নেহরু রিপোর্ট

নেহরু রিপোর্ট -এর জন্য কমিটি গঠন, কমিটির সদস্য, রিপোর্ট প্রস্তুত, প্রকাশ, রিপোর্টের বিষয়সমূহ, বিভিন্ন দলের প্রতিক্রিয়া, জিন্নাহর দাবি, মুসলিম সমাজের ভয়, জিন্নাহর অধিবেশন ত্যাগ, চৌদ্দ দফা দাবি পেশ, নেহরু রিপোর্টের ব্যর্থতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

নেহরু রিপোর্ট প্রসঙ্গে নেহেরু রিপোর্ট কি, জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে নেহেরু কমিটি গঠন, নেহেরু কমিটির সদস্য, নেহেরু রিপোর্ট পেশের সময়কাল, মতিলাল নেহেরুর নেহেরু রিপোর্ট পেশ, নেহেরু রিপোর্টের বিষয়সমূহ, নেহেরু রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া, নেহেরু রিপোর্টের ব্যর্থতা ও নেহেরু রিপোর্টের গুরুত্ব।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের নেহরু রিপোর্ট

বিষয়নেহরু রিপোর্ট
নেহরু কমিটি গঠন১৯ মে, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ
সদস্যমতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ
রিপোর্ট পেশআগস্ট, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ
ফলাফলব্যর্থতা
নেহরু রিপোর্ট

ভূমিকা :- জাতীয় জীবনের সংকটময় পরিস্থিতিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কেবলমাত্র সাইমন কমিশন বর্জনের মত নেতিবাচক কর্মপদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই পর্বে জাতীয় নেতৃবৃন্দ সংবিধান রচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়ে তাঁদের প্রজ্ঞা, মনীষা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও বাস্তববোধের স্বাক্ষর রাখেন।

সাইমন কমিশন গঠন

ভারতবাসীর আত্মমর্যাদাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ইংরেজদের নিয়ে ভারতের সংবিধান তৈরির জন্য সাইমন কমিশন গঠিত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে সূচনা সাইমন কমিশন-বিরোধী এক প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে।

ভারত সচিবের প্রশ্ন

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুলাই এবং ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপনের সময় পর পর দু’বার ভারত সচিব বার্কেনহেড সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে বিদ্রূপ করেন।

বার্কেনহেডের উক্তি

ভারত সচিব বার্কেনহেড বলেন যে, পরস্পর বিরোধী স্বার্থযুক্ত বিভিন্ন দলে বিভক্ত ভারতীয়দের পক্ষে কখনই একটি সর্বসম্মত সংবিধান রচনা করা সম্ভব নয়।

সংবিধান রচনার প্রস্তাব

ভারত সচিবকে যোগ্য জবাব দেবার জন্য ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে সর্বদলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সর্বদলীয় সম্মেলন

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা ডাঃ এম. এ. আনসারী-র সভাপতিত্বে দিল্লীতে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ঊনত্রিশটি বিভিন্ন দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন।

নেহেরু কমিটি

বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে সংবিধান তৈরির কাজ চলতে পারে না। তাই ১৯ শে মে সর্বদলীয় সম্মেলনের বোম্বাই অধিবেশনে প্রবীণ ‘স্বরাজী’ নেতা মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির ওপর ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের খসড়া তৈরির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এই কমিটি ‘নেহরু কমিটি’ নামে পরিচিত।

নেহেরু কমিটির সদস্য

তরুণ জওহরলাল নেহরু এই কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু (উদারপন্থী), আলি ইমাম ও সাহেব কুরেশী (মুসলিম লীগ), এম. এস. অ্যানে ও এম. আর জয়াকার (হিন্দু মহাসভা), জি. আর. প্রধান (অব্রাহ্মণ), সর্দার মঙ্গল সিং (শিখ), এন. এম. যোশী (শ্রমিক সংগঠন) এবং সুভাষচন্দ্র বসু (কংগ্রেস)।

নেহেরু রিপোর্ট

দীর্ঘ পঁচিশটি বৈঠকের পর এই কমিটি সর্বদলের গ্রহণযোগ্য একটি খসড়া সংবিধান বা রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্ট ‘নেহরু রিপোর্ট’ নামে পরিচিত।

নেহেরু রিপোর্ট পেশ

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে (২৮-৩১শে) লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে রিপোর্টটি পেশ করা হয় এবং তা গৃহীতও হয়।

নেহেরু রিপোর্টের বিষয় সমূহ

এই রিপোর্টের খসড়ায় বলা হয় –

  • (১) ভারতের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হবে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন। কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মত ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য -এর অন্তর্ভুক্ত একটি স্বশাসিত রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে।
  • (২) ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং এর মূল ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে।
  • (৩) কেন্দ্র ও প্রদেশে দায়িত্বশীল সরকার গঠিত হবে।
  • (৪) কয়েকটি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া কেন্দ্র ও প্রদেশের আইনসভাগুলিতে যৌথ নির্বাচনের নীতি প্রচলিত হবে।
  • (৫) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা যথাক্রমে ২০০ (উচ্চকক্ষ) এবং ৫০০ জন (নিম্নকক্ষ) প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের সদস্যেরা নির্বাচিত হবেন প্রাদেশিক আইনসভা সমূহের সদস্যদের দ্বারা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে।
  • (৬) নিম্নকক্ষের সদস্যেরা এবং এক কক্ষবিশিষ্ট প্রাদেশিক আইনসভা সমূহের প্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হবেন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে।
  • (৭) প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে এবং কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার সমূহের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতা বণ্টিত হবে।
  • (৮) সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে এবং সংখালঘু সম্প্রদায়গুলির ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির নিরাপত্তার ব্যবস্থাও থাকবে।
  • (৯) বাংলা ও পাঞ্জার বাদে অন্যানা প্রাদেশিক আইনসভা গুলিতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে দশ বছরের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আসন সংরক্ষিত থাকবে।
  • (১০) ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠিত হবে।
  • (১১) এছাড়াও নেহরু রিপোর্টে সর্বজনীন ভোটাধিকার, নারীর সমানাধিকার, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রভৃতি স্বীকৃত হয়।

নেহেরু রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া

  • (১) কংগ্রেস কার্যনির্বাহক কমিটি এই রিপোর্ট সমর্থন করে।
  • (২) জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃবৃন্দও (মৌলানা আজাদ, ডাঃ আনসারী, স্যার আলি ইমাম, ডাঃ কিচলু প্রমুখ) এই রিপোর্টের প্রতি সমর্থন জানায়।
  • (৩) সংখ্যালঘু হিসেবে পাঞ্জাবের শিখরা বিশেষ প্রতিনিধিত্বের দাবি করে এবং তাদের দাবি নাকচ হলে তারা সভা ত্যাগ করে।
  • (৪) মাদ্রাজ এর অব্রাক্ষণ দল এবং ডঃ আম্বেদকর -এর অনুন্নত গোষ্ঠীও নেহরু রিপোর্টের বিরোধিতা করে। এইভাবে সাম্প্রদায়িকতাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস বানচাল করে দেয়।
  • (৫) জাতীয় কংগ্রেসের বৃহদংশ নেহরু রিপোর্ট মেনে নিলেও জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন তরুণ গোষ্ঠী ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’-এর বিরোধী ছিল। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা।
  • (৬) ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় অধিবেশনে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা মহম্মদ আলি জিন্না মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা দাবি করেন।

নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশের পর জিন্নাহর দাবি

মহম্মদ আলি জিন্নাহর দাবিগুলি হল –

  • (১) কেন্দ্রীয় আইনপরিষদে মুসলিমদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
  • (২) নেহরু রিপোর্টে প্রস্তাবিত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে।
  • (৩) বাড়তি সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে, কেন্দ্রের হাতে নয়।

নেহেরু রিপোর্ট প্রকাশে মুসলিম সমাজের ভয়

আসলে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ও যৌথ নির্বাচন সম্পর্কে মুসলিমদের মনে যথেষ্ট ভয় ছিল কারণ তাঁরা মনে করতেন যে, এর ফলে ভারতে হিন্দু প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং পৃথক নির্বাচনমণ্ডলী।

জিন্নাহর অধিবেশন ত্যাগ

হিন্দু মহাসভা নেতা ডাঃ এম. আর জয়াকার, উদারনৈতিক নেতা ডাঃ তেজবাহাদুর সপ্রু এই সব দাবির বিরুদ্ধে ঘোরতর প্রতিবাদ জানান। তাঁর দাবি নাকচ হলে ক্ষুব্ধ জিন্না অধিবেশন স্থল ত্যাগ করেন এবং মুসলিম লীগের রক্ষণশীল গোষ্ঠীভুক্ত আগা খাঁ, মহম্মদ সফি, মহম্মদ ইকবাল প্রমুখের সঙ্গে হাত মেলান।

জিন্নাহর চৌদ্দ দফা দাবি পেশ

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে মার্চ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বাৎসরিক অধিবেশনে তিনি বিখ্যাত ‘চৌদ্দ দফা দাবি পেশ করেন।

নেহেরু রিপোর্টের ব্যর্থতা

নেহরু রিপোর্ট সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংবিধানের খসড়া রচনা করতে পারে নি। ডঃ তারা চাঁদ বলেন যে, “নেহরু রিপোর্টটি ছিল জন্মলগ্নেই মৃত এবং এক বছর অতিক্রান্ত না হতেই রাভী নদীর জলে তাকে বিসর্জন দেওয়া হয়।”

নেহেরু রিপোর্টের গুরুত্ব

ব্যর্থতা সত্ত্বেও নেহরু রিপোর্টের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

  • (১) নেহরু রিপোর্টের প্রধান গুরুত্ব হল এই যে, বিভিন্ন ধর্ম, দল ও মতের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে এই প্রথম ভারতীয় উদ্দোগে একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো রচিত হল।
  • (২) নেহেরু রিপোর্ট এই কথাই প্রমাণ করল যে, ভারতের সব দল ও সম্প্রদায়ই ভারতে একটি দায়িত্বশীল সরকার চায়।
  • (৩) নেহেরু রিপোর্ট ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা, মনীষা ও উন্নত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

উপসংহার :- নেহেরু রিপোর্টে সর্বজনীন ভোটাধিকার, নারীর সমানাধিকার, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, যৌথ নির্বাচন, সংসদীয় গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অনিরপেক্ষতার নীতি স্বীকৃত হয়েছে। তাই নানা ত্রুটি সত্ত্বেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “নেহেরু রিপোর্ট” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের নেহরু রিপোর্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নেহরু রিপোর্ট কী?

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মৌতে সর্বদলীয় সন্মেলনের পূর্ণ অধিবেশনে নেহেরু কমিটির প্রধান মতিলাল নেহেরু সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন । এই খসড়া সংবিধানই নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত।

২. নেহরু রিপোর্ট প্রকাশিত হয় কত সালে?

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে।

৩. নেহরু রিপোর্টের খসড়া প্রস্তুত করেন কে?

মতিলাল নেহরু।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment