স্বরাজ্য দল

স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠার পটভূমি, দেশবন্ধুর উক্তি, সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য, মতিলাল নেহেরুর সমর্থন, প্রো-চেঞ্জার, নো-চেঞ্জার, স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠা, সভাপতি ও সম্পাদক, প্রথম অধিবেশন, চরম লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি, ব্যর্থতা ও অবদান সম্পর্কে জানবো।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ্য দল প্রসঙ্গে স্বরাজ্য দল কি, স্বরাজ্য দলের প্রতিষ্ঠাকাল, স্বরাজ্য দলের সভাপতি, স্বরাজ্য দলের সম্পাদক, স্বরাজ্য দলের প্রথম সভাপতি, স্বরাজ্য দলের প্রথম সম্পাদক, স্বরাজ্য দল কে কবে প্রতিষ্ঠা করেন, স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠার কারণ, স্বরাজ্য দলের উদ্দেশ্য, স্বরাজ্য দলের দুজন নেতা, স্বরাজ্য দলের কর্মসূচি, স্বরাজ্য দলের ব্যর্থতার কারণ ও স্বরাজ্য দলের অবদান।

স্বরাজ্য দল

বিষয়স্বরাজ্য দল
প্রতিষ্ঠাকাল১ জানুয়ারি, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ
প্রতিষ্ঠাতাদেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ
সভাপতিদেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ
সম্পাদকমতিলাল নেহেরু
স্বরাজ্য দল

ভূমিকা :- অসহযোগ আন্দোলন -এর ব্যর্থতা ভারত -এর জাতীয় আন্দোলনে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করে এবং গান্ধীজিসহ দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হন। এরকম এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে নতুন করে একটি দল গঠনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিকে সচল রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই জন্ম নেয় স্বরাজ্য দল।

স্বরাজ্য দল গঠনের পটভূমি

স্বরাজ্য দল আবির্ভাবের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ –

(১) অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ই ফেব্রুয়ারি চৌরিচৌরা ঘটনার পর কারো সঙ্গে আলোচনা না করেই ১২ই ফেব্রুয়ারি গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করেন। ২৫শে ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে।

(২) গান্ধীর জনপ্রিয়তা হ্রাস

অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলে সারা দেশ জুড়ে প্রবল হতাশা দেখা দেয় এবং গান্ধীজির জনপ্রিয়তা প্রভূত হ্রাস পায়। এই সুযোগে সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়।

(৩) শীর্ষস্থানীয় নেতার অভাব

চিজ্ঞজন দাশ, মতিলাল নেহরু এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতারা তখন কারারুদ্ধ থাকায় যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে ঘোরতর অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।

(৪) খিলাফত আন্দোলন বন্ধ

এই সময়েই (অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিঃ) তুরস্ক -এ কামাল পাশার নেতৃত্বে ‘জাতীয়তাবাদী দল’ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং খলিফার রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়। এর ফলে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যায়।

(৫) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

অসহযোগ আন্দোলনকালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বালির বাঁধের মত ভেঙ্গে পড়ে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়।

(৬) কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য

জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতীয় আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েও জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য দেখা দেয়। অসহযোগ আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এই কারণে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে মতবিরোধের জন্য কংগ্রেসের কর্মসূচি সম্পর্কে কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।

(৭) দেশবন্ধুর প্রস্তাব

জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আলিপুর জেলে বন্দি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের বিকল্প এক নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রস্তাব দেন।

স্বরাজ্য দল গঠন সম্পর্কে দেশবন্ধুর বক্তব্য

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বলেন যে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন অনুসারে আইনসভা ও অন্যান্য স্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচন বয়কট না করে সেগুলিতে প্রবেশ করতে হবে। এই সব সংস্থাগুলির সদস্য নির্বাচিত হয়ে, যেখানে সম্ভব সেখানে গঠনমূলক কাজে যোগদান করতে হবে এবং তা সম্ভব না হলে সর্বস্তরে প্রতি পদে পদে সরকারের সকল কাজে বাধা সৃষ্টি করে শাসন সংস্কারকে বিপর্যস্ত করে দিতে হবে।

স্বরাজ্য দল গঠনের পূর্বে সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তব্য

দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ অনুগামী সুভাষচন্দ্র বসু ‘দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থে লিখছেন যে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনসভাগুলি বয়কট করার নীতি ব্যর্থ হয়েছিল। কংগ্রেস আইনসভা বয়কট করায় জাতীয়তাবাদীরা কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নি। কিন্তু নির্বাচনী অভিযানে অংশগ্রহণ করলে দেশবাসীর সামনে নিজেদের বক্তব্য ও নীতিকে তুলে ধরা যাবে।

স্বরাজ্য দল গঠনে মতিলাল নেহরুর সমর্থন

দেশবন্ধুর প্রস্তাব আলিপুর জেলে বন্দি দেশকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের সভানেত্রীরূপে দেশবন্ধু পত্নী বাসন্তী দেবী এই নতুন প্রস্তাবের যৌক্তিকতা ব্যাখা করেন। জুন মাসে কারামুক্ত হয়ে মতিলাল নেহরু এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানান।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রো-চেঞ্জার গোষ্ঠী

মতিলাল নেহরু, হাকিম আজমল খান, বিলতাই প্যাটেল, মালবা, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, কেলকার, জয়াকার, সত্যমূর্তি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই মতের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা গান্ধী-নির্দেশিত কর্মপন্থার পরিবর্তন সাধন করে ভিন্ন পথে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করতে চাইছিলেন বলে তাঁরা প্রো -চেঞ্জার’ বা ‘পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী’ নামে পরিচিত হন।

জাতীয় কংগ্রেসের নো-চেঞ্জার গোষ্ঠী

বল্লভভাই প্যাটেল, বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, ডাঃ আনসারী, কে. আর. আয়েঙ্গার প্রমুখ রক্ষণশীল নেতা নতুন প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করেন এবং গান্ধীর অসহযোগ নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। তাঁরা ‘নো-চেঞ্জার’ বা ‘পরিবর্তন বিরোধী’ নামে পরিচিত হন।

জাতীয় কংগ্রেসের নো-চেঞ্জারদের জয়লাভ

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এক উত্তেজক পরিস্থিতিতে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে গয়ায় জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশন বসে। তিনি আইনসভায় প্রবেশের পক্ষে জোরালো আবেদন জানান। উত্তেজিত বিতর্কের পর চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর নেতৃত্বে ‘পরিবর্তন-বিরোধী’ গোষ্ঠী বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে।

স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠা

চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করেন এবং ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘কংগ্রেস খিলাফৎ স্বরাজ্য দল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ‘স্বরাজ্য দল’ নামে পরিচিত।

স্বরাজ্য দলের সভাপতি ও সম্পাদক

চিত্তরঞ্জন দাশ এই নবগঠিত দলের সভাপতি এবং মতিলাল নেহরু অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন।

স্বরাজ্য দলের প্রথম অধিবেশন

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এলাহাবাদে পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাজ্য দলের প্রথম অধিবেশনে দলের গঠনতন্ত্র ও আন্দোলনের কর্মসূচি রচিত হয়।

স্বরাজ্য দলের চরম লক্ষ্য

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই দলকে “জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরস্থ একটি দল এবং কংগ্রেসের অবিচ্ছেদ্য অংশ” বলে অভিহিত করেন। ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করাই ছিল স্বরাজ্য দলের চরম লক্ষ্য।

স্বরাজ্য দলের উদ্দেশ্য

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ্য দলের সদস্যদের উদ্দেশ্য ছিল –

  • (১) আইনসভায় প্রবেশ করে ভেতর থেকে সুসংবদ্ধ, নিয়মিত ও নিরন্তর বাধা সৃষ্টি করে সরকারকে অকেজো করে দেওয়া,
  • (২) সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করা,
  • (৩) নানাবিধ বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতীয়তাবাদের অগ্রগতিতে সহায়তা করা,
  • (8) সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে বিদেশী শোষণ বন্ধ করা। নতুন দলের মতাদর্শ ও কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র সম্পাদিত ‘বাঙলার কথা’, এ. রঙ্গস্বামী আয়েঙ্গারের ‘স্বদেশমিত্রম’ এবং এন. সি. কেলকারের ‘কেশরী’ পত্রিকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

স্বরাজ্য দলের কর্মসূচি

এই দলের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ছিল –

  • (১) নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভায় যোগদান করে সভার কাজকর্মে অবিরাম বাধাদান করে প্রশাসনিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করা।
  • (২) সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় বাজেট গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করা।
  • (৩) নানা প্রকার বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি ঘটাতে সাহায্য করা।
  • (৪) জাতীয় স্বার্থে নতুন অর্থনীতি রচনা করে বিদেশি অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ করা।
  • (৫) ব্রিটিশ সাম্রাজ্য -এর অন্তর্ভুক্ত থেকে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার লাভ করা প্রভৃতি।

নির্বাচনে স্বরাজ্য দলের সাফল্য

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শাসনসংস্কার অনুসারে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে ‘স্বরাজ্য দল’ মধ্যপ্রদেশ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ ও আসামে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে।

বাংলায় স্বরাজ্য দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা

বাংলায় এই দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার নীতি চালিয়ে যান।

স্বরাজ্য দলের তরুণ প্রার্থীর জয়লাভ

এই দলের তরুণ প্রার্থী বিধানচন্দ্র রায় ব্যারাকপুর কেন্দ্রে ‘লিবারাল ফেডারেশন’ দলের প্রার্থী সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন প্রবীণ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।

কেন্দ্রীয় আইনসভায় স্বরাজ্য দলের সাফল্য

কেন্দ্রীয় আইনসভার ১০১টি আসনের মধ্যে ‘স্বরাজ্য দল ৪০টি আসনে জয়লাভ করে। এই দলের মতিলাল নেহরু বিরোধী দলনেতার পদ লাভ করেন।

সরকারের বিরুদ্ধে স্বরাজ্য দলের সংগ্রাম

নরমপন্থী ও জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁরা জাতীয়তাবাদী দল গঠন করে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে থাকেন।

স্বরাজ্য দলের সদস্যদের বিভিন্ন পদ অর্জন

বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থাগুলির নির্বাচনেও এই দল ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে।

  • (১) ১৯২৫ সালের মার্চ মাসে বিঠলভাই প্যাটেল কেন্দ্রীয় আইনসভার সভাপতি বা স্পিকার নির্বাচিত হন।  
  • (২) চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।
  • (৩) এ ছাড়া বিঠলভাই প্যাটেল বোম্বাই, বল্লভভাই প্যাটেল আমেদাবাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ পাটনা এবং জওহরলাল নেহরু এলাহাবাদ পুরসভার প্রধান নির্বাচিত হন।

স্বরাজ্য দলের বাধাদানের নীতি

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে স্বরাজ্য দল সরকারি নীতি ও কার্যকলাপে বাধা দানের নীতি গ্রহণ করে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাজ্য দল ভারতে দায়িত্বশীল কার্যকলাপ সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আইনসভায় একটি প্রস্তাব পাশ করাতে সক্ষম হয়।

স্বরাজ্য দল কর্তৃক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের দাবী

ভারতের সংবিধান তৈরির জন্য মতিলাল নেহরু ভারতীয় জননেতাদের নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের দাবি জানালে তা গৃহীত হয়।

স্বরাজ্য দলের অর্থবিল পাসে ব্যর্থতায় স্বরাজ্য দলের ভূমিকা

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ্য দলের বিরোধিতার ফলে সরকার পর পর তিন বছর (১৯২৪-২৫, ১৯২৫ ২৬ এবং ১৯২৬-২৭ খ্রিঃ) কেন্দ্রীয় আইনসভায় বাজেট ও অর্থবিল পাশ করাতে ব্যর্থ হয় এবং গভর্নর জেনারেলের ‘বিশেষ ক্ষমতা’ বলে তা মঞ্জুর করাতে বাধ্য হয়।

স্বরাজ্য দলের দাবি পেশ

এই দল সরকারের কাছে বন্দিমুক্তি, দমনমূলক আইন প্রত্যাহার, শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি, ভারতীয় শিল্পের সংরক্ষণ, রেল ভাড়া ও লবণ কর হ্রাস এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের দাবি পেশ করে।

স্বরাজ্য দল কর্তৃক আইন সভার কক্ষ ত্যাগ

এই দল সরকারি অনুষ্ঠান ও অভ্যর্থনা সভা বর্জন এবং সরকারি নীতির প্রতিবাদে মাঝে মাঝেই আইনসভার কক্ষ ত্যাগ করার নজির স্থাপন করে।

বেঙ্গল প্যাক্ট গঠনে স্বরাজ্য দলের ভূমিকা

বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতেও স্বরাজ্য দল সক্রিয় বিরোধিতার নীতি গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে বাংলা খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উদ্দেশ্যে তিনি ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বা ‘বাংলা চুক্তি’ (১৯২৩ খ্রিঃ) গড়ে তোলেন।

স্বরাজ্য দলের ব্যর্থতার কারণ

প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত স্বরাজ্য দল ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার মূলে নানা কারণ ছিল। যেমন –

(১) দেশবন্ধুর মৃত্যু

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর ফলে স্বরাজ্য দলের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। স্বরাজ্য দল তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকে আবার কংগ্রেসে ফিরে যান।

(২) গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব

দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর নেতৃত্বের প্রশ্নে বাংলায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমল বনাম যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বনাম সুভাষচন্দ্র বসু এবং উত্তর প্রদেশে মতিলাল নেহরু বনাম মদনমোহন মালব্যের বিবাদ এই দলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।

(৩) সরকারী নীতি গ্ৰহণ

মতিলাল নেহরু ও তাঁর অনুগামীরা সরকারি কাজে বাধাদানের নীতি অব্যাহত রাখতে চাইলেও এস.বি.তাম্বে, কেলকার, জয়াকার, মুঞ্জে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সব দলের নীতির প্রশ্নে বিবাদ ব্যাপারে সরকারের বিরোধিতা না করে জনকল্যাণমূলক ব্যাপারে সরকারের প্রতি গঠনমূলক সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন।

(৪) সহযোগিতাবাদী দল গঠন

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের কানপুর অধিবেশনে স্বরাজ্য দলের আইনসভার সদস্যদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয় যে একমাত্র সরকারি বিলের বিরোধিতা করা ছাড়া অন্য কোন ব্যাপারে তাঁরা যেন আইনসভার কোন অধিবেশনে যোগদান না করেন এবং তাঁরা যেন কোন সরকারি কমিটির সদস্যও না হন। এই নির্দেশ অমান্য করে কেলকার ও জয়াকার ‘সহযোগিতাবাদী দল’ গঠন করেন।

(৫) বেঙ্গল প্যাক্ট লুপ্ত

চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁর ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ ধূলায় লুণ্ঠিত হয়। দেশের নানা স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। স্বরাজীদের অনেকেই এই সব দাঙ্গায় জড়িয়ে হিন্দু-মুসলিম বিবাদ জড়িয়ে পড়েন।

(৬) হিন্দু মহাসভায় যোগ

মদনমোহন মালব্য ও লালা লাজপৎ রায় ‘হিন্দু মহাসভা’-র সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, যা ছিল স্বরাজ্য দলের সাফল্যের অন্যতম প্রধান ভিত্তি, তা বিনষ্ট হয়।

(৭) গভর্নর জেনারেলের বিশেষ ক্ষমতার প্রভাব

স্বরাজ্য দলের উদ্দেশ্য ছিল নিরন্তর সরকারি কাজে বাধাদান করে স্বরাজ্য দলের নীতির শাসনব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া। এতে কিন্তু সরকারের অসারতা বিশেষ অসুবিধা হয় নি, কারণ গভর্নর ও গভর্নর জেনারেল বিশেষ ক্ষমতা বলে বাজেট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইন পাশ করিয়ে নিতেন।

(৮) কৃষক-শ্রমিকরা বঞ্চিত

শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই দলের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই দল ভাগচাষি বা দরিদ্র কৃষকের ঋণ মকুবের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করে নি। আসলে এই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা এই দলের ছিল না বরং জমিদার কৃষক লড়াইয়ে তারা জমিদারের পক্ষ অবলম্বন করে। মানবেন্দ্রনাথ রায় এই দলকে ‘পুঁজিপতি ও জমিদারদের রক্ষাকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৯) জনগণের আগ্রহের অভাব

এই দলের কর্মসূচি জনমনে বিশেষ সাড়া জাগাতে পারে নি। বরং গান্ধীজির গ্রাম সংগঠন, হরিজন উন্নয়ন, মাদক-বর্জন ও অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের কর্মসূচি অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল।

(১০) বিত্তবানের দল

বিশিষ্ট মার্কসবাদী লেখক রজনী পাম দত্ত বলেন যে, এই দল বিত্তবান শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করত এবং এই কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তারা আপোষ করে চলত। তাঁর মতে গণ-সংযোগ ও গণ-সমর্থনের অভাবে এই দল ব্যর্থ হয়।

স্বরাজ্য দল সম্পর্কে নেহরুর বক্তব্য

জওহরলাল নেহরু বলেন যে, কালক্রমে স্বরাজীদের অনেকেই বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও প্রলোভনের শিকার হন এবং তাঁদের নৈতিক মান ও শৃঙ্খলাবোধের অবনতি ঘটে।

স্বরাজ্য দল সম্পর্কে রজনী পামের উক্তি

মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনী পাম দত্ত বলেন যে, গান্ধীজির আন্দোলন বিমুখতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাজ্য দলের কর্মসূচি ছিল এক অগ্রবর্তী ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ।

স্বরাজ্য দলের অবদান

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও জাতীয় জীবনে স্বরাজ্য দলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

(১) জাতীয় জীবনকে গতি প্রদান

অসহযোগ আন্দোলনের শোচনীয় ব্যর্থতার পর জাতীয় জীবন যখন গভীর অবসাদ ও হতাশায় নিমজ্জিত তখন স্বরাজ্য দলের প্রতিষ্ঠা ও কার্যকলাপ জাতীয় জীবনকে প্রাণচঞ্চল ও গতিশীল করে তোলে।

(২) জাতীয় আইন সভার রূপ ধারণ

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, স্বরাজীদের অংশগ্রহণের পর আইনসভা সর্বপ্রথম প্রকৃত জাতীয় আইনসভার রূপ পরিগ্রহ করে। এই আইনসভায় স্বরাজীরা জাতীয় আশা-আকাঙ্খা তুলে ধরতেন এবং তাঁদের উদ্যোগেই বিশ্ববাসীর সামনে সরকারের নগ্ন ও স্বৈরাচারী চরিত্র পরিস্ফুট হতে থাকে।

(৩) মূল্যবান রাজনৈতিক শিক্ষা

সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কোন সুবিধা আদায় করতে না পারলেও, শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে কিভাবে সরকারের বিরোধিতা করা যায় স্বরাজীরা তাঁর গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী পক্ষের সম্মুখে ছিল এক মূল্যবান রাজনৈতিক শিক্ষা।

(৪) জাতীয় শিল্পোন্নয়ন

স্বরাজীরা কংগ্রেসের গঠনমূলক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেন, বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেন এবং জাতীয় শিল্পোন্নয়ন ও ভারী শিল্পের বিস্তারে উদ্যোগী হন।

(৫) সাইমন কমিশন নিয়োগ

তাঁদের উদ্যোগেই সরকার ভারতে সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের শাসন-সংস্কার পর্যালোচনার জন্য ‘সাইমন কমিশন‘ নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়।

উপসংহার :- স্বরাজ্য দলের নিরন্তন বিরোধিতার জন্যই ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের কার্যকারিতা অনুসন্ধানের জন্য সাইমন কমিশন গঠনে বাধ্য হয়েছিল।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “স্বরাজ্য দল” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) স্বরাজ্য দল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কে, কবে, কেন স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠা করেন?

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১ লা জানুয়ারি চিওরঞ্জন দাশ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও সরকারি শাসন সম্পর্কে অবহিত করার জন্য স্বরাজ্য দল প্রতিষ্ঠা করেন।

২. স্বরাজ্য দলের দুজন নেতার নাম লেখ।

চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু।

৩. স্বরাজ্য দলের প্রথম সভাপতি কে ছিলেন?

চিত্তরঞ্জন দাশ।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment