণ কে বলেছেন?

অশোক মিত্র।

Leave a Comment