শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি

মোগল সম্রাট শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি -র উদ্দেশ্য, শাহজাহানের আহম্মদনগর জয়, শাহজাহানের কাছে গোলকুণ্ডা ও বিজাপুরের বশ্যতা স্বীকার, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার ঔরঙ্গজেব, ঔরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা আক্রমণ, গোলকুণ্ডার সাথে যুদ্ধ ও সন্ধি, ঔরঙ্গজেবের বিজাপুর আক্রমণ ও বিজাপুরের সাথে সন্ধি সম্পর্কে জানবো।

শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি প্রসঙ্গে শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘলদের দাক্ষিণাত্য নীতি বেশ সফল, শাহজাহান কর্তৃক দাক্ষিণাত্যের রাজ্য গুলিকে সংযুক্ত করার চেষ্টা, শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির উদ্দেশ্য, শাহজাহানের আহম্মদনগর জয়, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার ঔরঙ্গজেব, বিজাপুরের সাথে সন্ধি, গোলকুন্ডার বশ্যতা স্বীকার ও শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানব।

শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি (The Deccan Policy of Shah Jahan)

ঐতিহাসিক ঘটনাশাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি
রাজত্বকাল১৬২৮-৫৮ খ্রিস্টাব্দ
আহম্মদনগর জয়১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ
গোলকুণ্ডার বশ্যতা স্বীকার১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ
বিজাপুরের বশ্যতা স্বীকার১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ
শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি

ভূমিকা :- মোগল সম্রাটদের মধ্যে আকবরই প্রথম দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্য বিস্তারে অগ্রসর হন এবং খান্দেশ (১৫৯৯ খ্রিঃ) ও আহম্মদনগরের কিছু অংশ (১৬০০ খ্রিঃ) জয় করেন। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর আহম্মদনগরের অতি ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলই মাত্র জয় করেছিলেন। তাঁর আমলে আহম্মদনগর, বিজাপুর ও গোলকুন্ডা তাদের সদর্প স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। শাহজাহান সিংহাসনে বসে দাক্ষিণাত্য জয়ে অগ্রসর হন।

শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির উদ্দেশ্য

মোগল সম্রাট শাহজাহান -এর দাক্ষিণাত্য অভিযানের পশ্চাতে কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। যেমন –

  • (১) দাক্ষিণাত্য সম্পর্কে বাদশার একটি বিশেষ মোহ ছিল। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি দাক্ষিণাত্যেই আশ্রয় গ্রহণ করেন।
  • (২) তাঁর রাজত্বের সূচনায় দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহী সুবাদার খান জাহান লোদি আহম্মদনগরের সাহায্য পান। এই কারণে তিনি আহম্মদনগর ধ্বংসের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
  • (৩) ধর্মবিশ্বাসে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি ছিল ‘শিয়া’। ‘সুন্নি’ সম্প্রদায়ভুক্ত শাহজাহানের পক্ষে ‘শিয়া’ রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
  • (৪) আকবর ও জাহাঙ্গীরের দাক্ষিণাত্য অভিযান-এর উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনৈতিক।কিন্তু শাহজাহানের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে ধর্মীয় উদ্দেশ্যও যুক্ত হয়েছিল।

দাক্ষিণাত্যের আহম্মদনগর জয় (১৬৩২ খ্রিঃ)

  • (১) আহম্মদনগরের সুযোগ্য মন্ত্রী মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর (১৬২৬ খ্রিঃ) তাঁর পুত্র ফতে খাঁ মন্ত্রী নিযুক্ত হন। অচিরেই ফতে খাঁ-র সঙ্গে নিজামশাহি সুলতান মূর্তজা-র বিরোধ শুরু হয়।
  • (২) তিনি মোগলদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ শুরু করেন এবং শাহজাহানের নির্দেশে সুলতানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তাঁর দশম বৎসর বয়স্ক নাবালক পুত্র হুসেন শাহ-কে আহম্মদনগরের সিংহাসনে বসিয়ে নিজে রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।
  • (৩) প্রকৃত ক্ষমতা হাতে আসার পর তিনি মোগলদের বিরোধিতা শুরু করলে ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাহিনী দৌলতাবাদ দুর্গ অবরোধ করে। ফতে খাঁ প্রথমে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেও শেষ পর্যন্ত ১০ লক্ষ টাকা উৎকোচ নিয়ে তিনি দুর্গটি মোগলদের ছেড়ে দেন। এর ফলে স্বাধীন আহম্মদনগর রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।
  • (৪) সুলতান হুসেন শাহকে বন্দি করে গোয়ালিয়র দুর্গে পাঠানো হয়, আহম্মদনগর মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় (১৬৩৩ খ্রিঃ) এবং বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবে ফতে খাঁ মোগল দরবারে উচ্চ রাজপদ লাভ করেন।
  • (৫) শিবাজির পিতা শাহজি ভোঁসলে নিজামশাহি বংশের এক বালককে আহম্মদনগরের সুলতান বলে ঘোষণা করে এই বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি শাহজাহানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডার বশ্যতা স্বীকার (১৬৩৬ খ্রিঃ)

এরপর শাহজাহানের দৃষ্টি পড়ে গোলকুন্ডা রাজ্যের দিকে। তিনি ৫০ হাজার সৈন্য সমেত এই রাজ্য জয়ে অগ্রসর হলে গোলকুন্ডার কুতুবশাহি সুলতান আবদুল্লাহ বিনা যুদ্ধে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন এবং বাদশার নামে ‘খুৎবা’ পাঠ করতে, মুদ্রা প্রচলন করতে, বার্ষিক ৮ লক্ষ টাকা নজরানা দিতে এবং বিজাপুরের বিরুদ্ধে বাদশাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করতে সম্মত হন।

দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরের বশ্যতা স্বীকার (১৬৩৬ খ্রিঃ)

বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ কোনও প্রকার অমর্যাদাকর শর্তে বশ্যতা স্বীকারে রাজি না হওয়ায় মোগল বাহিনী তিন দিক থেকে বিজাপুর রাজ্য আক্রমণ করে এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। বিজাপুর সুলতান বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন (১৬৩৬ খ্রিঃ)। স্থির হয় যে,

  • (১) বিজাপুর সুলতান সম্রাটকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন।
  • (২) আহম্মদনগর ও গোলকুন্ডার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না।
  • (৩) শাহজি ভোঁসলেকে কোনওভাবে সাহায্য করবেন না এবং
  • (৪) বিনিময়ে আহম্মদনগর রাজ্যের ৫০-টি পরগণা বিজাপুরের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই এলাকা থেকে বিজাপুর সুলতানের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা।

দাক্ষিণাত্যের সুবাদার ঔরঙ্গজেব

  • (১) শাহজাহান দাক্ষিণাত্যের বিজিত অঞ্চলগুলিকে খান্দেশ, বেরার, তেলেঙ্গানা ও দৌলতাবাদ নামে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে তাঁর তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের ‘সুবাদার’ নিযুক্ত করেন।
  • (২) ঔরঙ্গজেব আট বছর (১৬৩৬ – ৪৪ খ্রিঃ) দাক্ষিণাত্যের ‘সুবাদার’ ছিলেন। এই কালপর্বে তিনি নাসিকের সন্নিকটে অবস্থিত বাগলানা নামক স্থানটি দখল করেন এবং শাহজি ভোঁসলের ক্ষমতা ধ্বংস করেন।
  • (৩) ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লিতে ফিরে যান। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় দাক্ষিণাত্যের ‘সুবাদার’ নিযুক্ত হন। এই পর্বে মুর্শিদকুলি খাঁ নামক জনৈক কর্মচারীর সহায়তায় তিনি দাক্ষিণাত্যের আর্থিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটান।

ঔরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা আক্রমণ (১৬৫৬ খ্রিঃ)

এরপর তিনি বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্য দু’টিকে মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত করতে উদ্যোগী হন। গোলকুন্ডার বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের কিছু অভিযোগ ছিল। যেমন –

  • (১) ‘সুন্নি’ ঔরঙ্গজেবের পক্ষে স্বাধীন ‘শিয়া’ রাজ্য গোলকুন্ডার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
  • (২) ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুসারে গোলকুন্ডার সুলতান দিল্লিশ্বরকে বার্ষিক কর দিতে সম্মত হয়েও পরে তা দেন নি।
  • (৩) ঔরঙ্গজেবের বিনা অনুমতিতে গোলকুন্ডা পার্শ্ববর্তী কর্ণাটক রাজ্যের একাংশ জয় করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে।
  • (৪) গোলকুন্ডা সুলতানের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রধানমন্ত্রী মিরজুমলা নিজ ক্ষমতা বিস্তারে অতি আগ্রহী হয়ে উঠলে গোলকুন্ডা সুলতান মিরজুমলার পুত্রকে বন্দি করেন।

দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডার সাথে যুদ্ধ

এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ মিরজুমলা ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ঔরঙ্গজেব গোলকুন্ডা আক্রমণ করেন। জয় যখন আসন্ন, সেই সময় জ্যেষ্ঠা কন্যা জাহানারা ও জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার প্ররোচনায় শাহজাহান ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেন।

দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডার সাথে সন্ধি

১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডার সঙ্গে ঔরঙ্গজেব সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তানুসারেস্থির হয় যে,

  • (১) গোলকুন্ডা সুলতান কুতুব শাহ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর অর্থ ও রাজ্যের একাংশ ঔরঙ্গজেবকে ছেড়ে দেন।
  • (২) ঔরঙ্গজেব নিজ পুত্র মহম্মদের সঙ্গে কুতুব শাহের একমাত্র কন্যার বিবাহ দেন এবং স্থির হয় যে কুতুব শাহের মৃত্যুর পর মহম্মদ গোলকুন্ডার সিংহাসনে বসবেন। কিছুদিন পর মিরজুমলা মোগল দরবারে চাকরি লাভ করেন।

দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর আক্রমণ

এরপর ঔরঙ্গজেব বিজাপুরের দিকে নজর দেন। সুলতান আদিল শাহের মৃত্যুর পর (১৬৫৬ খ্রিঃ) তাঁর নাবালক পুত্র দ্বিতীয় আলি সিংহাসনে বসলে রাজ্যে নানা গোলযোগ শুরু হয়। এই অবস্থায় ঔরঙ্গজের বিজাপুর আক্রমণ করে (১৬৫৭ খ্রিঃ) বিদর ও কল্যাণী দখল করেন।

দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরের সাথে সন্ধি

বিজাপুর জয় যখন আসন্ন তখন জাহানারা ও দারার প্ররোচনায় শাহজাহান যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ (১৬৫৭ খ্রিঃ) পাঠান। দু’পক্ষে সন্ধি হয়। সন্ধির শর্ত অনুসারে

  • (১) বিদর, কল্যাণী ও পরিন্দ মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় এবং
  • (২) বিজাপুর সুলতান ক্ষতিপূরণ বাবদ মোগলদের ১ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হন।

উপসংহার :- এইভাবে শাহজাহানের হস্তক্ষেপে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার স্বাধীন সত্তা রক্ষিত হয় এবং এর তিন দশক পর ঔরঙ্গজেব এই রাজ্য দু’টি জয় করেন।

(FAQ) শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মোগল সম্রাট শাহজাহান আহম্মদনগর জয় করেন কখন?

১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে।

২. গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর কত খ্রিস্টাব্দে শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকার করে?

১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে।

৩. শাহজাহানের আমলে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার কে ছিলেন?

ঔরঙ্গজেব।

Leave a Comment