কোলদের পরিচয়, আদি নিবাস, কোলদের জীবনধারণ পদ্ধতি, কোল বিদ্রোহ, বিদ্রোহের কারণ, প্রথম পর্বের বিদ্রোহ, দ্বিতীয় পর্বের বিদ্রোহ, বিদ্রোহের সূচনা, প্রসার, নেতৃত্ব, অবসান, বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল সম্পর্কে জানবো।
কোল বিদ্রোহ প্রসঙ্গে কোল বিদ্রোহের সময়কাল, কোল বিদ্রোহের স্থান, কোল বিদ্রোহের নেতা, কোল বিদ্রোহের সময় চাইবাসার যুদ্ধ, কোল বিদ্রোহের এলাকা, কোলদের বিরুদ্ধে চাইবাসার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি, ছোটনাগপুরে কোল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহের কারণ বা পটভূমি, প্রথম পর্বের কোল বিদ্রোহ, দ্বিতীয় পর্বের কোল বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহের সূচনা, কোল বিদ্রোহের প্রসার, কোল বিদ্রোহের অবসান, কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, কোল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব, কোল বিদ্রোহের পর দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি গঠন।
১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দের কোল বিদ্রোহ
ঐতিহাসিক ঘটনা | কোল বিদ্রোহ |
সময়কাল | ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | ছোটোনাগপুর, সিংভূম, মানভূম অঞ্চলে |
নেতৃত্ব | বুন্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সিংরাই, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুণ্ডা |
ফলাফল | ব্যর্থতা |
ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটে, তাদের মধ্যে কোল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম।
কোলদের পরিচয়
কোলরা ছিল ভারতবর্ষ -এর অন্যতম একটি আদিবাসী সম্প্রদায় বা উপজাতি সম্প্রদায়।
কোলদের আদি বাসভূমি
কোলদের আদি বাসভূমি ছিল বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে। কোলরা হো, মুন্ডা, ওরাও প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল।
কোলদের জীবনধারন পদ্ধতি
- (১) কোলরা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। আমরা জানি, আদিবাসী মাত্রই অত্যন্ত পরিশ্রমী হয়ে থাকেন।
- (২) কোলরা যখন বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে এসেছিল তখন এই অঞ্চলটি দুর্ভেদ্য অরণ্য দ্বারা ঘেরা ছিল।
- (৩) কোলরা ছোটনাগপুরে জঙ্গল কেটে কৃষিক্ষেত্র তৈরি করেছিল। সেখানে তারা যৌথভাবে অর্থাৎ একসঙ্গে কৃষিকাজ করত।
- (৪) কোলরা নিজেদের পৃথক উপজাতীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থা দ্বারা নিজেদেরকে স্বাধীন ভাবে পরিচালিত করত।
- (৫) সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে নিরুপদ্রবে কোলরা বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে তাদের জীবন যাত্রা অতিবাহিত করত।
কোল বিদ্রোহ
বর্তমান বিহারের ছোটোনাগপুর, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনকালে কোল উপজাতির মানুষ বসবাস করত। তাদের ওপর ব্রিটিশ সরকার, বহিরাগত জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শোষণের ফলে তারা বিদ্রোহ শুরু করে, যা ‘কোল বিদ্রোহ’ (১৮৩১-৩২ খ্রি.) নামে পরিচিত।
কোল বিদ্রোহের কারণ
কোল বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) রাজস্ব আদায়
আগে কোলরা রাজস্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল না। কিন্তু ছোটোনাগপুর অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। বহিরাগত হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মহাজনদের হাতে এখানকার জমির ইজারা দিয়ে তাদের হাতে রাজস্ব আদায়ের অধিকার তুলে দেওয়া হয়।
(২) রাজস্ব বৃদ্ধি
জমিদাররা দরিদ্র কোলদের ওপর রাজস্বের পরিমাণ অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয় এবং নতুন নতুন কর আরোপ করে। এই কর আদায় করতে গিয়ে তাদের ওপর চরম অত্যাচার চালানো হয়। কোলদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পানীয় মদের ওপর উচ্চহারে কর ধার্য করা হয়।
(৩) জমি থেকে উৎখাত
ইজারাদাররা কোলদের সর্বস্ব কেড়ে নিতে থাকে। এমনকি জমি থেকেও তাদের উৎখাত করতে শুরু করে।
(৪) নির্যাতন
কোলদের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করা হত। এক্ষেত্রে অনেকসময়ই কোল রমণীদের মর্যাদা নষ্ট করা এবং নানা অজুহাতে কোল পুরুষদের বন্দি করে রাখা হয়।
(৫) অর্থনৈতিক শোষণ
রাস্তা তৈরির জন্য বিনা পারিশ্রমিকে কোলদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করা হত। কোলদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে তাদের আফিম চাষে বাধ্য করা হয়।
(৬) কোল ঐতিহ্য ধ্বংস
কোলদের নিজস্ব আইনকানুন বিচারপদ্ধতি প্রভৃতি ধ্বংস করে তাদের ওপর জোর করে ব্রিটিশ আইনকানুন ও বিচারপদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাই কোলরা ক্ষুদ্ধ হয়েই বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
(৭) মদের ওপর কর বৃদ্ধি
কোলদের অসন্তোষের আরেকটি বড়ো কারণ ছিল তাদের প্রিয় পানীয় মদের ওপর কর বৃদ্ধি। মদের ওপর সরকার চড়া হারে কর বসালে কোলদের অসন্তোষ চরমে ওঠে।
প্রথম পর্বের কোল বিদ্রোহ
- (১) ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে কোলরা প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। এই সময় পোড়াহাটের করদ রাজা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে কোলদের কাছ থেকে বলপূর্বক খাজনা আদায় শুরু করলে কোলরা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে।
- (২) এই সময় কোলরা রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করলে পোড়াহাটের রাজা ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সুযোগে ইংরেজ কোম্পানি ছোটনাগপুর এলাকায় নাক গলানোর সুযোগ পেয়ে যায়।
- (৩) প্রথম পর্বের বিদ্রোহে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে চাইবাসার যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি রোগসেস -এর কাছে কোলরা পরাজিত হয়।
- (৪) এর পর ছোটনাগপুর এলাকায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের ওপর জমিদার, মহাজন ও বিদেশী দিকুদের শোষন নেমে আসে। এই শোষন তীব্র আকার ধারন করলে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কোলরা দ্বিতীয় বার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় পর্বের কোল বিদ্রোহ
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রাচী জেলার মুন্ডা ও ওঁরাও সম্প্রদায়ের কোলরা প্রথম এই বিদ্রোহ শুরু করে। পরে তা সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ ও পালমৌতে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্বের কোল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল।
কোল বিদ্রোহের সূচনা
ব্রিটিশ কোম্পানি কোল-অধ্যুষিত অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেই অঞ্চল বহিরাগত জমিদারদের ইজারা দেয়। এরপর থেকে কোলদের ওপর সরকার, জমিদার ও মহাজনদের তীব্র শোষণ শুরু হয়। এর প্রতিবাদে ১৮৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আদিবাসী কোলরা বিদ্রোহ শুরু করে।
কোল বিদ্রোহের প্রসার
কোল বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর শ্রীঘ্রই তা সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ ও পালামৌ জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা ইংরেজ কর্মচারী, জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে, তাদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং বহু লোককে হত্যা করে।
কোল বিদ্রোহের নেতৃত্ব
এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন বুন্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সিংরাই, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুণ্ডা প্রমুখ।
কোল বিদ্রোহের অবসান
শীঘ্রই ক্যাপটেন উইলকিনসনের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালিয়ে বহু আদিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করলে বিদ্রোহ বন্ধ হয়ে যায়।
কোল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
এই বিদ্রোহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
(১) কোল বিদ্রোহ আদিবাসীদের বিদ্রোহ
আদিবাসী কোলরা এই বিদ্রোহে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে নিম্নবর্ণের অন্যান্য চাষি, কামার, কুমোর প্রভৃতি মানুষও যোগদান করে।
(২) কোল বিদ্রোহে ঐক্যবদ্ধতা
বিদ্রোহ চলাকালীন আদিবাসী কোলরা ইংরেজ শাসক, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিল।
(৩) কোলদের অরণ্যের অধিকার
কোলদের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে অরণ্য সম্পদের ওপর কোলদের চিরাচরিত অধিকার রক্ষার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছিল।
(৪) কোলদের ব্রিটিশ বিরোধিতা
কোল বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ ও বহিরাগত জমিদাররা। চার্লস মেটকাফের মতে, ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটানোই ছিল বিদ্রোহীদের প্রধান উদ্দেশ্য।
(৫) কোল বিদ্রোহের বার্তা
বিদ্রোহী কোলরা নাগাড়া বাজিয়ে, আমগাছের শাখা বা যুদ্ধের তির বিলি করে নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহের বার্তা ছড়িয়ে দিত।
(৬) কোল বিদ্রোহে সহযোগিতার অভাব
কোল বিদ্রোহের প্রতি শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার অভাব লক্ষ করা গিয়েছিল।
কোল বিদ্রোহে ইংরেজদের আতঙ্ক
শহুরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলেও কোলরা যেভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত করে, তাতে ইংরেজরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
কোল বিদ্রোহের ফলাফল বা গুরুত্ব
কোল বিদ্রোহের ফলাফলগুলি ছিল নিম্নরূপ। –
(১) কোল বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ নীতির পরিবর্তন
কোল বিদ্রোহের ফলে কোল অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রিটিশ কোম্পানি তাদের নীতির কিছু পরিবর্তন ঘটায়।
(২) কোল বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি
ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে কোল উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে কোলদের জন্য দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি নামে একটি অঞ্চল গঠন করে।
(৩) কোল বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ আইন বাতিল
সরকার ঘোষণা করে যে, দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি অঞ্চলে ব্রিটিশ আইন বাতিল হবে এবং কোলদের নিজস্ব আইনকানুন কার্যকর হবে।
(৪) কোল বিদ্রোহের ফলে জমি ফেরত
জমিদার -রা কোলদের যেসব জমিজমা অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছিল তা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে কোলদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
উপসংহার :- কোল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার কোলদের প্রতি কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাদের প্রতি শোষণের মাত্রা হ্রাস পায়নি। তার ওপর কোলদের এলাকায় খাজনার হার ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “কোল বিদ্রোহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে।
১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে পোড়াহাটের জমিদার ও তার সহযোগী ইংরেজ সেনাপতি রোগসেস-এর সাথে আদিবাসী কোলদের মধ্যে।
১৮২০-২১ খ্রিস্টাব্দে।
ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ছোটোনাগপুরের রাঁচিতে।
বুন্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সিংরাই, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুণ্ডা।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে।
অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি
- কেন্দ্রীয় চোল শাসন
- সাম্রাজ্য ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য
- অর্থনীতিতে দাসপ্রথার গুরুত্ব
- রোমের দাসদের মুক্তির উপায়
- রোমান সাম্রাজ্য ও উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে যোগাযোগের প্রভাব
- জাস্টিনিয়ান পরবর্তী রাজবংশ
- রোমান সমাজে নারীর অবস্থান
- বাইজানটাইন সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা দিক
- রোমান সাম্রাজ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ