দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ -এর সময়কাল, বিবাদমান পক্ষ, যুদ্ধের কারণ হিসেবে ইংরেজ রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, ইংরেজ কর্মচারীদের অসম্মানজনক আচরণ, রাজমাতা ঝিন্দনের নির্বাসন, মূল রাজের বিদ্রোহ ঘোষণা, ইংরেজ কর্মচারীর মৃত্যু, দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ, শিখদের পরাজয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত পাঞ্জাব, দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের ফলাফল ও সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।

১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ

সময়কাল১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ
বিবাদমান পক্ষইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও শিখ শক্তি
ফলাফলশিখদের পরাজয় ও শিখ শক্তির পতন
গভর্নর জেনারেললর্ড ডালহৌসি
দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ

ভূমিকা :- স্বাধীনতা-প্রিয় শিখদের পক্ষে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ -এর পর স্বাক্ষরিত লাহোরের অপমানজনক সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব হয় নি।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের কারণ

নিম্নলিখিত কারণ গুলির জন্য অচিরেই দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যেমন –

(১) ইংরেজ রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ

লাহোরে ইংরেজ সেনাদলের অবস্থিতি, ইংরেজ রেসিডেন্ট হেনরি লরেন্স-এর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও শিখ নেতৃবৃন্দের প্রতি অপমানজনক ব্যবহারশিখদের রাগ বৃদ্ধি করে।

(২) ইংরেজ কর্মচারীদের অসম্মানজনক আচরণ

শিখ গুরুদ্বার ও নারীদের প্রতি ইংরেজ কর্মচারীদের অসম্মানজনক আচরণ, ইংরেজ অধিকৃত জলন্ধর দোয়াবে ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি এবং লাল সিং-কে উজিরের পদ থেকে বিতাড়ন প্রভৃতি ঘটনা শিখদের প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

(৩) রাজমাতা ঝিন্দনের নির্বাসন

এই সময় রাজমাতা ঝিন্দন-কে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে চূনার দুর্গে নির্বাসিত করা হলে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

(৪) মূলরাজের বিদ্রোহ ঘোষণা

ইতিমধ্যে স্যার হেনরি লরেন্স মূলতানের (পাঞ্জাবের অধীন) শাসনকর্তা মূলরাজ-এর কাছে পঁচাত্তর লক্ষ টাকা দাবি করলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মূলরাজের স্থলে মান সিংহ-কে মুলতানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।

(৫) ইংরেজ কর্মচারীর মৃত্যু

দু’জন ইংরেজ কর্মচারী-সহ মান সিংহ মুলতানে উপস্থিত হন। মুলতান দুর্গের বাইরে এই দুই ইংরেজ কর্মচারী নিহত হন। বলা হয় যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মূলরাজ জড়িত ছিলেন।

(৬) শের সিংহের যোগদান

বিদ্রোহী মূলরাজকে দমনের জন্য শের সিং প্রেরিত হন, কিন্তু তিনি বিদ্রোহী দলে যোগদান করেন। হাজারার শাসনকর্তা ছত্তর সিংহ-ও এই সময় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ

এই সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমগ্র পাঞ্জাবে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পক্ষে দোস্ত মহম্মদের যোগদান

পেশোয়ার ফিরে পাবার আশায় আফগানিস্তানের আমির দোস্ত মহম্মদ শিখদের পক্ষে যোগদান করেন।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়

চিলিনওয়ালার যুদ্ধে (জানুয়ারি, ১৮৪৯ খ্রিঃ) শিখরা জয়যুক্ত হয়, এবং অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেও গুজরাটের যুদ্ধে (ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৯ খ্রিঃ) তারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়।

গুজরাটের যুদ্ধ সম্পর্কে ম্যালেসনের অভিমত

গুজরাটের যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ম্যালেসন বলেন যে, “কোনও সেনাদল শিখ সেনা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট যুদ্ধ করে নি, এবং কোনও সেনাদল এত খারাপভাবে পরিচালিতও হয় নি।”

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত পাঞ্জাব

জয়ের আনন্দে কোম্পানির বিনা অনুমতিতেই ডালহৌসি এক ঘোষণাপত্র মারফৎ পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন (মার্চ, ১৮৪৯ খ্রিঃ)।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের ফলাফল

এই যুদ্ধের ফলে,

  • (১) সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় ও রণজিৎ সিংহ -এর প্রতিষ্ঠিত শিখরাজ্যের পতন ঘটে।
  • (২) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন আফগানিস্তান -এর সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
  • (৩) দলীপ সিংহ সিংহাসনচ্যুত হন এবং ইংরেজদের বৃত্তিভোগী হয়ে লণ্ডনে নির্বাসিত হন।
  • (৪) খালসা বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ সম্পর্কে সমালোচনা

  • (১) বিদ্রোহের অজুহাতে দলীপ সিংহের পদচ্যুতি ও ইংরেজদের পাঞ্জাব অধিকার নৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে কোনওক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়।
  • (২) মূলরাজের বিদ্রোহ ও তারফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য দলীপ সিংহ কোনওক্রমেই দায়ী ছিলেন না, কারণ পাঞ্জাব প্রশাসনের সকল দায়িত্বই তখন ইংরেজ রেসিডেন্টের ওপর ন্যস্ত ছিল।
  • (৩) দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের জন্য লর্ড ডালহৌসি শিখদের দায়ী করলেও জেমস মিল, কানিংহাম প্রমুখ  ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধের জন্য কোম্পানির আগ্রাসী নীতিকেই দায়ী করেছেন।
  • (৪) ট্রট্টার (Trotter)-এর মতে পাঞ্জাব জয়ের ক্ষেত্রে ডালহৌসির নীতিই ছিল “নীতিবর্জিত ও অযৌক্তিক।” বেল (Bell)-এর মতে পাঞ্জাব দখল হল ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা” (“a violent breach of trust”)।

উপসংহার :- এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, পাঞ্জাব জয়ের ফলে কোম্পানির সাম্রাজ্যের সীমা আফগানিস্তানকে স্পর্শ করে এবং এর ফলে কোম্পানি আফগান সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাঞ্জাব দখল না করলে আফগানিস্তান নিয়ে ইংরেজদের এতটা বিব্রত হতে হত না।

(FAQ) দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সময়কাল কত?

১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ।

২. কোন যুদ্ধে শিখরা চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয়?

গুজরাটের যুদ্ধ (ফেব্রুয়ারি ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ)।

৩. চিলিনওয়ালার যুদ্ধ কবে, কাদের মধ্যে হয়?

জানুয়ারি, ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি ও শিখ শক্তি।

৪. চিলিনওয়ালার যুদ্ধে কারা জয়ী হয়?

শিখশক্তি।

৫. দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সময় গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

লর্ড ডালহৌসি।

৬. পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন কে?

লর্ড ডালহৌসি।

Leave a Comment