ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর -এর সময়কাল, স্থান, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ হিসেবে ইংরেজদের কলকাতা পুনর দখল, বাংলা নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পলাশীর যুদ্ধ, মীরজাফরের নবাব পদ লাভ, কোম্পানির দেওয়ানি লাভ, কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা, লোভ ও লালসা, বাংলার গভর্নরের ব্যর্থতা, দ্বৈত শাসনের কুফল, গ্রামীণ অর্থনীতির অবনতি, রাজস্বের পরিমাণ অত্যাধিক কৃষি বিপর্যয়, অনাবৃষ্টি, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, রাম সে মুরের অভিমত, রবার্ট ক্লাইভের অভিমত, মন্বন্তর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল হিসেবে জনশূন্য গ্রামাঞ্চল, সাহিত্যে উল্লেখ, লোকাভাব, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি, দুর্নীতিমূলক কাজ ও আইন শৃঙ্খলা ধ্বংস সম্পর্কে জানবো।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর প্রসঙ্গে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কি, ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ১৭৭০ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বাংলা ১১৭৬ সাল তাই ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নাম, বাংলার কৃষি অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব, বাংলার জনসংখ্যা এক তৃতীয়াংশ হ্রাস, সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্নীতির ফল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভিন্ন কারণ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল সম্পর্কে জানব।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ঐতিহাসিক ঘটনাছিয়াত্তরের মন্বন্তর
সময়কাল১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ
গভর্নরকার্টিয়ার
পলাশীর যুদ্ধ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ
দেওয়ানি লাভ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

ভূমিকা:- বাংলার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের নাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ( ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে একে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কারণ

বিভিন্ন কারণে বাংলায় ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। যেমন –

(১) ইংরেজদের কলকাতা পুনর্দখল

১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে নেবার পর লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজ যোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কলকাতা পুনর্দখল করেন (২জানুয়ারি, ১৭৫৭)।

(২) বাংলার নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

চন্দননগর দখল করার পরে সিরাজউদৌল্লাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন।

(৩) পলাশীর যুদ্ধ

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদৌল্লার সঙ্গে প্রহসন মূলক পলাশির যুদ্ধ হয়। সিরাজউদৌল্লা পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন।

(৪) মীরজাফরের নবাব পদ লাভ

মীরজাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হত।

(৫) কোম্পানির দেওয়ানি লাভ

ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ভারত-এ আবার ফিরে আসেন এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি ১ আগস্ট ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন।

(৬) কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা

রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতবর্ষে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমনেও যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। তাঁর দৃঢ়তার ফলে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলেও কোম্পানির স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছিল।

(৭) লোভ ও লালসা

ক্রমে লোভ ও লালসার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল ব্রিটিশ কর্মচারীদের মনের গভীরে। সেই লালসায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল এক শ্রেণীর হীনমনা বঙ্গসন্তান। এরা ইংরেজের পদলেহন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল নিজেদের ঐশ্বর্যসম্পদ।

(৮) গভর্ণরের ব্যর্থতা

ক্লাইভের পরে ব্রিটিশ গভর্নর রূপে এসেছিলেন যথাক্রমে ভেরেলস্ট (১৭৬৭-‘৬৯ খ্রীঃ) এবং কার্টিয়ার (১৭৬৯-৭২ খ্রীঃ)। প্রশাসক হিসেবে দু’জনেই ছিলেন ব্যর্থ। তাই সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি ও শোষণ-এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পার্সিভাল স্পিয়ার আলোচ্য সময়কে ব্রিটিশ কর্তৃক ‘প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৯) দ্বৈত শাসনের কুফল

ক্লাইভ প্রবর্তিত ‘হাঁসজারু’ শাসনব্যবস্থা যা সাধারণভাবে ‘দ্বৈত-শাসন‘ নামে খ্যাত বা কুখ্যাত, তা ছিল অরাজকতা ও শোষণের মাধ্যম মাত্র। নবাব ছিলেন সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন। কোম্পানি ‘দেওয়ান’ হলেও দেওয়ানি কাজ ছিল চরিত্রহীন। রেজা খাঁও, সিতাব রায় প্রমুখের হস্তগত। তাদের না ছিল মানবিকতা, না ছিল নীতিবোধ।

(১০) গ্ৰামীণ অর্থনীতির অবনতি

ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার ফলে সমগ্র রাজস্ব ব্যবস্থায় অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। দ্রুত অবনতি ঘটে গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থার।

(১১) রাজস্বের পরিমাণ অত্যধিক

মুঘল যুগের রাজস্বের স্থিরতা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু আলোচ্য সময়ে কৃষিক্ষেত্রে নেমে আসে সর্বগ্রাসী প্রলোভন। রামসে মুর-এর ভাষায়, কোম্পানির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কৃষিক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। রাজস্ব কর্মচারীদের স্থায়িত্ব নির্ভর করত কে কত বেশি রাজস্ব আদায় করতে পারে তার ওপর। রাজস্বের কোন সর্বোচ্চ বা নির্দিষ্ট সীমা ছিল না।

(১২) কৃষি বিপর্যয়

কৃষিতে আগত বিপর্যয়ের কথা উপলব্ধি করে গভর্নর ভেরেলেস্ট ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ড-এ জানান যে, “ব্যবসায় থেকে যতখুশী লাভ করা যায়, কিন্তু জমির উৎপাদনক্ষমতা সীমিত। বাংলার কৃষি ধ্বংস হলে তা হবে ইংরেজদের পক্ষে বিপর্যয় স্বরূপ।’ কিন্তু এই সতর্কবাণী কর্তৃপক্ষের কাছে কোন গুরুত্বই পায়নি।

(১৩) অনাবৃষ্টি

শোষণ জনিত কৃষি বিপর্যয়ের সাথে বিধাতার অভিসম্পাত স্বরূপ অনাবৃষ্টি যুক্ত হলে বাংলার চাষের নাভিশ্বাস ওঠে। বিহার ও বাংলায় এই অনাবৃষ্টি শুরু হয় ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এবং তা অব্যাহত থাকে ১৭৬৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। খাঁ খাঁ করতে থাকে বাংলার মাঠ-ঘাট।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

উপর্যুপরি শস্যহানির ফলে ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে (বাংলায় ১১৭৬ সন) দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসে। এটিই ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত।

রামসে মুরের মন্তব্য

ঐতিহাসিক রামসে মুর বলেছেন, “নির্মমভাবে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা, কোম্পানির কর্মচারীদের সীমাহীন লাভের আকাঙ্ক্ষা জনগণকে মৃত্যুমুখী করে তোলে।”

রবার্ট ক্লাইভের মন্তব্য

স্বয়ং ক্লাইভও মন্তব্য করেছেন যে, “পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এত অরাজকতা বিভ্রান্ত, দুর্নীতি ও শোষণ-পীড়নের কথা কেউ শোনেনি যার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল এই বাংলাদেশ।” এত বিপুল সম্পদ আর কোনো দেশ থেকে লুণ্ঠিত হয়নি।

মন্বন্তর

সরকারের অবিবেচক ও হটকারী সিদ্ধান্তসমূহ এই দুর্ভিক্ষকে মহামারীতে রূপান্তরিত করে। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও কর্মচারী কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের একচেটিয়া কারবার শুরু করে দেয়। সরকার সেনাবাহিনীর জন্য লক্ষ-লক্ষ মণ খাদ্যশস্য মজুত করতে থাকে। যে সামান্য খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল, তাও মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। সরকার খাজনা মুকুবের পরিবর্তে আরও কঠোরতার সাথে খাজনা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেন। একদিকে খাদ্যাভাব অন্যদিকে সরকারি নিপীড়ন বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল

বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলাফল ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই দুর্ভিক্ষের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ –

(১) জনশূন্য গ্ৰামাঞ্চল

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন প্রচণ্ডভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্যাভাবে প্রাণ হারায়। বাংলায় গ্রামাঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। বহু অঞ্চল জঙ্গলে পরিণত হয়।

(২) সাহিত্যে উল্লেখ

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় -এর ‘আনন্দমঠ‘ উপন্যাস থেকে এই মন্বন্তরের ভয়াবহতার এক সকরুণ চিত্র পাওয়া যায়।

(৩) লোকাভাব

কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার ফলে কৃষিকার্যে লোকাভাব প্রকট হয়ে ওঠে। একইভাবে বিভিন্ন শিল্পকাজের জন্যও লোকাভাব দেখা দেয়।

(৪) ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতি

লোকাভাবে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যের ব্যবসাবাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার প্রসিদ্ধ বস্ত্রশিল্প প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।

(৫) দুর্নীতিমূলক কাজ

অর্থাভাবে ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত মানুষ তাদের নীতিবোধ হারিয়ে দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সর্বত্র আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। শুরু হয় ডাকাতি ও লুঠতরাজ। দিনাজপুর, রংপুর, মালদা, রাজসাহী প্রভৃতি জেলায় এই ধরনের অপকর্ম ভীষণ আকার লাভ করে।

(৬) আইন শৃঙ্খলা ধ্বংস

উত্তর-ভারত থেকে আগত লোকেরা ফকির ও সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে অবাধে লুণ্ঠন কাজ চালিয়ে যায়। দেশে আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বলে কিছুই ছিল না।

উপসংহার:- দুর্ভিক্ষ-পীড়িত গ্রাম বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ শহরে চলে যেতে শুরু করে। ফলে একদিকে শহরগুলির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে, আবার গ্রামগুলি জনহীন হয়ে পড়ায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এইভাবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে পঙ্গু করে দেয়।

(FAQ) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়কাল কত?

১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দ।

২. বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় গভর্নর কে ছিলেন?

কার্টিয়ার।

৩. ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কাহিনীকার কোন উপন্যাসে পাওয়া যায়?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস।

Leave a Comment