সেফটি ভালভ তত্ত্ব

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেফটি ভালভ তত্ত্বের উৎপত্তি, ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা, গোপন প্রতিবেদন, সেফটি ভালভ তত্ত্বের পটভূমি হিসেবে ভারতীয়দের ক্ষোভ, কৃষক বিদ্রোহ, শিক্ষিত সমাজের বিক্ষোভ, গণবিদ্রোহের পরিস্থিতি, সেফটি ভালভ তত্ত্বের সমালোচনা ও সেফটি ভালভ তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানবো।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় সেফটি ভালভ তত্ত্ব প্রসঙ্গে ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধক সেফটি ভালভ হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, সেফটি ভালভ তত্ত্ব বা নিরাপত্তা ভালভ তত্ত্ব, কংগ্রেসের ভিত্তি সম্পর্কে সেফটি তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান, জাতীয় কংগ্রেস গঠনে সেফটি ভালভ তত্ত্বের ব্যাখ্যা, সেফটি ভালভ তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য ও সেফটি ভালভ তত্ত্বের সমালোচনা সম্পর্কে জানব।

সেফটি ভালভ তত্ত্ব

বিষয়সেফটি ভালভ তত্ত্ব
উৎসওয়েডারবার্ণ রচিত হিউমের জীবনী
বিষয়জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা
প্রধান ব্যক্তিত্বঅ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম ও লর্ড ডাফরিন
তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতাচরমপন্থী নেতৃবৃন্দ
সেফটি ভালভ তত্ত্ব

ভূমিকা :- সেফটি ভালভ তত্ত্বটি ভারতের চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। লালা লাজপৎ রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল এবং অন্যান্যরা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা

‘অসুখী ভারত‘ এবং ‘পাঞ্জাবি’ লালা লাজপত রায়ের লেখা দুটি বই। তিনি এই দুটি বইয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ব্রিটিশ নীতির ব্যাখ্যা ও সমালোচনা করেছেন।

গোপন প্রতিবেদন

১৮৭৮ সালে, হিউম নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ এবং ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে সাত খণ্ডের গোপন প্রতিবেদন আবিষ্কার করেন।

সেফটি ভালভ

লালা লাজপত রায়ের মতে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লর্ড ডাফরিন এবং এ.ও. হিউমের ষড়যন্ত্রে সেফটি ভালভ হিসেবে।

সেফটি ভালভ তত্ত্বের উৎপত্তি

জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেফটি ভালভ তত্ত্বটি ১৯১৩ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম ওয়েডারবার্নের লেখা হিউমের জীবনী থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।

সেফটি ভালভ তত্ত্বের পটভূমি

সেফটি ভালভ তত্ত্ব বা নিরাপদ সংগঠন হিসেবে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন –

(১) ভারতীয়দের ক্ষোভ

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সারা ভারতে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আফগানিস্তান ও উত্তর বার্মায় যুদ্ধজনিত প্রবল ব্যয়ভার, রাজস্বের চড়া হার, দুর্ভিক্ষ, মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।

(২) কৃষক বিদ্রোহ

মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, দাক্ষিণাত্য, পাবনা প্রভৃতি স্থানে তখন চলছিল কৃষক বিদ্রোহ। সমকালীন সরকারি নথিপত্রে দেশবাসীর এই অসন্তোষের পরিচয় মিলবে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লিখিত এক পত্রে কার্ল মার্কসও ব্রিটিশ ভারতের এই বিক্ষুব্ধ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন।

(৩) শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ক্ষোভ

অস্ত্র আইন, মাতৃভাষায় সংবাদপত্র আইন, ইলবার্ট বিল, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রভৃতি নিয়ে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ও তখন প্রবল ক্ষুব্ধ।

(৪) গণবিদ্রোহের পরিস্থিতি

রজনীপাম দত্ত বলেন যে, দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় যাতে কৃষকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশে কোনও গণ-বিদ্রোহের সৃষ্টি না করে তা-ই ছিল হিউমের লক্ষ্য। এই কারণেই তিনি কংগ্রেস সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন।

সেফটি ভালভ তত্ত্বের সমালোচনা

বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক গবেষণায় ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব’ এবং ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ অগ্রাহ্য হয়েছে। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ অনিল শীল, ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী, ডঃ বিপান চন্দ্র, ডঃ সুমিত সরকার এই মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন যে,

  • (১) হিউম রাজস্ব, কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের সচিব ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের কঠোর শৃঙ্খলার দিনে তাঁর পক্ষে স্বরাষ্ট্র বিভাগের গোপন নথি দেখা কখনোই সম্ভব ছিল না।
  • (২) হিউম ছিলেন সিমলায়, কিন্তু স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র থাকত দিল্লিতে।
  • (৩) লালা লাজপৎ রায় প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভারতের অবস্থা যদি সত্যিই এত ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধের জন্য হিউমের অবসর গ্রহণের (১৮৭৯ খ্রিঃ) এত পরে কেন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল?
  • (৪) হিউম ও ডাফরিনের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ডাফরিনের সঙ্গে হিউম সাক্ষাৎ করলেও, কংগ্রেস সম্পর্কে ডাফরিন বিরক্তিই প্রকাশ করেন—এমনকী ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে বোম্বাই এর গভর্নর রিয়ে (Reay)-কে তিনি কংগ্রেস এবং ‘বাঙালিবাবু’ ও ‘মারাঠি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন।
  • (৫) তিনি হিউমকে একজন ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত, মিথ্যাবাদী’ মানুষ বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মসূচিকেও তিনি পছন্দ করতেন না।
  • (৬) ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, হিউম বা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যাই বলুন না কেন, ডাফরিন কোনওদিনই চাননি যে কংগ্রেস রাজনৈতিক আলোচনায় নামুক।
  • (৭) ১৮৮৮-তে সেন্ট এ্যান্ড্রুজের ভোজসভায় তিনি জাতীয় কংগ্রেসকে ‘আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু’ (Microscopic minority) গোষ্ঠী বলে ব্যঙ্গ করেন। স্বভাবতই ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।
  • (৮) সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সাত খণ্ডের ঐ তথাকথিত দলিলপত্রের কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

সেফটি ভালভ তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য

বিতর্ক থাকলেও সেফটি ভালভ তত্ত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন –

  • (১) এই তত্ত্ব অনুসারে, হিউম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই আশায় যে এটি ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের জন্য একটি “সুরক্ষা ভালভ” হিসাবে কাজ করবে। সেই লক্ষ্যে তিনি লর্ড ডাফরিনকে প্ররোচিত করেন কংগ্রেস গঠনে বাধা না দেওয়ার জন্য।
  • (২) তারা জনগণকে তাদের রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য একটি ফোরাম প্রদান করতে চেয়েছিল। ফলস্বরূপ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি সুরক্ষা ভালভ হিসাবে কাজ করবে।
  • (৩) লালা লাজপত রায়ের মতো চরমপন্থী নেতারা সেফটি ভালভ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। এমনকি মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব”সেফটি ভালভ’ ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।
  • (৪) এই “সেফটি ভালভ” ধারণাটি আধুনিক ভারতীয় ঐতিহাসিকদের দ্বারা বিতর্কিত।
  • (৫) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি প্রকাশ করার জন্য একটি জাতীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতন ভারতীয়দের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
  • (৬) ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান জোয়ারের সাথে, ব্রিটিশ নীতির প্রতি ভারতীয়দের শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। তাই ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে পরিচিত একটি নিরাপদ সংগঠন থাকবেভারতে ব্রিটিশ সরকার এবং ভারতীয় জনগণের মধ্যে।
  • (৭) সেফটি ভালভ তত্ত্বের ধারণা অনুসারে, ব্রিটিশরা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ-এর মতো আরেকটি বিদ্রোহের পরিস্থিতি এড়াতে চেয়েছিল।
  • (৮) তারা জনগণকে তাদের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি সংগঠন প্রদান করতে চেয়েছিল।
  • (৯) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কোনো ভারতীয় দ্বারা নয় বরং একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
  • (১০) জন অসন্তোষের বিরুদ্ধে “সেফটি ভালভ” হিসাবে প্রাক্তন সিভিল সার্ভিসেস সদস্যের সহায়তায় ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা গেছে।

উপসংহার :- প্রথম সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল হিন্দু। মুসলমানরা প্রথমে কংগ্রেসের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেও সেখানে সক্রিয় নেতা ছিলেন বদরুদ্দীন তৈয়াবজী

(FAQ) সেফটি ভালভ তত্ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সেফটি ভালভ তত্ত্ব কি?

ভারতে ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধক সেফটি ভালভ হিসাবে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম জাতীয় কংগ্রেস গঠন করার যে পরিকল্পনা করেন তা ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

২. কে কোন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সেফটি ভালভ তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন?

অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম।

৩. সেফটি ভালভ তত্ত্বের উৎস কী?

উইলিয়াম ওয়েডারবার্ণ রচিত হিউমের জীবনী।

Leave a Comment