শিবাজি

মারাঠা বীর যোদ্ধা শিবাজি -র জন্ম, পিতামাতা, বাল্যজীবন, সেনাবাহিনী গঠন, রাজ্যজয়ে মনোনিবেশ, রাণাডের অভিমত, শিবাজির রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য, বিজাপুর রাজ্যের দুর্গ জয়, আফজল খাঁর হত্যা, শায়েস্তা খাঁর লাঞ্ছনা, জয়সিংহের অভিযান, পুরন্দরের সন্ধি, শিবাজিকে আগ্রায় নজরবন্দী, শিবাজিকে রাজা উপাধি প্রদান, শিবাজির রাজ্যাভিষেক ও তাঁর রাজ্যাভিষেকের রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে জানবো।

বীর যোদ্ধা শিবাজি

ঐতিহাসিক চরিত্রশিবাজি
জন্ম১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ
উপাধিছত্রপতি, গো ব্রাহ্মণ প্রতিপালক
রাজ্যাভিষেক১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দ, রায়গড় দুর্গ
মৃত্যু১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ
শিবাজি

ভূমিকা :- সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান ভারত ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি ছিলেন একজন কুশলী সামরিক কৌশলবিদ।তিনি গেরিলা যুদ্ধের ধারণার সূচনা করেন।

শিবাজির জন্ম

১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৬৩০ খ্রিঃ) শিবন-এর গিরিদুর্গে শিবাজির জন্ম হয়।

শিবাজির পিতামাতা

তাঁর পিতা শাহজি ভোঁসলে আহম্মদনগরের সুলতানের অধীনে পুণার জায়গিরদার ছিলেন। পরে তিনি বিজাপুরের সুলতানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে কর্ণাটকে জায়গির পান। তাঁর মাতা জিজাবাঈ ছিলেন প্রাচীন যাদব বংশীয় জায়গিরদার যাদব রাও-এর কন্যা। সুতরাং পিতা মাতা দু’দিক থেকেই শিবাজির দেহে ভূম্যাধিকারীর রক্ত ছিল।

শিবাজির বাল্যজীবন

  • (১) শাহজি তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী তুকাবাঈয়ের সঙ্গে বিজাপুরে বসবাস করতেন। শিশু শিবাজি ও তাঁর মাতা জিজাবাঈ পুণাতেই বসবাস করতে থাকেন এবং তাদের ভরণপোষণের জন্য শাহজি পুণার জায়গিরটি ছেড়ে দেন।
  • (২) শিবাজি ও তাঁর মায়ের দেখাশোনার জন্য দাদাজি কোন্ডদেব নামে এক বিচক্ষণ ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করা হয়। এই সময় জিজাবাঈ-এর বয়স ৪১ বছর। তিনি যথার্থ সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতেন।
  • (৩) ধর্মপ্রাণ মাতা এবং বিচক্ষণ ও স্বদেশপ্রেমিক ব্রাহ্মণের প্রভাবে তরুণ শিবাজির অন্তরে দেশপ্রেম ও বীরত্বের সঞ্চার হয়। তাঁদের কাছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও অন্যান্য কাহিনী শুনে তরুণ বয়সেই তিনি ভারতবর্ষে স্বাধীন হিন্দুরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
  • (৪) দাদাজি কোন্ডদেব তাঁকে অস্ত্রচালনা, অশ্বারোহণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেন। বাল্যে শিবাজির কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা যে, হায়দার আলি ও রণজিৎ সিংহের মতো তিনিও নিরক্ষর ছিলেন।

শিবাজির সেনাবাহিনী গঠন

মোগল সাম্রাজ্যবাদ তখন উত্তর ভারতে নানা সমস্যায় ব্যতিব্যস্ত এবং অপরদিকে মোগল শক্তির বারংবার আক্রমণে দাক্ষিণাত্যের সুলতানি রাজ্যগুলির অবস্থাও শোচনীয়। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অধিবাসী মাওলীদের নিয়ে তিনি এক সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গঠন করেন।

শিবাজির রাজ্য জয়ে মনোনিবেশ

সমকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা শিবাজির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সুযোগ এনে দেয়। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে দাদাজি কোণ্ডদেবের মৃত্যুর পর শিবাজি পুণা জায়গিরের প্রকৃত শাসকে পরিণত হন এবং নিজ পরিকল্পনা মতো রাজ্যজয়ে মনোনিবেশ করেন।

শিবাজি সম্পর্কে রাণাডের অভিমত

মারাঠি ঐতিহাসিক মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে শিবাজির রাজনৈতিক জীবনকে “মারাঠা জাতীয়তাবাদের প্রতীক ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে চিহ্নিত করেছেন।

শিবাজি সম্পর্কে রোলিনসনের অভিমত

ঐতিহাসিক রোলিনসন বলেন যে, নিছক লুঠতরাজ নয়- বিদেশি শাসনের বন্ধন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করাই ছিল শিবাজির লক্ষ্য।

শিবাজির রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্য

শিবাজির রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য বা প্রকৃতি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। জি. এস. সরদেশাই বলেন যে, শিবাজির লক্ষ্য ছিল সমগ্র ভারতে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন। স্যার যদুনাথ সরকার (J. N. Sirkar) এই মতবাদের বিরোধিতা করেছেন।

  • (১) শিবাজিকে সর্বদাই মোগল ও বিজাপুরের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই তাঁর পক্ষে সর্বভারতীয় হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা সম্ভব ছিল না। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ ও অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন।
  • (২) শিবাজি সুরাটের হিন্দু ব্যবসায়ীদের সম্পদ লুঠ করেন, পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলি থেকে ‘চৌথ’ আদায় করেন এবং মোগলদের বিরুদ্ধে মুসলিম গোলকুণ্ডা রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। এগুলি নিশ্চয় হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার নজির নয়।
  • (৩) শিবাজির লক্ষ্য ছিল নিছক সাম্রাজ্য বিস্তার–এর পশ্চাতে হিন্দুত্ববাদের কোনও প্রশ্ন ছিল না। পুরন্দরের সন্ধি দ্বারা তিনি ঔরঙ্গজেব -এর অধীনতা মেনে নেন। বাদশাহের কাছ থেকে উপযুক্ত মর্যাদা পেলে তিনি কখনোই মোগল-বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতেন না।
  • (৪) মোগলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হিন্দু-সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে তাঁকে অবশ্যই হিন্দুধর্মের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। হিন্দুধর্ম ও সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল একই মুদ্রার দুই পিঠ।

শিবাজি কর্তৃক বিজাপুর রাজ্যের দুর্গজয়

  • (১) তিনি বিজাপুরের অন্তর্গত তোরণা দুর্গটি অধিকার করেন এবং তারপর একে একে রায়গড়, চকন, সিংহগড়, বড়মতি, ইন্দ্রপুর, পুরন্দর ও কোন্দন প্রভৃতি স্থানের দুর্গগুলি জয় করেন।
  • (২) মারাঠা নায়কের এই কার্যকলাপে ক্রুদ্ধ হয়ে বিজাপুরেরসুলতান ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পিতা শাহজিকে বন্দি করেন। এর ফলে কয়েক বছরের (১৬৪৯-৫৫ খ্রিঃ) জন্য শিবাজি তাঁর আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ রেখে নিজ শক্তিবৃদ্ধিতে মন দেন।
  • (৩) তাঁর পিতার মুক্তির পর শিবাজি পুরন্দর ও জাবলি দুর্গ দখল করেন। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসনকর্তা ঔরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ করলে শিবাজি সেই সুযোগে মোগল-অধিকৃত আহম্মদনগর ও জুনার লুঠ করেন।
  • (৪) ইতিমধ্যে শাহজাহান -এর অসুস্থতার সংবাদে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করলে তিনি উত্তর কোঙ্কনের বিস্তীর্ণ স্থান দখল করেন।

সম্রাট শিবাজি কর্তৃক আফজল খাঁর হত্যা

  • (১) মোগল আক্রমণের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে বিজাপুর সুলতান শিবাজিকে দমনের জন্য বিখ্যাত সেনাপতি আফজল খাঁ-র নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী পাঠান (১৬৫৯ খ্রিঃ)।
  • (২) প্রত্যক্ষ যুদ্ধে শিবাজিকে পরাজিত করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে আফজল খাঁ তাঁকে কৌশলে হত্যার চক্রান্ত করেন। এই উদ্দেশ্যে শান্তি-প্রস্তাব আলোচনার জন্য তিনি শিবাজির কাছে দূত পাঠান।
  • (৩) আফজল খাঁ-র অভিসন্ধি বুঝতে পেরে শিবাজি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েই প্রতাপগড় দুর্গে যান। দীর্ঘদেহী আফজল খা খর্বকায় রুগ্ন শিবাজিকে আলিঙ্গনের ছলে হত্যার চেষ্টা করলে শিবাজি ‘বাঘনখ’ দ্বারা তাঁকে হত্যা করেন।
  • (৪) কাফি খাঁ ও ঐতিহাসিক ডাফ বলেন যে, শিবাজি বিশ্বাসঘাতকতার দ্বার আফজল খাঁকে হত্যা করেন। অবশ্য এই বক্তব্য সঠিক নয়। আফজল খাঁ হত্যা ছিল মারাঠা বীরের আত্মরক্ষামূলক কার্য, বিশ্বাসঘাতকতামূলক হত্যা নয়।
  • (৫) সেনাপতির অকস্মাৎ মৃত্যুতে বিজাপুর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বিজাপুর শিবির থেকে শিবাজি প্রচুর গোলাগুলি, তোপ, হাতি, ঘোড়া ও দশ লক্ষ টাকা পান এবং তিনি দক্ষিণ কোঙ্কন, কোলাপুর ও পানহালা দুর্গ জয় করে নেন।
  • (৬) শেষ পর্যন্ত ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুরের সুলতান শিবাজির সঙ্গে সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হন এবং শিবাজি কর্তৃক অধিকৃত স্থানগুলির ওপর শিবাজির কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেন।

শিবাজি কর্তৃক শায়েস্তা খাঁর লাঞ্ছনা

  • (১) সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁর মাতুল ও দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ-র ওপর শিবাজিকে দমনের দায়িত্ব অর্পণ করেন (১৬৬০ খ্রিঃ)। সূচনা-পর্বে মোগল বাহিনী প্রভূত সফলতা অর্জন করে এবং মারাঠারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
  • (২) এই অবস্থায় ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল শিবাজি অতর্কিতে পুণায় শায়েস্তা খাঁ-র শিবিরে হানা দিয়ে তাঁর পুত্র-সহ চল্লিশ জন অনুগামীকে হত্যা করেন এবং তাঁর তরবারির আঘাতে শায়েস্তা খাঁ একটি আঙ্গুল হারিয়ে কোনওকার প্রাণ নিয়ে দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করেন।
  • (৩) এরপর মোগল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয় এবং এই সুযোগে ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মোগলদের সমৃদ্ধশালী বন্দর সুরাট লুন্ঠন করে প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহ করেন।

শিবাজির বিরুদ্ধে জয়সিংহের অভিযান

  • (১) এরপর অম্বর-রাজ জয়সিংহ ও সেনাপতি দিলীর খাঁ-র ওপর শিবাজিকে দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জয়সিংহ কূটকৌশলে বিজাপুর-গোলকুণ্ডা থেকে শিবাজিকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে মোগল-মিত্রে পরিণত করার নীতি গ্রহণ করেন।
  • (২) শিবাজির বিরুদ্ধে তিনি এমন আক্রমণ শুরু করেন যে, শিবাজি সন্ধিকরতে বাধ্য হন।

জয়সিংহ ও শিবাজির মধ্যে পুরন্দরের সন্ধি

মোগল সেনাপতি জয়সিংহ ও শিবাজির মধ্যে পুরন্দরের সন্ধি (২২শে জুন, ১৬৬৫ খ্রিঃ) স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে,

  • (১) শিবাজিমোগল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন।
  • (২) ২৩টি দুর্গ ও কয়েকটি জেলা, যেখান থেকে বার্ষিক ২০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে, মোগলদের ছেড়ে দেন।
  • (৩) তার পুত্র শম্ভুজি মোগল দরবারে পাঁচ হাজারি মনসবদার নিযুক্ত হন।
  • (৪) বিজাপুরের বিরুদ্ধে মোগলদের সাহায্য-দানে সম্মত হন।

শিবাজিকে আগ্রায় নজরবন্দি

  • (১) সন্ধি সম্পাদনের কিছুদিন পরেই ঔরঙ্গজেবের আমন্ত্রণে ও জয়সিংহের অনুরোধে শিবাজি শিশুপুত্র শম্ভুজি-সহ আগ্রায় যান (১৬৬৬ খ্রিঃ)।
  • (২) দরবারে তাঁকে উপযুক্ত সম্মান না দেওয়ায় তিনি প্রতিবাদ করলে ঔরঙ্গজেব তাঁকে আগ্রা দুর্গে নজরবন্দি করে রাখেন। সুচতুর শিবাজি শিশুপুত্র-সহ কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করে নিজ রাজ্যে ফিরে আসেন।

শিবাজিকে রাজা উপাধি প্রদান

এরপর তিন বছর মোগলদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন নি। তাঁকে কোনওভাবেই পরাজিত করা সম্ভব নয় দেখে শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব তাঁকে ‘রাজা’ বলে স্বীকার করেন এবং জায়গির হিসেবে বেরার দান করেন।

মোগলদের বিরুদ্ধে শিবাজির পুনরায় যুদ্ধ

  • (১) দাক্ষিণাত্যে মোগল সেনাপতিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিদ্রোহ দমনে সম্রাটের ব্যস্ততার সুযোগে ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিবাজি মোগলদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন।
  • (২) পুরন্দরের সন্ধির শর্ত হিসেবে যে ২৩টি দুর্গ তিনি মোগলদের ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলি একে একে তিনি পুনরুদ্ধার করেন।

শিবাজির রাজ্যাভিষেক

১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ছত্রপতি’ ও ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ উপাধি ধারণ করে রায়গ দুর্গে মহাসমারোহে তিনি নিজ অভিষেক সম্পন্ন করেন।

শিবাজির রাজ্যাভিষেকের তাৎপর্য

সম্রাট শিবাজির রাজ্যাভিষেক কোনও ‘শূন্যগর্ভ অনুষ্ঠান’ ছিল না। এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল।যেমন –

  • (১) মোগল ও বিজাপুর শক্তির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে দাক্ষিণাত্যের এক ব্যাপক অঞ্চলে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করলেও শিবাজির কোনও বৈধ স্বাধীন সত্তা ছিল না।
  • (২) বিজাপুর সুলতানের কাছে তিনি ছিলেন ‘অধীনস্থ জায়গিরদারের বিদ্রোহী পুত্র’ এবং মোগল বাদশাহের দৃষ্টিতে একজন নিছক জমিদার মাত্র।
  • (৩) ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেব শিবাজিকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করলেও, সে যুগে বহু জমিদার ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এই উপাধি ব্যবহার করতেন।
  • (৪) সুতরাং একটি স্বাধীন রাজ্যের কার্যকরী শাসক হয়েও তাঁর কোনও সার্বভৌম রাজকীয় মর্যাদা ছিল না। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিবাজির সার্বভৌমত্ব বৈধতা প্রাপ্ত হয় এবং তিনি মোগল সম্রাট ও বিজাপুর-গোলকুণ্ডা সুলতানের সমপর্যায় ভুক্ত হন।
  • (৫) শিবাজির উত্থানে অন্যান্য মারাঠা গোষ্ঠী তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। তারা শিবাজিকে ‘রাজা” বলে মানতে রাজি ছিল না। রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান তাদের কাছেও শিবাজিকে উচ্চতর মর্যাদা ও মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে।
  • (৬) হিন্দু শাস্ত্রানুসারে একমাত্র ক্ষত্রিয়রাই রাজপদ লাভের অধিকারী ছিল। ভোঁসলেরা শুদ্র বলে পরিচিত ছিল। এই যুগের বারাণসীর সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত গঙ্গাভট্ট তাঁকে ‘সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয় এবং মেবারের রানার বংশধর বলে স্বীকৃতি জানালে তাঁর সামাজিক মর্যাদাও উন্নত হয়।
  • (৭) রাজ্যাভিষেকের সময় থেকে শিবাজি একটি নতুন সম্বৎ প্রচলন করেন। তার নাম ‘রাজ-শক’। এই কারণে তাঁকে ‘শক-কর্তা’ (‘maker of an era’) বলা হয়।
  • (৮) রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হিসেবে পারসিক ও উর্দুর পরিবর্তে তিনি মারাঠিকে স্বীকৃতি দেন। ডঃ সরদেশাই এই অনুষ্ঠানকে ‘প্রাচীন হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যের পুনরুত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • (৯) পরবর্তী ছয় বছরে তিনি জিঞ্জি, ভেলোর, বেলারি, তাঞ্জোর এবং মহীশুরের একাংশ প্রভৃতি স্থান দখল করে এক বিস্তীর্ণ স্থানে তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।

শিবাজির রাজ্যের আয়তন

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল তিপ্পান্ন বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর রাজ্য উত্তরে সুরাটের নিকটবর্তী ধরমপুর থেকে দক্ষিণে গোয়া এবং পূর্বে বাগলানা, নাসিক, পুণা এবং সাতরা-সহ পশ্চিম দিকে সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া, দাক্ষিণাত্যের কয়েকটি খণ্ড খণ্ড অংশও তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল।

রবীন্দ্রনাথের চোখে শিবাজি

‘শিবাজী উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,

“মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক কন্ঠে বলো

‘জয়তু শিবাজি’।

মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক সঙ্গে চলো

মহোৎসবে সাজি।

আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব

দক্ষিণে ও বামে

একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব

এক পুণ্য নামে॥”

উপসংহার :- বিখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের মতে শিবাজী যে শুধুই মারাঠা জাতির স্রষ্টা ছিলেন এমন নয়, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান জাতীয় স্রষ্টা।

(FAQ) শিবাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কবে কাদের মধ্যে পুরন্দরের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়?

১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল সেনাপতি জয়সিংহ ও শিবাজির।

২. শিবাজির শিক্ষাগুরু কে ছিলেন?

দাদাজি কোণ্ডদেব।

৩. শিবাজির পিতা ও মাতার নাম কি

শাহজি ভোঁসলে ও জীজাবাঈ।

৪. কবে কোথায় শিবাজির রাজ্যাভিষেক হয়?

১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড় দুর্গে।

Leave a Comment