তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Taxila University)

আজ আমরা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Taxila University) -এর সূচনাকাল, অবস্থান, নামকরণ, শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার্থীর ব্যয়, গুরুর ক্ষমতা, পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি, বিখ্যাত ছাত্রগণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উৎকর্ষ কেন্দ্র সম্পর্কে জানবো।

ভারতের বিখ্যাত প্রাচীন তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে তার অবস্থান, সূচনাকাল, নামকরণ, রাজধানী ও শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশিলা, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র তক্ষশিলা, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী তক্ষশিলা, পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্র তক্ষশিলা, কৌটিল্য ও তক্ষশিলা, মহাভারত ও তক্ষশিলা, ফা হিয়েন ও তক্ষশিলা, প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশিলা, বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়ন ক্ষেত্র তক্ষশিলা, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যয়, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুর ক্ষমতা, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম, শিক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ণ পদ্ধতি, বিখ্যাত ছাত্র, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উৎকর্ষ কেন্দ্র সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Ancient University of Taxila)

অবস্থানবর্তমান পাকিস্তান -এর রাওয়ালপিন্ডির নিকটবর্তী অঞ্চল
স্বীকৃতি১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ- ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
প্রতিষ্ঠাতারামায়ণ -এর ভরত ও মাণ্ডবীর পুত্র তক্ষ (অনুমেয়)
গুরুত্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়
ধর্মহিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়

ভূমিকা :- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় -এর মতই তক্ষশীলা ছিল প্রাচীন ভারত -এর উচ্চশিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বৈদিক সভ্যতার সময়কালে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা হলেও এটি বৌদ্ধযুগ পর্যন্ত স্থায়িত্ব লাভ করেছিল।

তক্ষশীলার সূচনাকাল

পরবর্তী সময়কার বিভিন্ন লেখায় ছড়ানো ছিটানো সূত্র থেকে জানা যায় যে, তক্ষশীলার সূচনা সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে হয়েছিল।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাওয়ালপিণ্ডির নিকটবর্তী অঞ্চলে।

তক্ষশীলার নামকরণ

তক্ষশীলার নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।

  • (১) বলা হয়ে থাকে যে, তক্ষশীলার নামকরণ হয়েছে রামের ভাই ভরত ও তার স্ত্রী মাণ্ডবীর পুত্র তক্ষের নামানুসারে।
  • (২) কিংবদন্তি আছে যে, তক্ষ একটি রাজ্য শাসন করতেন যার নাম ছিল তক্ষ খন্ড এবং তিনিই তক্ষশীলা নগরের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (৩) দামোদর ধর্মানন্দ কৌশাম্বী প্রবর্তিত তত্ত্ব অনুযায়ী, তক্ষশীলা নামটি তক্ষক শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত যা ছুতার বা সূত্রধর শব্দের সংস্কৃতরূপ এবং এই শব্দটি প্রাচীন ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর অপর একটি নাম।

রাজধানী ও শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশীলা

তক্ষশীলা নগরটি কখনো কখনো পুষ্কলাবতীর সঙ্গে গান্ধার -এর রাজধানীর দায়িত্ব পালন করেছে আবার কখনো বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র রূপে খ্যাতি অর্জন করেছে।

হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র তক্ষশীলা

প্রাচীন তক্ষশীলা নগরী ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং বর্তমান সময়েও উক্ত ধর্মদুটির ঐতিহ্যে এ স্থানটির একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।

বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান তক্ষশীলা

১৯৮০ সালে বেশকিছু এলাকাসহ তক্ষশিলাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্র তক্ষশীলা

গার্ডিয়ান পত্রিকা ২০০৬ সালে তক্ষশিলাকে পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যটন স্থান হিসেবে নির্বাচিত করে।

কৌটিল্য ও তক্ষশীলা

কথিত আছে যে, কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র এই তক্ষশীলা নগরেই রচনা করেছিলেন।

মহাভারত ও তক্ষশীলা

হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে আছে যে, কুরুর উত্তরাধিকার পরীক্ষিতকে তক্ষশীলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় এর সর্পসত্র যোজনায় ব্যাস কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার শিষ্য বৈশম্পায়ন সর্বপ্রথম তক্ষশিলাতেই মহাভারত পাঠ করেন।

ফা হিয়েন ও তক্ষশীলা

চৈনিক ভিক্ষু ফা-হিয়েন ৪০৫ খ্রিষ্টাব্দের তার তক্ষশীলা ভ্রমণকাহিনীতে তক্ষশীলা রাজ্যের অর্থ ‘ছিন্ন মস্তক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই নামটির উৎপত্তি হয়েছে বুদ্ধের জীবনের একটি ঘটনা থেকে, কেননা এটিই সেই জায়গা ‘যেখানে বুদ্ধ তার মাথা একটি লোককে দিয়েছিলেন’।

প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশীলা

তক্ষশীলা কখনো কখনো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পাঠদান করা হতো না।

বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়নস্থল তক্ষশীলা

রাজা বিম্বিসার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবক এখানে অধ্যয়ন করেছিলেন। এই স্থান তৎকালীন বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অধ্যয়নস্থল ।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা 

তক্ষশীলায় শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা দেওয়া হত।

  • (১) ষােলাে বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থীরা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত।
  • (২) ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ বর্ষীয় শিক্ষার্থীরা এখানে শিক্ষাগ্রহণ করত।
  • (৩) তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ আবাসিক ছিল না। গুরুগৃহে বা পৃথকভাবেও থাকা যেত।
  • (৪) শূদ্রদের পঠনপাঠনের কোনােরূপ ব্যবস্থা তক্ষশিলায় ছিল না।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ব্যয়

তক্ষশিলায় শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়ে পড়তে হত।

  • (১) অবস্থাপন্ন শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ শিক্ষাক্রমের বেতন ভরতির সময়ে এবং অন্যরা শিক্ষার শেষের দিকে বেতন দিত।
  • (২) দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষারথীরা অর্থ দিতে না পারলে তার বিনিময়ে গুরুগৃহে নানা ধরনের দৈহিক পরিশ্রম করত।
  • (৩) সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেতন হিসেবে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা জমা দিতে হত।
  • (৪) অনেক সময় ধনী ব্যক্তিরা দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার খরচ বহন করতেন।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুর ক্ষমতা

তক্ষশিলার উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে গুরুরা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে, নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করতেন। গুরুই শিক্ষার্থী নির্বাচন এবং পাঠক্রম নির্ধারণ করতেন।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম

তক্ষশিলার উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে বেদ, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কারিগরিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, বাণিজ্য, কৃষি, হিসাবরক্ষণ, শিল্পকলা, অঙ্কন, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করা হত।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি

তক্ষশীলায় মৌখিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হত। তবে লিপি এবং পুঁথির প্রচলনও ছিল।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন পদ্ধতি

তক্ষশীলায় শিক্ষাক্রম শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কোনােরকম পরীক্ষা নেওয়া হত না। শুধু তাই নয়, শিক্ষা শেষে কোনাে প্রকার শংসাপত্রও দেওয়া হত না।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ছাত্র

গৌতম বুদ্ধ -এর চিকিৎসক জীবক, পাণিনি, চাণক্য প্রমুখ ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ছাত্র।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা

তক্ষশীলার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হত। আর্থিক সংগতি ও মর্যাদা নির্বিশেষে, সবাইকে নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসারে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হত।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উৎকর্ষ কেন্দ্র

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎকর্ষকেন্দ্র।

  • (১) চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সাত বছর ধরে অধ্যয়ন করত।
  • (২) শল্যচিকিৎসা সম্পর্কে বিশেষভাবে পাঠদান করা হত।
  • (৩) শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের শেষে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হত।
  • (৪) এ ছাড়া সেখানে ভেষজবিদ্যা সম্পর্কেও পঠনপাঠনের ব্যবস্থা ছিল।

উপসংহার :- প্রাচীন ভারতে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে তক্ষশীলা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। সেখানকার উচ্চমানের শিক্ষা, বিশেষত ব্যাবহারিক শিক্ষা আজও শিক্ষাবিদরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

(FAQ) তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তক্ষশীলা কথার অর্থ কী?

ছিন্ন মস্তক ।

২. তক্ষশীলা নগরের প্রতিষ্ঠা করেন কে?

কিংবদন্তিতে রয়েছে, তক্ষ একটি রাজ্য শাসন করতেন যার নাম ছিল তক্ষ খন্ড এবং তিনিই তক্ষশিলা নগরের প্রতিষ্ঠা করেন।

৩. তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম লেখ।

বুদ্ধদেবের চিকিৎসক জীবক, পাণিনি এবং চাণক্য ।

Leave a Comment