সুফীবাদ

সুফীবাদ প্রসঙ্গে উপাদান, ধর্ম বিশ্বাসী লোকের উপস্থিতি, আল্লাহর সাধনায় মগ্ন, গোঁড়া মুসলিম গুরুদের ক্ষোভ, সুফী ধর্মবিদদের বক্তব্য, আল্লাহর কৃপা লাভের পন্থা, বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব, সুফীবাদের মূল শিকড়, সুফী কথার অর্থ, ইসলামীয় মতবাদের সঙ্গে পার্থক্য ও সুফীবাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানবো।

সুফীবাদ

ঐতিহাসিক ঘটনাসুফীবাদ
সাফাপবিত্রতা
সুফপশমের কম্বল
গুরুপীর বা মুর্শিদ
খানকাআশ্রম
সুফীবাদ

ভূমিকা :- গবেষক আরবারীর (Arberry) মতে, “সুফীবাদ বলতে ধর্মপ্রাণ মুসলিমের বাক্তিগত অনুভূতির মাধ্যমে আল্লাহের জীবন্ত সান্নিধ্যকে উপলব্ধি বুঝায় (Sufism is an attempt of individual Muslims to realise in their personal experience of living presence of Allah)।

সুফীবাদ সম্পর্কে উপাদান

আবুল-কাশিম আল বুখারির রচনা ‘রিশালা’ (১০৭৪ খ্রি) থেকে আমরা সুফী মতবাদের অগ্রগতি ও পুষ্টির কথা জানতে পারি।

সুফীবাদে ধর্ম বিশ্বাসী লোকের উপস্থিতি

ইসলাম ধর্মের যখন অভ্যুদয় হয় তখন থেকেই ইসলামে এক শ্রেণীর অতীন্দ্রিয়বাদী, রহস্যবাদী ধর্মবিশ্বাসী লোক ছিলেন। ইসলামের প্রথম দিকেই এই রহস্যবাদী ও অতীন্দ্রিয়বাদী সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়।

আল্লাহর সাধনায় মগ্ন সুফীবাদ

ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর শাসকশ্রেণীর একাংশের মধ্যে যে স্থূল ঐশ্বর্যের আড়ম্বর ও নৈতিক অবনতি ঘটে, তা এই ভাববাদীদের মনে আঘাত করে। এজন্য তারা ঐশ্বর্য, আড়ম্বর, ধন-সম্পদের প্রতি গভীর নিরাসক্তি নিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহের সাধনাতেই মগ্ন থাকেন।

দুই সুফী সন্ত

এই ভাববাদীদের মধ্যে ছিলেন বসরার নারী সাধিকা সুফী রাবেয়া (অষ্টম শতক) এবং মনসুর বিন হল্লাজ (দশম শতক)। এঁরা বলেন প্রেম ও ভক্তিই হল ঈশ্বর ও মানুষের মিলনের সেতু।

সুফীধর্মবিদদের বক্তব্য

মুসলিমরা এই মরমীয়াবাদীদের মতামতকে মেনে নেন নি। সুফীধর্মবিদরা বলেন যে, ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্ট বিশ্ব পৃথিবী, মানুষ সবই এক; এগুলি হল ঈশ্বরের অভিব্যক্তি।

সুফীবাদের বিরুদ্ধে গোঁড়া মুসলিম গুরুদের ক্ষোভ

গোঁড়া মুসলিম গুরুরা এতে চটে যান। তারা বলেন যে, সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তাকে এক করে দেখলে সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাহের মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ করা হয়। তাদের কোপে মনসুর হাল্লাজের প্রাণদণ্ড হয়। এত করেও সুফী মতবাদকে দমিয়ে রাখা যায় নি।

সুফীবাদে আল্লাহর কৃপা লাভের পন্থা

সুফীরা কোরাণের মর্মবাণীকে উপলব্ধির ওপর জোর দেন। তাঁরা বলেন কেবলমাত্র বাহ্যিক ইসলামীয় আচার পালন দ্বারা আল্লাহের কৃপালাভ সম্ভব নয়। নিজ মানসিকতা ও জীবনধারাকে আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্র করলে তবেই তাতে আল্লাহের আসন পাতা সম্ভব হবে বলে তাঁরা বলেন।

ইসলামীয় দার্শনিক আল গাজ্জালি

  • (১) দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইসলামীয় দার্শনিক আল-গাজ্জালির ব্যাখ্যাগুলি সুফীবাদকে শক্তিশালী করে। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার প্রধান উলেমার পদ ছেড়ে সুফী মতবাদ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার যুক্তিবিচার দ্বারা সুফী মতবাদকে ইসলামের একটি মূল শাখারূপে প্রতিষ্ঠা করেন।
  • (২) কোরান শরীফকে তিনি সুফীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ রূপে প্রমাণ করেন। সুফী অতীন্দ্রিয়বাদ যে ইসলাম সম্মত তাও তিনি বলেন। তিনি ইসলামীয় মতবাদ ও সুফীবাদের সমন্বয় ঘটান। এইভাবে আরব দেশে সুফীবাদের বিকাশ হয়।

সুফীবাদের উপর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব

  • (১) কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, সুফীবাদের উদ্ভবের পশ্চাতে বৌদ্ধ ধর্ম-এর প্রভাব ছিল। সুফীদের আশ্রম জীবন (খানকা), ত্যাগবাদ ও যোগসাধনা বৌদ্ধধর্ম থেকে গ্রহণ করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।
  • (২) ইসলামের আবির্ভাবের আগে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের মতামতের প্রসার ছিল। হিন্দু যোগীরাও পশ্চিম এশিয়াতে যেতেন। ‘অমৃত কুণ্ড’ নামে এক হিন্দুযোগ সাধনার গ্রন্থ ফার্সীতে অনূদিত হয়।
  • (৩) এর থেকে বৌদ্ধ ও হিন্দু প্রভাব সুফীবাদে পড়েছিল বলে মনে করা হয়। এই মত কত দূর সত্য তা বলা মুস্কিল। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুফীবাদের সঙ্গে হিন্দু অতীন্দ্রিয়বাদ ও বৌদ্ধধর্মের ধ্যান-ধারণার কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়।

সুফীবাদের মূল শিকড়

যাই হোক সুফীবাদ ইসলামের হৃদয় থেকেই উদ্ভূত হয়, এই মত যথেষ্ট প্রমাণসহ। ইয়ুসুফ হুসেন এজন্য বলেছেন যে, “সুফীবাদ ইসলামের সন্তান। ইসলামের অন্তর থেকেই সুফীবাদের উদ্ভব হয়।” (Sufism is as old as Islam. It was born in the bosom of Islam.)

সুফী কথার অর্থ

  • (১) সুফী কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিভিন্নভাবে করা হয়, যথা – (১) সাফা অথবা পবিত্রতা কথাটি থেকে সুফী কথাটি এসেছে। যেহেতু সুফীরা মন, আচরণ ও দেহের পবিত্রতা রক্ষার ওপর জোর দেন, সেহেতু তাদের সুফী বলা হয়।
  • (২) সাফ বা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান লোকের শীর্ষ কথাটি থেকে সুফী কথাটি এসেছে। আল্লাহের কাছে উপনীত হওয়ার জন্য তাঁর ভক্তমণ্ডলীর শীর্ষে আছেন সুফীরা। এজন্যই তাঁরা সাফ বা সুফী।
  • (৩) সুফা অর্থাৎ পয়গম্বর হজরত মহম্মদ-এর সহকারীরা আসাব-আল-সুফ ছিলেন তাদের পবিত্রতাময় জীবনধারার জন্য। তাদের আদর্শ যারা অনুসরণ করেন তাঁরা সুফী।
  • (৪) সুফ বা পশমের কম্বল কথাটি থেকে সুফী কথাটি এসেছে। যেহেতু আদি যুগের সুফীরা একটি পশমের চাদর বা কম্বলে দেহ আচ্ছাদন করতেন, এজন্য তাঁদের সুফী বলা হত।

সুফীবাদ সম্পর্কে আনসারির মন্তব্য

জ্যাকেরিয়া আনসারি তাঁর শেখ-আল-ইসলাম গ্রন্থে বলেছেন যে, “সুফী কথাটির উৎপত্তি যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, সুফীবাদের আসল কথা হল চিত্তের পবিত্রতা, নৈতিক শুদ্ধতা দ্বারা অন্তর্লোককে আল্লাহের উপযুক্ত আসনে পরিণত করা।

ইসলামীয় মতবাদের সঙ্গে সুফীবাদের পার্থক্য

সুফীবাদের সঙ্গে গোঁড়া ইসলামীয় মতবাদের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। যেমন –

  • (ক) গোঁড়া ইসলামীরা বাহ্যিক আচরণবিধি পালনের ওপর বিশেষ জোর দেন, যথা নমাজ পাঠ, রমজানের উপবাস পালন, হজ যাত্রা প্রভৃতি। সুফীরা এই সকল বাহ্যিক আচরণবিধিকে গুরুত্ব দেন না। সুফীরা কোরানের মর্মবাণীকেই গ্রহণ করেন।
  • (খ) গোঁড়া মুসলিমরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, ত্রাণকর্তা মনে করেন। তার সৃষ্ট মানুষ তার কাছে আত্মসমর্পণ দ্বারা মুক্তি পেলেও, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ থেকে সৃষ্ট মানুষকে তারা পৃথক ভাবেন। সুফীরা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহের সৃষ্টি তারই প্রকাশ। তাঁর সৃষ্ট পৃথিবী ও তিনি মূলত এক।
  • (গ) সুফীরা পীর বা মুর্শিদ গুরুর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। গুরু বা পীরই ভক্তকে ভগবানের প্রেম লাভের পথ দেখান। গোড়া মুসলিমরা পীর বা গুরুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না।
  • (ঘ) সুফীরা কৃষ্ণসাধক, নাম-গান, যোগসাধনা, বৈরাগ্য প্রভৃতিকে আল্লাহের কৃপা লাভের পথ এবং নৈতিক পবিত্রতার সোপান বলে মনে করেন। গোঁড়া মুসলিমরা এসবের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন না।
  • (ঙ) সুফীরা ‘খানকা’, অর্থাৎ আশ্রমজীবনকে গ্রহণ করেন। পীর বা মুর্শিদ এই খানকায় সুফী ভক্তগণ সহ বাস করতেন। তারা এখানেই শাস্ত্র আলোচনা ও ‘সাম’ অর্থাৎ উচ্চস্বরে ঈশ্বরের নামগান করতেন। ডঃ রিজাভির মতে, খানকাগুলিকে কেন্দ্র করেই সুফী ধর্ম আবর্তিত হয়।

সুফীবাদের বৈশিষ্ট্য

সুফী মতবাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন –

(১) সুফীবাদে ব্যক্তির নিজের কোনো লক্ষ্য বা ইচ্ছা নেই। প্রকৃত সুফী আল্লাহের নির্দেশেই চলেন। তার কাছে পৃথিবীর সব কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি। জগৎ ঈশ্বরময়।

(২) সুফীরা বৈরাগ্যময়, ত্যাগপূর্ণ সন্ন্যাসজীবনকে বেছে নেন। সরল, অনাড়ম্বর জীবন-যাপন সুফীবাদের অঙ্গ।

(৩) তারা আল্লাহকে কঠোর, ভীতিপ্রদ বিচারক ও শাস্তিদাতা রূপে দেখেন না। তাদের মতে, আল্লাহের কাছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনি হলেন প্রেমময়, ক্ষমাসুন্দর। এজন্য তারা আল্লাহের সৃষ্ট সকল কিছুকেই ভালবাসতে বলেন।

(৪) সুফীরা এক মুহুর্তের জন্যও ঈশ্বরের কথা বিস্তৃত হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন। ঈশ্বরের নামগান করে তারা সঙ্গীত ও নৃত্য করেন। এই প্রথাকে তারা ‘সাম’ বলেন।

(৫) সুফীবাদে গুরু বা পীর সব। নিরাকার ঈশ্বরের ধ্যান-ধারণার সন্ধান গুরুরাই ভক্তকে দিতে পারেন। ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তি গুরুই শিষ্যকে শেখাতে পারেন।

(৬) সুফীরা আধ্যাত্মিক পবিত্র জীবনবোধের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেন।

(৭) কোনো কোনো গুরুর মতে ভক্ত দশটি সাধনার স্তর পার হলে তবে সে ঈশ্বরের প্রেম লাভ করতে পারে। এই স্তরগুলি হল –

  • (ক) তওবা বা প্রায়শ্চিত্ত বা অনুশোচনা,
  • (খ) ওয়ারা বা নিবৃত্তি অর্থাৎ তৃষ্ণা বা লোভকে দমন,
  • (গ) ফকর বা দারিদ্রকে আনন্দের সঙ্গে বরণ,
  • (ঘ) সরব বা সহনশীলতা প্রদর্শন,
  • (ঙ) শুকর বা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন,
  • (চ) খুফ বা ভীতি অর্থাৎ পাপকে ভয় করা,
  • (ছ) রজা বা আশা অর্থাৎ ঈশ্বরের করুণা লাভের জন্য আশা পালন,
  • (জ) তওয়াক্কুল বা সন্তোষ, সুখ, দুঃখ সকল কিছুকে সন্তুষ্টভাবে গ্রহণ,
  • (ঝ) রিজা অর্থাৎ ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ,
  • (ঞ) জুহদ বা নৈতিক নিয়মবিধি পালন।

উপসংহার :- সুফীরা ধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেন এবং অমুসলিমদেরও খানাকায় ধর্মোপদেশ শ্রবণে উৎসাহ দেন। তারা ছিলেন শান্তিবাদী ভাববাদী লোক।

(FAQ) সুফীবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুফীবাদে সাফা কথার অর্থ কি?

পবিত্রতা।

২. সুফীবাদে গুরুকে কি বলা হয়?

পীর বা মুর্শিদ।

৩. সুফীদের আশ্রম জীবনকে কি বলা হয়?

খানকা।

৪. সুফীদের উচ্চস্বরে নামগানকে কি বলা হয়?

সাম।

Leave a Comment