স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী -র জন্ম, পিতামাতা, শিক্ষা, শিষ্যত্ব গ্রহণ, বিতর্কের আয়োজন, কলকাতা আগমন, প্রার্থনা সমাজের সাথে পরিচয়, আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা, দয়ানন্দের আদর্শ, বৈদিক ভিত্তি, কুসংস্কারের বিরোধিতা, শুদ্ধি আন্দোলন, শিক্ষা বিস্তারে উদ্দোগ, সমাজসেবা, জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা, দয়ানন্দের মতাদর্শ ব্যবহার ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

সমাজ সংস্কারক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

ঐতিহাসিক চরিত্রস্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
জন্ম১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ
পিতামাতাকর্ষণজী লাল তিওয়ারী ও যশোদাবাই
পরিচিতিধর্ম ও সমাজ সংস্কারক
অবদানআর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা
মৃত্যু৩০ অক্টোবর, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

ভূমিকা :- হিন্দুধর্মের সংস্কারের উদ্দেশ্যে উনবিংশ শতকে ভারত -এর বিভিন্ন প্রান্তে যেসব সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত’আর্যসমাজ’-এর পরিচালিত আন্দোলন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর জন্ম

দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮২৪ সালের১২ ফেব্রুয়ারি কাথিয়াবাড় অঞ্চলে একটি সভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জন্ম স্থান বর্তমানে গুজরাতের মৌর ভীজেলা।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর পিতামাতা

তার পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘মূলশঙ্কর তিওয়ারী’। তার পিতাকর্ষণজী লাল তিওয়ারী ছিলেন সরকারের রেভিনিউ কালেক্টর। তার মায়ের নাম যশোদাবাই।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর শিক্ষা

ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি সংস্কৃতশাস্ত্র উত্তমরূপে আয়ত্ত্ব করেন এবং সামবেদী ব্রহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে সমগ্র যজুর্বেদ ও আংশিকভাবে অপর তিন বেদ (ঋগ্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ), সংস্কৃত ব্যাকরণ, তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র, কাব্য, অলংকার, স্মৃতি প্রভৃতিতে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর শিষ্যত্ব গ্ৰহণ

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মথুরায় তিনি গুরু বিরজানন্দ দণ্ডিশের শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর বিতর্কে জয়লাভ

১৮৬৯ সালে ১৭ই নভেম্বর বারাণসীকাশীতে অবস্থান কালে ২৭ জন বিদ্যান এবং ১২ জন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের সাথে তার বিতর্কের আয়োজন হয়। এই বিতর্কে তিনি জয়লাভ করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কলকাতা আগমন

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মত প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতা আসেন। তখন কেশবচন্দ্র সেনের আমন্ত্রনে তিনি সংস্কৃত এবং হিন্দিতে ব্যাখ্যান শুরু করেন। কলকাতায় বেদ-পাঠশালা স্থাপনের জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এর পর ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই এপ্রিল তিনি কলকাতা থেকে প্রস্থান করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রার্থনা সমাজের সাথে পরিচয়

বোম্বাইয়ে অবস্থান কালে প্রার্থনা সমাজ -এর সাথে দয়ানন্দের পরিচয় হয়।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা

ব্রাহ্ম, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের আক্রমণ প্রতিরোধ এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্দেশ্যে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইতে আর্যসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

আর্যসমাজের প্রভাব বিস্তার

তাঁর প্রচারের ফলে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট সহ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আর্যসমাজের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।

ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজ

ব্রাহ্ম সমাজ -এর অনেক অনুসারীই সেসময় আর্য সমাজে যোগ দান করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শ

সত্যার্থ প্রকাশ’ ও ‘বেদভাষা’ নামক হিন্দি গ্রন্থে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রকাশিত হয়েছে।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আদর্শের বৈদিক ভিত্তি

দয়ানন্দ সরস্বতীর সকল ধর্মীয় আদর্শ ও চিন্তাধারার মূলভিত্তি ছিল বেদ। বৈদিক সভ্যতার গৌরব ও পবিত্রতায় হিন্দুধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কুসংস্কারের বিরোধিতা

স্বামী দয়ানন্দ ছিলেন গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদ-বিরোধী এবং একেশ্বরবাদের সমর্থক। তিনি ছিলেন নারীস্বাধীনতা, স্ত্রীশিক্ষা, নারীপুরুষের সমানাধিকার, বিধবাবিবাহ, সমুদ্রযাত্রা ও সংস্কৃত ভাষার উৎসাহী সমর্থক। তিনি বৈদিক শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে সমন্বয় চেয়েছিলেন।

আর্যসমাজের প্রধান কেন্দ্র বোম্বাই

স্বামী দয়ানন্দ পরবর্তীকালে বোম্বাইতে আর্যসমাজের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং তাঁর অনুগামীদের নিয়ে সংস্কার কার্য পরিচালনা করতে থাকেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর শুদ্ধি আন্দোলন

স্বামী দয়ানন্দ শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মত্যাগী হিন্দুদের এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরে আনতে সচেষ্ট ছিলেন। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষত পাঞ্জাবে তাঁর ভাবধারা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক শিক্ষাপ্রসারে উদ্যোগ

শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে আর্যসমাজের উদ্যোগে গুরুকুল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে লাল হংসরাজ লাহোরে দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হরিহারে ‘গুরুকুল আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন বৈদিক রীতিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

আর্যসমাজের নেতৃত্বে সমাজ সেবা

আর্যসমাজ অনাথ আশ্রম, বিধবাদের আশ্রয়দানের জন্য আশ্রম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধে ত্রাণকার্যের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা

দয়ানন্দের নেতৃত্বে আর্যসমাজ জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সরব হয় এবং এর বিরুদ্ধে প্রচারকার্য চালায়।

আর্যসমাজের বিভিন্ন নেতৃত্ব

স্বামী দয়ানন্দের মৃত্যুর (১৮৮০ খ্রি.) পর তাঁর অনুগামী লালা হংসরাজ, পণ্ডিত গুরু দত্ত, লালা লাজপত রায়, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (লালা মুনশী রাম) এই আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মতাদর্শ ব্যবহার

তার মতাদর্শ এবং লেখনি বিভিন্ন লেখক ব্যবহার করেছেন। এদের মধ্যে শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মা সহ সুভাষ চন্দ্র বসু, লালা লাজপত রায়, মাদাম কামা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, লালা হরদয়াল, মদনলাল ধিংড়া, রাম প্রসাদ বিসমিল, মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, এস সত্য মূর্তি প্রমুখ।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রশংসক

স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, বিপিন চন্দ্র পাল, বল্লভভাই প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং রোমা রোলাঁ স্বামী দয়ানন্দকে অসাধারণ ও অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যু

১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর দীপাবলির সন্ধ্যায় মন্ত্র জপ করতে করতে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মৃত্যুবরণ করেন।

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অবদান

ভারতীয় জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –

  • (১) হিন্দুদের হীনম্মন্যতা দূর হয়।
  • (২) বৈদিক হিন্দুধর্ম তার হৃতগৌরব ফিরে পায়।
  • (৩) হিন্দু জনসাধারণ নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
  • (৪) হিন্দু সমাজে বিভিন্ন জাতপাতের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে।আর্যসমাজের উদ্যোগেই হিন্দুধর্ম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। 
  • (৫) ড. অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন যে, ভারতের চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশে স্বামী দয়ানন্দ ও আর্যসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

উপসংহার :- আর্যসমাজের আন্দোলন ছিল গণমুখী। স্বামী দয়ানন্দই সর্বপ্রথম জনসাধারণকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠী ভারতে চরমপ রাজনীতির বিকাশে স্বামীদয়ানন্দ ও আর্যসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।

(FAQ) স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সত্যার্থ প্রকাশ গ্ৰন্থ টি কার লেখা?

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী।

২. কে কবে আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন?

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে।

৩. শুদ্ধি আন্দোলন কে শুরু করেন?

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী।

Leave a Comment