সমাজতন্ত্রবাদ

সমাজতন্ত্রবাদ প্রসঙ্গে সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য, প্রাচীনত্ব হিসেবে মোজেস ও যিশু খ্রিস্টের বাণীতে, টমাস মোরের গ্ৰন্থে, ফরাসি দার্শনিকদের রচনায়, ফরাসি বিপ্লবের সময়, আধুনিক যুগে সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভবের কারণ, মূল নীতি হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার, কর্মসংস্থান, সঞ্চিত সম্পদের পুনর্বণ্টন ও উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানবো।

সমাজতন্ত্রবাদ

ঐতিহাসিক ঘটনাসমাজতন্ত্রবাদ
বৈশিষ্ট্যবিশেষ মতবাদ
সময়কালউনিশ শতক
স্থানইউরোপ
উদ্দেশ্যসাম্য প্রতিষ্ঠা
রিপাবলিকপ্লেটো
সমাজতন্ত্রবাদ

ভূমিকা:- গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মতো সমাজতন্ত্রবাদও উনিশ শতকের একটি অতি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক, দার্শনিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ।

সমাজতন্ত্রবাদের সংজ্ঞা

এর কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা করেছেন এবং এক একজন এর বিভিন্ন দিকের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে যে, ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও আয়-বণ্টন ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রবাদ বলে।

সমাজতন্ত্রবাদের উদ্দেশ্য

এর মূল উদ্দেশ্য হল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা। সমাজতন্ত্রবাদীরা মনে করেন যে, সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা বা রাজনৈতিক অধিকার লাভই যথেষ্ট নয় – এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা। এক কথায়, সমাজের সর্বশ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্র জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনই হল এর উদ্দেশ্য।

প্রাচীনত্ব

সমাজতন্ত্রবাদের ধারণা একেবারে নতুন নয়, সুপ্রাচীন অতীত থেকেই সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য দূর করার চেষ্টা চলে আসছে। যেমন –

(১) মোজেস ও যিশু খ্রিস্টের বাণীতে

অনেকে মোজেস ও যিশু খ্রিস্টের বাণীতে সমাজতন্ত্রবাদের ইঙ্গিত লক্ষ্য করেছেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আর্থিক সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে।

(২) টমাস মোরের গ্ৰন্থে

ষোড়শ শতকে ইংরেজ দার্শনিক স্যার টমাস মোর তাঁর ‘ইউটোপিয়া’ গ্রন্থে এমন এক কাল্পনিক সমাজের চিত্র অঙ্কন করেন, যেখানে কারও কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না, কিন্তু সকলেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে।

(৩) ফরাসি দার্শনিকদের রচনায়

সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ড -এর ডিগার আন্দোলনের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায়। ফরাসি দার্শনিক রুশো, মাবলি এবং মোর্লের রচনাতে আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়।

(৪) ফরাসি বিপ্লবের সময়

ফরাসি বিপ্লব কালে ফ্রান্স -এ ব্রিসো, হিবার্টপন্থী ও জোকোবিনরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

আধুনিক যুগে উদ্ভবের কারণ

  • (১) আধুনিক যুগে শিল্প বিপ্লব-জনিত কারখানা প্রথার ত্রুটি দূর করার জন্যই সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশে দেশে জাতীয় সম্পদ প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং এই সম্পদ মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
  • (২) যাদের শ্রমে এই সম্পদের সৃষ্টি, সেই শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। এর ফলে পুঁজিপতি ও শ্রমিক বা শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্যই উদ্ভব হয় সমাজতন্ত্রবাদের।
  • (৩) তাই বলা যায় যে, সমাজতন্ত্রবাদ হল ধনতন্ত্রবাদ বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দরিদ্র শ্রেণির প্রতিবাদ বা মালিক শ্রেণি কর্তৃক শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

সমাজতন্ত্রবাদের মূলনীতি

সমাজতন্ত্রের কয়েকটি মূল নীতি উল্লেখ করা যায়। যেমন –

(১) প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার

প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ ভূমি, জল, অরণ্য প্রভৃতির উপর সবার সমান অধিকার আছে। এগুলির উপর কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকতে পারে না, কারণ এগুলি কারো ব্যক্তিগত পরিশ্রমের দ্বারা সৃষ্ট হয় নি। কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি এই প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার দাবি করে, তবে তা অন্যায় ও অযৌক্তিক।

(২) কর্মসংস্থান

প্রত্যেক নাগরিকেরই জীবিকার অধিকার আছে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান করা।

(৩) সঞ্চিত সম্পদের পুনর্বণ্টন

পুঁজিবাদী সমাজে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ জমা হয় এবং অন্যেরা থাকে বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্ত। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল সঞ্চিত সম্পদের পুনর্বণ্টন করা।

(৪) উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ

সমাজতন্ত্রে উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা ব্যক্তি মালিকানার কোনও স্থান নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগের অর্থই হল মুনাফাভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং শোষণ। উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকলে পুঁজিবাদ লোপ পায়।

উপসংহার:- সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য হল শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। নাগরিকদের শ্রম দ্বারা উৎপন্ন সম্পদ রাষ্ট্রের অধিকারে আসবে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল শ্রমিকের রাষ্ট্র। শ্রমিকের স্বার্থরক্ষাই এই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এইভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হবে।

(FAQ) সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সমাজতন্ত্রবাদ কাকে বলে?

ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও আয়-বণ্টন ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রবাদ বলে।

২. সমাজতন্ত্রবাদের উদ্দেশ্য কি ছিল?

সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা।

৩. রিপাবলিক গ্ৰন্থের লেখক কে?

প্লেটো।

৪. সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য কি?

শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা।

Leave a Comment