শেরশাহ

শেরশাহ -এর জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, বাবরকে সাহায্য, বিবাহ, সুরজগড়ের যুদ্ধ, বাংলা অভিযান, চৌসার যুদ্ধ, কনৌজের যুদ্ধ, রাজ্য জয়, উপাধি লাভ, দ্বিতীয় আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, শেষ অভিযান, মৃত্যু, শাসন ব্যবস্থা, ভূমি রাজস্ব, বিচার ব্যবস্থা, সাহিত্য, ধর্ম ও স্থাপত্য সম্পর্কে জানবো।

আফগান শাসক শেরশাহ প্রসঙ্গে শেরশাহের জন্ম, শেরশাহের বংশ, শেরশাহের পিতামাতার নাম, শেরশাহের বাল্য নাম, শেরশাহের শিক্ষা, সাসারামের জায়গিরদার শেরশাহ, শেরশাহের সিংহাসন লাভ, শেরশাহের রাজত্বকাল, শেরশাহের হিন্দু সেনাপতি, শেরশাহের রাজধানী, শেরশাহের রাজত্বের বিভাগ, শেরশাহের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজয়, শেরশাহের মৃত্যু ও শেরশাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার।

আফগান নেতা শেরশাহ

ঐতিহাসিক চরিত্রশেরশাহ
জন্ম১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ
বংশশূর বংশ
অবদানজি. টি. রোড নির্মাণ
মৃত্যু১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ
সমাধিবিহারের সাসারাম
উত্তরসূরিইসলাম শাহ
শেরশাহ

ভূমিকা :- শের শাহ সুরি ছিলেন মধ্যযুগীয় দিল্লির একজন শক্তিশালী আফগান বিজয়ী। একজন সাধারণ সেনাকর্মচারী হয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করে পরবর্তীকালে তিনি দিল্লির বাদশাহ পদে উত্তীর্ণ হন।

শেরশাহের জন্ম

১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে সম্ভবত পাঞ্জাবের নারনুল পরগনায় শেরশাহের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফরিদ খাঁ।

শেরশাহের বংশ পরিচয়

তাঁর পিতার নাম ছিল হাসান খান শূর। জামাল খান লোহানীর অধীনে চাকরি নিয়ে হাসান খান বিহারের সাসারামের জায়গিরদার নিযুক্ত হন। শেরশাহ ছিলেন তাঁর পিতার প্রথমা পত্নীর সন্তান।

শেরশাহের শিক্ষা

শেরশাহ প্রথম জীবনে জৌনপুরে শিক্ষালাভ করেন। তিনি ছিলেন সুন্নি মুসলমান।

শেরশাহের সাসারামের জায়গির লাভ

কিন্তু হাসান খান তাঁর চতুর্থ পত্নীর প্রভাবে ফরিদকে অবহেলা করেন। জামাল খানের প্রভাবে তাঁর পিতার সাথে শের খান বা ফরিদের মিলন ঘটে এবং হাসান তাকে সাসারাম ও খোয়াসপুরের জায়গিরের শাসনভার প্রদান করেন।

শেরশাহের চাকরি গ্ৰহণ

বিমাতার অত্যাচারে ফরিদ পুনরায় সাসারাম ছেড়ে দক্ষিণ বিহারের অধিপতি বাহার খান লোহানীর অধীনে চাকরি নেন।

শেরশাহের শের খান উপাধি লাভ

বাহার খান ফরিদের সাহসিকতার জন্য তাকে ‘শের খান’ উপাধি দেন। বাহার খান নিজপুত্র জালাল খানের শিক্ষার দায়িত্ব দেন শের খানের ওপরে।

বাবরকে শেরশাহের সাহায্য

শের খান ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট বাবর -এর অধীনে চাকরি নেন। বাবরের বিহার আক্রমণকালে ও চান্দেরি দুর্গ দখলে শের খান তাকে সাহায্য করেন। পুরস্কার স্বরূপ বাবর শের খানকে সাসারামের জায়গির অর্পণ করেন।

বিহারের নায়েব শেরশাহ

বাহার খান লোহানীর মৃত্যু হলে তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খানই ছিলেন বৈধ উত্তরাধিকারী। মৃত বাহার খানের বিধবা পত্নী শের খানকে নায়েব নিযুক্ত করেন। শের খান এই নাবালকের অভিভাবক হিসাবে প্রায় সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নেন।

শেরশাহের বিবাহ

শের খান চুনার দুর্গের অধিপতি তাজ খানের বিধবা পত্নী লাড মালিকাকে বিবাহ করে চুনার দুর্গের অধিকার পান। গাজিপুরের শাসক নাসির খান নুহানীর বিধবা পত্নী গওহর গোঁসাইকেও শের খান বিবাহ করেন।

শেরশাহের জীবনচরিত

শের শাহের জীবনচরিতের নাম ‘তারিখ-ই-শেরশাহী’। এই গ্ৰন্থটি রচনা করেন আব্বাস খান শেরওয়ানি।

সুরজগড়ের যুদ্ধে শেরশাহের জয় লাভ

  • (১) শের খান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধে বিহারের আমীর ওমরাহ ও বাংলার সুলতান মামুদ শাহের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন।
  • (২) এই যুদ্ধে জয়লাভ করে শের খান বিহারের স্বাধীন নরপতিতে পরিণত হন। এর ফলে বাংলা আক্রমণের পথ সুগম হয়।
  • (৩) সুরজগড়ের যুদ্ধকে ড. কে. কে. দত্ত ‘শেরশাহের জীবনের যুগ সন্ধিক্ষণ’ বলে অভিহিত করেছেন।
  • (৪) সাসারামের ক্ষুদ্র জায়গিরদারের হিন্দুস্তানের অধিপতি হওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হল সুরজগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ।

শেরশাহের বাংলা অভিযান

  • (১) শেরশাহ ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করলে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মামুদ শাহ ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করেন শেরশাহকে।
  • (২) পরে সুলতান গিয়াউদ্দিন মামুদ শাহ পোর্তুগিজদের সাহায্য নিয়ে শেরশাহের মোকাবিলা করতে চাইলে শেরশাহ ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করে অধিকার করেন।
  • (৩) ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান রূপে শেরশাহের অভিষেক সম্পন্ন হয়। তিনি ‘সুলতান ফরিদ-উদ-দুনিয়া ওয়াদিন আবুল-মুজাফ্ফর শেরশাহ’ উপাধি নেন।

চৌসার যুদ্ধে শেরশাহের জয় লাভ

শের খান ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। ফলে বাংলা, বিহার, জৌনপুর ও কনৌজ শের খানের হস্তগত হয়। এরপর শের খান “শের শাহ সুলতান-ই-আদিল” উপাধি নেন।

কনৌজের যুদ্ধে শেরশাহের জয় লাভ

শেরশাহ ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। হুমায়ুন ভারত ত্যাগ করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে শেরশাহ দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন।

শেরশাহের সেনাপতি

শেরশাহের হিন্দু সেনাপতির নাম ব্রহ্মজিৎ গৌড় এবং মুসলিম সেনাপতির নাম নাসির খান।  

দ্বিতীয় আফগান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শেরশাহ

শেরশাহ দ্বিতীয় আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে পুনরায় আফগান প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

শেরশাহের উপাধি ধারণ

শেরশাহ সুলতান-উল-আদিল’, ‘আল-আমির-আল-গাজি’, ‘শেরশাহ’, ‘খুন-আল্লাহ খিলাফত্’ উপাধি নেন।

শেরশাহের রাজ্য জয়

  • (১) শেরশাহ সিন্ধু ও ঝিলামের মধ্যবর্তী অঞ্চলে গক্কর উপজাতিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। গক্কররা মুঘল অনুগত ছিল। গক্কর অঞ্চলে তিনি রোটাস নামে এক দুর্গ নির্মাণ করেন।
  • (২) শেরশাহ ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা খিজির খানের বিদ্রোহ দমন করেন। শেরশাহ বাংলাকে ১৯টি সরকারে ভাগ করে প্রতি সরকার শিকদারের শাসনে রাখেন।
  • (৩) ১৯ জন শিকদারের উপরে ‘আমির-ই-বাংলা’ নামে এক কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়। তিনি কাজী ফজিলৎকে ‘আমির-ই-বাংলা’ বা বাংলার প্রধান শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করেন।
  • (৪) শেরশাহ ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে মালব জয় করেন। তিনি ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে রায়সিন দুর্গ জয় করেন। এই সময় রায়সিন দুর্গের অধিপতি ছিলেন পুরনমল।
  • (৫) শেরশাহ ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে মাড়ওয়ার দখল করেন। এই সময় মারওয়াড়ের অধিপতি ছিলেন মালদেব।

শেরশাহের অমলে সামেলের যুদ্ধ

১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে আজমের ও যোধপুরের মধ্যবর্তী স্থান সামলেতে রাজপুত ও আফগানবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, যা সামেলের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

শেরশাহের শেষ অভিযান

শেরশাহের শেষ অভিযান ছিল ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে বুন্দেলখণ্ডের কালিঞ্জর দুর্গের বিরুদ্ধে। এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন কিরাত সিংহ।

শেরশাহের মৃত্যু

কালিঞ্জর দূর্গ অবরোধ চলাকালীন একটি বারুদের নল ফেটে শেরশাহের মৃত্যু হয় ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

শেরশাহের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন শেরশাহ নিজে। তাকে শাসনকার্যে সাহায্য করার জন্য চারজন মন্ত্রী ছিলেন —

  • (১) ‘দেওয়ান-ই-উজিরাৎ’ – অর্থবিভাগ দেখাশোনা করতেন।
  • (২) দেওয়ান-ই-আরজ – সেনাদলের বেতন, নিয়োগ ও শৃঙ্খলার কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
  • (৩) ‘দেওয়ান-ই-রিসালাৎ — বৈদেশিক দপ্তর দেখাশোনা করত।
  • (৪) ‘দেওয়ান-ই-ইনসা’—সরকারি দলিল ও চিঠিপত্র দেখাশোনার কাজ করত।
  • (৫) এছাড়া ‘দেওয়ান-ই-কাজী’ বা প্রধান বিচারপতি এবং দেওয়ান-ই-বারিদ বা গুপ্তচর বিভাগের প্রধানের মর্যাদা ছিল মন্ত্রীর অনুরূপ।

শেরশাহের প্রাদেশিক শাসন

শেরশাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭টি শিক বা সরকারে ভাগ করেন। ত্রিপাঠীর মতে ৬৬টি সরকার শেরশাহের অধীনে ছিল।

  • (১) প্রতিটি সরকার বা শিক কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল। প্রতিটি পরগনা কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি ছিল।
  • (২) প্রত্যেক সরকারে একজন করে “শিকদার-ই শিকদারান’ ছিল, যার দায়িত্ব ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিদ্রোহ দমন করা। ‘মুনসিফ-ই-মুনসিফান’ দেওয়ানি ও জমি জরিপ সংক্রান্ত মামলার দায়িত্বে ছিল।
  • (৩) প্রত্যেক পরগনায় একজন করে ‘শিকদার’, মুন্সিফ’, ‘আমিন’, ‘কানুনগো’, ‘কারকুন’ প্রভৃতি নানা পর্যায়ের কর্মচারী ছিলেন।
  • (৪) ‘শিকদার’ ছিলেন পরগনার সামরিক অধিকর্তা। ‘মুন্সিফ’ রাজস্ব আদায়, বিচার ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা করত। ‘আমিন’ জমি জরিপ করত। ‘কানুনগো’ জমির জরিপ ও রাজস্বের হিসাব রাখতেন। ‘কারকুন’ ছিলেন করণিক।
  • (৫) শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তর ছিল গ্রাম। গ্রামের শাসনভার ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর। প্রতি গ্রামের মুখিয়া বা গ্রাম প্রধান বা মুকাদ্দম গ্রামের কৃষক ও সরকারের মধ্যে যোগসূত্ররূপে কাজ করতেন। গ্রাম প্রধান গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিল এবং হিসাবপত্র দেখাশোনা করত পাটোয়ারি।
  • (৬) ফোতদার ছিল কোষাধ্যক্ষ। ফোতদারের অপর নাম ছিল খাজনাদার।

শেরশাহের ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ স্বেচ্ছাতন্ত্র

রামপ্রসাদ ত্রিপাঠী শেরশাহের ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের ঝোঁককে ‘স্বেচ্ছাতন্ত্র’ আখ্যা দিয়েছেন।

শেরশাহের আমলে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা

শেরশাহ প্রধানত রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন। তবে মালব, রাজস্থান ও মুলতানে তিনি জায়গিরদারি ব্যবস্থা বহাল রাখেন।

(১) জমি জরিপ

আহমত খান নামে কর্মচারীর সাহায্যে জমি জরিপের কাজ সম্পন্ন করেন। তিনি সর্বত্র একই প্রকার জমির মাপ চালু করেন। এই জমি মাপার গজের নাম ছিল সিকাদরী গজ। সিকান্দর লোদি এই মাপকাঠি চালু করেন। এই গজের মাপ ছিল ৪১ আঙ্গুল /২৪ আঙ্গুল।

(২) জমি ভাগ

শেরশাহ জমিকে সরেশ, মাঝারি ও নিরেশ এই তিনভাগে ভাগ করেন। উৎপন্ন শাস্যের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ শস্য আদায় করা হত। নগদে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। চৌধুরি, মুকাদ্দম, আমিন প্রমুখ কর্মচারীরা কর আদায় করতেন।

(৩) পাট্টা

প্রজার দেয় খাজনা এবং তার স্বত্ব ও মাপ উল্লেখ করে সরকার থেকে প্রজাকে যে দলিল দেওয়া হত তাকে ‘পাট্টা’ বলা হত।

(৪) কবুলিয়ৎ

কৃষক নিজের স্বত্ব ও রাজস্ব প্রদানের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সরকারকে যে দলিল স্বাক্ষর করে দিত, তাকে বলা হত ‘কবুলিয়ৎ’।

(৫) জরিমানা ও মহসিলানা

প্রত্যেক উৎপাদককে দুটি বাড়তি কর দিতে হত জমি জরিপকারীর প্রাপ্য অর্থ হিসাবে জরিমানা’ এবং কর সংগ্রাহকের প্রাপ্য বাবদ ‘মহসিলানা’।

(৬) বিপর্যয়ের সময় রাজস্ব

দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় অনুদানের জন্য শেরশাহ বিঘা প্রতি আড়াই সের শস্য আদায় করতেন (উৎপন্ন ফসলের শতকরা ২০ ভাগ)।

(৭) ঋণদান

শেরশাহ দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকদের তাকাভি ঋণ দিতেন। কৃষকরা বছরে দুই কিস্তিতে রাজস্ব পরিশোধ করতে পারত।

শেরশাহের আমলে শুল্ক ব্যবস্থা

শেরশাহের বিশাল সাম্রাজ্যের মাত্র দুটি স্থানে শুল্ক আদায় করা হত।

  • (১) বাংলাদেশ -এ উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ও বহিরাগত দ্রব্যের ওপর শুল্ক আদায় করা হত সকরিগুলিতে
  • (২) খোরাসানসহ মধ্য এশিয়া ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আমদানি করা দ্রব্যের ওপর শুল্ক আদায় করা হত সিন্ধুতে।
  • (৩) শেরশাহ একটি পণ্যের ওপর মাত্র দুইবার শুল্ক ধার্য করার পদ্ধতি চালু করেন।

শেরশাহের আমলে মুদ্রা

সুলতানি যুগের শেষ দিকে, মুদ্রায় খাদ দেওয়ার যে প্রথা ছিল তা শেরশাহ রদ করেন। শেরশাহ রুপি নামক রৌপ্যমুদ্রা ও দাম নামক তাম্রমুদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনি স্বর্ণমুদ্রাও প্রবর্তন করেন। তিনি তামার গোটা পয়সা ছাড়াও তামার আধ ও সিকি পয়সা বা দাম চালু করেন।

শেরশাহের শাসনকালে বিচার ব্যবস্থা

  • (১) শেরশাহ কঠোর ফৌজদারি আইন প্রবর্তন করেন। অপরাধীকে বেত্রাঘাত, অঙ্গচ্ছেদ ও প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। মুসলিমদের দেওয়ানি মামলাগুলি কাজির আদালতে নিষ্পত্তি হত।
  • (২) ফৌজদারি মামলা হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে শিকদার নিষ্পত্তি করত। হিন্দুদের রাজস্ব সম্পর্কিত মামলা মুনশিফ নিষ্পত্তি করত।
  • (৩) ‘মীর আদল’ নামে এক বিচার বিভাগীয় কর্মচারী ছিল। রাজধানীতে প্রধান কাজি আপিলের মামলার বিচার করতেন।
  • (৪) প্রত্যেক পরগনায় দেওয়ানি বিচারের ভার ছিল ‘আমিন’-এর উপর। শেরশাহ স্বয়ং প্রতি বুধবার আপিলের মামলার বিচার করতেন।
  • (৫) আলাদা করে পুলিশবাহিনী ছিল না, সৈন্যবাহিনী দেশের শান্তিরক্ষার কাজ করত। পরগনায় শিকদার পুলিশের দায়িত্ব পালন করত।
  • (৬) শেরশাহ ‘স্থানীয় অপরাধের জন্য স্থানীয় দায়িত্ব’ এই নীতি চালু করেন।

শেরশাহের সামরিক ব্যবস্থা

শেরশাহের সেনাবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল। তিনি আলাউদ্দিন খলজির মতো একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেনাবাহিনীতে দাগ ও হুলিয়া প্রথার প্রবর্তন করেন। তিনি জায়গির দানের পরিবর্তে বেতন দানের ব্যবস্থা করেন। সামরিক কর্মচারীদের তিনি প্রতি দুই বছর অন্তর বদলির ব্যবস্থা করেন।

শেরশাহের আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থা

শেরশাহই প্রথম শাসক যিনি সাম্রাজ্য শাসনের স্বার্থে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুভব করেন।

(১) শেরশাহের আমলে রাজপথ নির্মাণ

শেরশাহের শাসনকালে চারটি দীর্ঘ রাজপথ নির্মিত হয়েছিল।

  • (ক) প্রথমটি ছিল বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত যেটি বর্তমানে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত।
  • (খ) দ্বিতীয়টি আগ্রা থেকে যোধপুর ও চিতোর পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • (গ) তৃতীয়টি লাহোর থেকে মূলতান পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • (ঘ) চতুর্থটি ছিল আগ্রা থেকে বুরহানপুর পর্যন্ত যার সঙ্গে গুজরাতের সমুদ্রগামী পথগুলি যুক্ত ছিল।

(২) শেরশাহের আমলে সরাইখানা স্থাপন

তিনি যাত্রীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দুই ধারে আট কিলোমিটার অন্তর সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি এগুলিকে “সাম্রাজ্যের ধমনী’ আখ্যা দিয়েছেন।

  • (ক) সরাইখানাগুলি সংবাদ বাহনের কেন্দ্র, ডাকচৌকি হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রত্যেক সরাইখানাতে দুটি ঘোড়া সর্বদা প্রস্তুত থাকত।
  • (খ) ঐতিহাসিক আব্বাস খান শেরওয়ানির রচনা থেকে জানা যায় শেরশাহ ১৭০০টি সরাইখানা স্থাপন করেন।

(৩) শেরশাহের আমলে ডাক চলাচল ব্যবস্থা

ঘোড়ার পিঠে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা সর্বপ্রথম শেরশাহ প্রচলন করেন। সংবাদবাহকেরা এখানে ঘোড়া বদলে নিত। দারোগা-ই-ডাকচৌকি এ সকল ব্যবস্থা পরিচালনা করত। এছাড়া দারোগা-ই সরাইখানাও ছিল।

(৪) শেরশাহের আমলে লঙ্গরখানা

শেরশাহ বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। তিনি প্রতি বছর ১৮২৫০০০ টাকা খয়রাতি খাতে খরচ করতেন।

শেরশাহের আমলে সাহিত্য

আরবি ও ফার্সি ভাষায় শেরশাহের ব্যুৎপত্তি ছিল। সিকন্দরনামা ও গুলিস্তান প্রভৃতি সাহিত্যের সাথে শেরশাহ পরিচিত ছিলেন।

  • (১) শেরশাহের সময় মালিক মহম্মদ জায়সী ‘পদ্মাবৎ’ কাব্য রচনা করেন।
  • (২) আব্বাস শেরওয়ানি শেরশাহের রাজত্বকাল নিয়ে ‘তারিখ-ই-শেরশাহি’ গ্রন্থ রচনা করেন।
  • (৩) ফৈজি সিরহিন্দ এর ‘তারিখ-ই-হুমায়ুন শাহি’ গ্রন্থ এবং নিজামউল্লাহ’র ‘মাখজাম-ই-আফগান’ গ্রন্থ হল তৎকালীন সাহিত্য যার থেকে শেরশাহের রাজত্বকাল সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়।

শেরশাহের সময়কালে ধর্ম

শেরশাহের সময়কালে বৈষ্ণব ধর্মের জাগরণ ঘটে। মথুরা ছিল এই সময় বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্র।

শেরশাহের স্থাপত্য কীর্তি

শেরশাহের স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে ছিল ঝিলাম নদীর তীরে রোটাসগড় দুর্গ, দিল্লির পুরোনো কেল্লা, সাসারামে শেরশাহের সমাধি। একটি হ্রদের মধ্যে একটি সুউচ্চ স্তম্ভের ওপর এই সমাধি মন্দিরটি ছিল।

শেরশাহের সমাধি বিষয়ে ঐতিহাসিকদের উক্তি

  • (১) ঐতিহাসিক হ্যাভেল এই সমাধি মন্দিরকে শেরশাহের ব্যক্তিত্বের ও চরিত্রের এক মহান প্রতিবিম্ব বলে অভিহিত করেছেন।
  • (২) ঐতিহাসিক কানুনগো শেরশাহের সমাধি মন্দিরকে দয়াপ্রবণ অন্তরের প্লাবন বলে বর্ণনা করেছেন।  
  • (৩) শেরশাহ দিল্লির পুরোনো কেল্লার অভ্যন্তরে কিলা-ই-কুহনা মসজিদ স্থাপন করেন। পার্সি ব্রাউন “এই মসজিদটিকে আকবরজাহাঙ্গীর -এর আমলে নির্মিত বহু কীর্তির উৎস বলে মনে করেছেন।”

শেরশাহ ও আকবর

ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, “যদি শেরশাহ বেঁচে থাকতেন তাহলে সম্রাট আকবরের আবির্ভাব সম্ভবত হত না।” কানুনগো শেরশাহকে ‘আকবরের চেয়ে অগ্রণী সাংগঠনিক প্রতিভা ও জাতীয় রাষ্ট্রের স্রষ্টা” বলেছেন। শেরশাহ যে সিকান্দরি গজ জমি জরিপের জন্য ব্যবহার করতেন আকবর তা তাঁর রাজত্বের ৩১ বছর পর্যন্ত চালু রাখেন। পরে তিনি ইলাহী ‘গজ’ চালু করেন। ধর্মসহিষ্ণুতা নীতির বীজ শেরশাহই বপন করেন। আর আকবর এই নীতিকে পরিপূর্ণতা দেন। ঐতিহাসিক কিনি (Keene) বলেছেন “এই পাঠানটির মতো বিজ্ঞতা কোনো সরকার, এমনকি ব্রিটিশ সরকারও দেখাতে পারেননি।”

উপসংহার :- শেরশাহের মধ্যে একজন সমরনেতা, একজন বিচক্ষণ নৃপতি এবং একজন যোগ্য ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “শেরশাহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) শেরশাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শেরশাহের প্রকৃত নাম কি?

ফরিদ খাঁ।

২. শেরশাহের পিতার নাম কি?

হাসান খান।

৩. শেরশাহের সময় ও পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট কে ছিলেন?

হুমায়ুন।

৪. শেরশাহের বাল্য নাম কি?

ফরিদ খাঁ।

৫. শেরশাহ কত বছর রাজত্ব করেছিলেন?

১৫৪০-১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছর।

৬. শেরশাহের রাজধানীর নাম কি?

দিল্লী।

৭. শেরশাহ কত বছর রাজত্ব করেছিলেন?

৫ বছর।

৮. শেরশাহের মৃত্যুর পর কে সিংহাসনে বসেন?

ইসলাম শাহ।

Leave a Comment