শশাঙ্কের রাজ্য জয়

শশাঙ্কের রাজ্য জয় প্রসঙ্গে সমগ্ৰ বাংলা জয়, বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত স্থাপন, পশ্চিম সীমান্তে রাজ্য বিস্তার, কনৌজ জয়, রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে যুদ্ধ, হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সম্পর্ক, অক্ষুন্ন রাজ্য সীমা ও গঞ্জাম লিপি সম্পর্কে জানবো।

শশাঙ্কের রাজ্য জয়

ঐতিহাসিক ঘটনাশশাঙ্কের রাজ্য জয়
রাজ্যগৌড়
রাজধানীকর্ণসুবর্ণ
রাজাশশাঙ্ক
ধর্মশৈব
শশাঙ্কের রাজ্য জয়

ভূমিকা :- শশাঙ্ক গৌড়ে তার অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার আরম্ভ করেন। গৌড় বলতে উত্তর বাংলা ও পশ্চিমবাংলার কিছু অংশ বুঝাত। তাঁর শিলালিপি উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় পাওয়া গেছে। মেদিনীপুর লেখতে মহারাজ সোমদত্ত প্রমুখ শশাঙ্ককে তাদের অধিরাজ বলে স্বীকার করেছেন।

শশাঙ্কের সমগ্ৰ বাংলা জয়

বঙ্গ বা পূর্ব বাংলায় শশাঙ্কের অধিকার বিস্তৃত হয় কিনা সঠিক জানা যায় নি। তবে যুক্তির দিক থেকে এই কথা ভাবা হয় যে, বাংলার বাইরে রাজ্য বিস্তার করার আগে শশাঙ্ক সমগ্র বাংলাদেশ -এ তার আধিপত্য স্থাপন করেন। সম্ভবত মগধ রাজ্যও প্রথম থেকে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত স্থাপন

  • (১) এই সময় বাংলার প্রাকৃতিক সীমান্ত বলতে বুঝাত, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ, পশ্চিমে শোন-গণ্ডক উপত্যকা, উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে চিল্কা হ্রদ। এই সীমা হাতে না থাকলে প্রতিবেশী রাজ্যগুলির আক্রমণে বাংলার স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শশাঙ্ক তার রাজ্য বিস্তার নীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে এই প্রাকৃতিক সীমা লাভের চেষ্টা করেন।
  • (২) দুবি তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, গৌড়রাজ কামরূপ রাজ্য -এর ভাস্করবর্মাকে পরাস্ত করে বন্দী করেন। যদিও এই গৌড় রাজার নাম জানা যায়নি, তবে তিনি নিশ্চিত শশাঙ্ক ছিলেন। দক্ষিণে তিনি বাংলার সীমা দণ্ডভুক্ত বা দাঁতন পার হয়ে উৎকল ও কঙ্গোদ বা গঞ্জাম জয় করেন। দণ্ডভুক্তির রাজা শম্ভুযশকে তিনি পরাস্ত করে উড়িষ্যায় ঢুকে পড়েন।
  • (৩) মেদিনীপুরের মহাপ্রতীহার শুভকীর্তির লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি শশাঙ্ককে তার প্রভু বলে স্বীকার করতেন। উড়িষ্যার শৈলোদ্ভব রাজবংশ ৬১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শশাঙ্কের বশ্যতা স্বীকার করে।
  • (৪) গঞ্জামের মহাসামন্ত মাধবরাজের লিপিতেও শশাঙ্কের প্রতি আনুগত্য জানান হয়েছে। এই লিপিগুলির সাক্ষ্য থেকে ওড্র বা উড়িষ্যা, কঙ্গোদ বা গঞ্জামে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শশাঙ্কের আধিপত্য প্রমাণিত হয়।

পশ্চিম সীমান্তে শশাঙ্কের রাজ্য বিস্তার

  • (১) এর পর শশাঙ্ক পশ্চিম সীমান্তের দিকে মুখ ফেরান। পশ্চিম দিক থেকে কনৌজের মৌখরী শক্তি বাংলা অধিকারের জন্য বার বার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তী গুপ্ত বংশীয় রাজা মহাসেনগুপ্ত কোনরকমে এই আক্রমণ প্রতিহত করেন।
  • (২) শশাঙ্কের পূর্ববর্তী মগধ -এর শাসক পরবর্তী গুপ্ত রাজবংশ -এর আমল থেকে কনৌজ -এর মৌখরী শক্তির বিবাদ আরম্ভ হয়। শশাঙ্ক সিংহাসনে বসার পর উত্তরাধিকার সূত্রে এই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
  • (৩) থানেশ্বরের শক্তিশালী রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীর সঙ্গে কনৌজের মৌখরী রাজা গ্রহবর্মনের বিবাহ হলে কনৌজ থানেশ্বর জোট গড়ে ওঠে। শশাঙ্কের রাজ্য বিস্তারের ফলে মৌখরী শক্তি আতঙ্কিত হয়। মৌখরী-পুষ্যভূতি জোট ছিল গৌড়াধিপ শশাঙ্কের ক্ষমতানাশের জন্য এক চক্রান্ত। এর ফলে শশাঙ্ক বিপন্ন হন।
  • (৪) তিনি এই জোটের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মালবের দেবগুপ্তের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। মালবের সঙ্গে থানেশ্বরের ঘোর বিরোধ ছিল। হিউয়েন সাং বাণভট্টের মতই শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছেন।

শশাঙ্কের কনৌজ জয়

  • (১) ওপরে বর্ণিত কুটনৈতিক জোট গড়ার সঙ্গে সঙ্গে শশাঙ্ক পশ্চিম দিকে মগধ থেকে এগিয়ে যান। তারপর তিনি আরও এগিয়ে গঙ্গার খাত ধরে বারাণসী পর্যন্ত গঙ্গার উপকূল অধিকার করেন। এর ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় শশাঙ্কের আধিপত্য স্থাপিত হয় এবং কনৌজের মৌখরী শক্তি বেষ্টিত হয়ে পড়ে।
  • (২) ইতিমধ্যে থানেশ্বর রাজ প্রভাকরবর্ধনের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে, তার জামাতা কনৌজের গ্রহবর্মন মৌখরী কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই সুযোগে শশাঙ্ক ও দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করে গ্রহবর্মনকে নিহত করেন এবং তার পত্নী রাজ্যশ্রীকে বন্দিনী করেন।
  • (৩) প্রভাকরবর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজ্যবর্ধন তার পিতার সিংহাসনে বসে কনৌজের দিকে সেনা নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকেন। তিনি পথিমধ্যে মালব আক্রমণ করে দেবগুপ্তকে পরাস্ত করেন। কিন্তু শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনকে নিহত করেন।

রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের যুদ্ধ

  • (১) রাজ্যবর্ধনকে শশাঙ্ক ন্যায়-যুদ্ধের দ্বারা নিহত করেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বাণভট্টের মতে, শশাঙ্ক, রাজ্যবর্ধনের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করে তাকে নিহত করেন। হিউয়েন সাঙও বাণভট্টর মতই শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছেন।
  • (২) হর্ষের লিপিতে জানা যায় যে, রাজ্যবর্ধন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে শশাঙ্কের দ্বারা নিহত হন। ডঃ মজুমদারের মত হল, রাজ্যবর্ধনকে শশাঙ্ক ন্যায়-যুদ্ধে নিহত করেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্রের মতে, রাজ্যবর্ধন সম্ভবত শশাঙ্কের কাছে আত্মসমর্পন করেন অথবা বন্দী হন। আর্য-মঞ্জুশ্রী- মূল-কল্পে বলা হয়েছে যে, কোনো বর্বর উলঙ্গ জাতির আততায়ীর দ্বারা রাজ্যবর্ধন নিহত হন।

ডঃ মজুমদারের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ মজুমদারের মতে-

  • (১) বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙের বিবরণে বহু অসঙ্গতি আছে।
  • (২) হর্ষের লিপিতে শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কথা নেই।
  • (৩) শশাঙ্ক ছিলেন শৈব। এজন্য বৌদ্ধ ধর্ম -এর অনুরাগী হিউয়েন সাঙ এবং হর্ষের সভাকবি হর্ষের অনুগ্রহপুষ্ট বাণভট্ট শশাঙ্কের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন।

ডঃ বসাকের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ আর জি বসাক প্রমুখ বলেন যে, শশাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ্যবর্ধনকে নিহত করেছিলেন। হর্ষচরিতের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাণভট্ট এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছেন এবং শশাঙ্ককে ‘গৌড়াধম’ ও ‘গৌড়পাষণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন।

ডঃ গাঙ্গুলির অভিমত

ডঃ ডি সি গাঙ্গুলী ও অধ্যাপিকা দেবাহুতি প্রমুখ শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করেন। ডঃ গাঙ্গুলীর মতে, ধর্মীয় মতভেদের জন্য শশাঙ্কের চরিত্রে বাণভট্ট বা হিউয়েন সাঙ কলঙ্ক লেপন করবেন এটা মনে করা যায় না। দেবাহুতির মতে বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙের রচনায় অসঙ্গতিগুলিকে বড় করে দেখা উচিত নয়।

শশাঙ্ক গর্হিত কাজ করেন নি

ডঃ বসাক বলেন যে, সমকালীন প্রমাণগুলির উপর নির্ভর করা উচিত। এগুলির ভুল-ত্রুটি দেখিয়ে নস্যাৎ করা উচিত নয়। সমকালীন যুগের নৈতিক মানদণ্ড অনুসারে শশাঙ্ক এমন কিছু গর্হিত কাজ করেন নি।

হর্ষবর্ধন-শশাঙ্ক সম্পর্ক

  • (১) রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। এই সময় কামরূপের ভাস্করবর্মা তার সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হন। কামরূপের রাজা ছিলেন গৌড়-বাংলার প্রধান শত্রু। সুতরাং শশাঙ্কের শক্তি বৃদ্ধি তার আতঙ্কের কারণ হয়।
  • (২) এখন তিনি ‘শত্রুর শত্রু তার মিত্র’ কৌটিল্য -এর এই নীতি অনুসরণ করে স্বাভাবিক কারণে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হন। এর ফলে শশাঙ্ক দুদিক থেকে পূর্বে কামরূপ, পশ্চিমে পুষ্যভূতি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্মুখীন হন। বাণভট্টের বিবরণ হতে এই যুদ্ধের ফল কি হয় তা যায় নি।
  • (৩) আর্যমঞ্জুশ্রী মুলকল্পের মতে, হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে পরাজিত করেন এবং তাকে নিজ রাজ্যে আবদ্ধ করেন। কিন্তু এই গ্রন্থ অনেক পরের রচনা। এর তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়। ভাস্করবর্মার নিধনপুর পট্টলীর ভিত্তিতে অনেকে অনুমান করেন যে, পূর্বদিক থেকে ভাস্করবর্মা ও পশ্চিমদিক থেকে হর্ষের সম্মিলিত আক্রমণে শশাঙ্ক পরাজিত হন।
  • (৪) শশাঙ্কের রাজত্বের শেষের দিকের মুদ্রাগুলির মান ছিল খুব নীচু। এর থেকে তাঁর আর্থিক অবনতির কথা জানা যায়। সম্ভবত হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধে তাঁর শক্তি ক্ষয় পেয়েছিল। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের মেদিনীপুর লিপি থেকে জানা যায় যে, শশাঙ্ক এই সময় তাঁর মহারাজাধিরাজ উপাধি পরিত্যাগ করেন।

শশাঙ্কের রাজ্য সীমা অক্ষুন্ন

ডঃ মজুমদার, স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, শশাঙ্ক যদি কোনো যুদ্ধে হর্ষবর্ধনের কাছে পরাজিত হন তাতে তাঁর তেমন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। শশাঙ্কের জীবিতকালে তাঁর সাম্রাজ্য সীমা অক্ষুণ্ণ ছিল।

হিউয়েন সাঙের অভিমত

  • (১) হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, শশাঙ্কের মৃত্যুকাল পর্যন্ত (৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) মগধের উপর তার অধিকার বহাল ছিল। মা-তোয়ান লিন নামক চীনা লেখকও হিউয়েন সাঙের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। হর্ষবর্ধন গৌড় রাজ্য আক্রমণ করেন, এমন কোনো ঘটনার কথা হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেন নি।
  • (২) বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙ এই দুই প্রধান সমকালীন লেখক হর্ষবর্ধন দ্বারা গৌড় আক্রমণ ও শশাঙ্ককে পরাজিত করার কথা না উল্লেখ করায়, অনুমান করা যায় যে, শশাঙ্ক পূর্ণ গৌরবে মৃত্যুকাল পর্যন্ত শাসন করেন।

গঞ্জাম লিপি

শশাঙ্কের ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের গঞ্জাম লিপি প্রমাণ করে যে, এই সময় পর্যন্ত গঞ্জাম তাঁর অধিকারে ছিল। হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ আরম্ভ হয় ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। শশাঙ্ক ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে গঞ্জামে রাজত্ব করতেন। এই কথার তাৎপর্য আছে।

হিউয়েন সাঙের মগধ আগমন

হিউয়েন সাঙ ৬৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে মগধে এলে জানতে পারেন যে, কিছুদিন আগে শশাঙ্ক বোধগয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেছেন। সুতরাং বিহারের উপর ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক রাজত্ব করতেন একথা প্রমাণ হচ্ছে।

উপসংহার :- এই সকল প্রমাণের ভিত্তিতে ডঃ মজুমদার বলেন যে, শশাঙ্কের জীবিতকালে হর্ষবর্ধন তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার পুত্র মানবদেবকে পরাস্ত করে হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মা বাংলাদেশ ভাগ করে নেন।

(FAQ) শশাঙ্কের রাজ্য জয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গৌড় বাংলায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন কে?

শশাঙ্ক।

২. শশাঙ্কের রাজধানী কোথায় ছিল?

কর্ণসুবর্ণ।

৩. কোন কোন লিপি থেকে শশাঙ্ক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়?

মেদিনীপুর লিপি, গঞ্জাম লিপি।

৪. শশাঙ্কের মৃত্যু হয় কখন?

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে।

৫. শশাঙ্ক কোন ধর্মের অনুরাগী ছিলেন?

শৈব ধর্ম।

Leave a Comment