রোশেনারা

ভারতের মোঘল সম্রাট শাহজাহান কন্যা রোশেনারা প্রসঙ্গে রোশেনারার জন্ম, রোশেনারার পিতামাতা, রোশেনারার শৈশব, অন্দরমহলে রোশেনারার জীবন, রোশেনারার রাজনৈতিক জীবন ও রোশেনারার মৃত্যু সম্পর্কে জানব।

শাহজাহান কন্যা রোশেনারা

ঐতিহাসিক চরিত্ররোশেনারা
পরিচিতিশাহজাহান তনয়া
মাতামমতাজমহল
বোনজাহানারা
ভাইঔরঙ্গজেব
রোশেনারা

রোশেনারা শাজাহানের একমাত্র কন্যা নন। তাঁর একটি বোন জীবিত ছিল – হাসন আরা বেগম । আর তার সুপরিচিত দিদি হল জাহানারা। জাহানারা আর রোশেনারার মধ্যে বয়সে পার্থক্য মোটামুটি তিন বছর পাঁচ মাসের।জাহানারার ঠিক পরের ভাইটি হলেন দারাশুকো আর রোশেনারার পিঠোপিঠি ভাই হলেন ঔরঙ্গজেব। বেশ একটা মজার ব্যাপার, দুই বোনই তাদের পিঠোপিঠি ছোট ভাইদের অসম্ভব ভালবাসতেন। আরও মজার ব্যাপার এই দুটি বোন এবং এই দুটি ভাইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার সদ্ভাব ছিল না বলে জাহানারা যেমন সইতে পারতেন না ঔরঙ্গজেবকে, রোশোনারা তেমনি পারতেন না দারাকে।

ঔরঙ্গজেব আর রোশেনারা সম্পর্কে জাহানারা নিজেই লিখেছেন, ‘তারা যে দারার শত্ৰু – আমার শত্ৰু। দারাকে ঔরঙ্গজেব বলতেন, বিধর্মী ‘কাফের’। ঔরঙ্গজেবের গোপন দরবারে ধৃত দারার বিচার-প্রহসনে যখন সাব্যস্ত হল এই ‘কাফেরে’র একমাত্র শাস্তি মৃত্যু, তখন বিদেশী দানিশমন্দ খান পর্যন্ত তার মুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন। শুনে রোশেনারা ক্ষেপে গিয়েছিলেন। দারার যাতে মৃত্যুদণ্ড হয় সেজন্য তিনি সর্বপ্রকার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি যে এক মায়ের পেটের বোন ! তাই এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় দারার মৃত্যুকে করলেন ত্বরান্বিত। সেজন্যই তো দারা যখন কুকুরের মতো তাড়া খেয়ে নিদারুণ দুঃখ ভোগ করছিলেন তিনি তত উল্লসিত হয়েছিলেন। সে ক্রোধের উপশম ঘটল দারার নিষ্করুণ মৃত্যুতেই কি? তা-ও বুঝি নয়। নইলে দারার রূপসী কন্যা জানি বেগমকে যখন রোশেনারার কাছে পাঠানো হয়েছিল তখন রোশেনারা এই পিতৃহীনার সঙ্গে কি নৃশংস ব্যবহারই না করেছিলেন। আক্রোশটা জ্বলেই চলেছিল তুষের আগুনের মত ধিকি ধিকি।

অথচ উল্টোদিকের ছবিটা কেমন মনোহর। ঔরঙ্গজেবকে ভালবাসতেন প্রাণ থেকে। দরবারে যা হচ্ছে গোপনে সংবাদ নিয়ে সেগুলি সব ঔরঙ্গজেবের কাছে চালান করে দিতেন। শাজাহানের পুত্ৰদের পারস্পরিক বিবাদে যিনি গোপনে ইন্ধন যোগাতেন তিনি এই রোশেনারা। জাহানারার সঙ্গে তার এমন মনোভাব কেন? তিনি দিদির মত সুন্দরী ছিলেন না বলেই কি? কিন্তু দেমাকে ছিলেন গরবিনী। ঐ রূপ নিয়েই তো কেচ্ছা করতে বাকী রাখেননি কিছু ৷ তার কামনার নিষিদ্ধ প্রকাশ মোঘল অন্দরমহল-এর খোজারা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছিল সে সময়ে।

অথচ শাহজাহান কি ভালবাসতেন না তার এই দুর্বিনীতা কন্যাকে ? ভালবাসতেন নিশ্চয়ই, তবে জাহানারার মতো নিশ্চয়ই নয়। সম্ৰাট হিসেবে শাহজাহান যেদিন অভিষিক্ত হয়েছিলেন দিল্লির সিংহাসনে সেদিন জাহানারার তুলনায় তার এই কন্যাটিকে অনেক কম উপহার দিয়েছিলেন। সকলকে যথোচিত দানের পর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা মুরাদ, লুৎফুল্লাহ, রোশেনারা এবং সুরাইয়া বেগমের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন মাত্র ৷

আর একবার ১৬২৮-এর নওরোজ উৎসব-এ শাহজাহান রোশেনারাকে দিয়েছিলেন ৫ লক্ষ টাকা মাত্র। সে সময়ে জাহানারা পেয়েছিলেন তার চারগুণ – বিশ লাখ টাকা। রোশেনারার হিংসে হবার কথা অবশ্যই ৷ কাজেই তিনি হয়ে পড়েছিলেন ঔরঙ্গজেবের পক্ষপাতী। রোশেনারা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তার ছোট ভাইটিই হবে ভবিষ্যৎ ভারত-এর একচ্ছত্র সম্রাট ৷ সুতরাং সিংহাসনের উত্তরাধিকারের যুদ্ধে তিনি সর্বপ্রকারে ঔরঙ্গজেবকে সাহায্য করতে লাগলেন। আর অন্যদিকে আগ্রার হারেম থেকে তার প্রতিপক্ষদের হটাবার চেষ্টায় একেবারে উন্মাদ হয়ে গেলেন। ঔরঙ্গজেবের জয়লাভের দিন যেন রোশেনারারও জয়। আবার দারার মৃত্যুদিনও তার জয়ের দিন। জাহানারা লিখেছেন, ‘রোশেনারা দারার মৃত্যুর পর বিজয়িনীর গৌরবে এক বিরাট ভোজের ব্যবস্থা করেছিল।’

১৬৫৯-এর জুন রাজ্যাভিষেকের আড়ম্বরপূর্ণ দিনটিতে ঔরঙ্গজেব ছোড়দির এই আনুকুল্য কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন। অন্য কোনো বোনকে যা দেননি সেই পুরস্কারে রোশেনারাকে করলেন সম্মানিত। পুরো পাঁচটি লক্ষ টাকা তার এই সহযোগী দিদিটির হাতে সুস্মিত আননে তুলে দিলেন। আর দিলেন স্বাধীন ব্যবহারের ঢালাও আদেশ। ঔরঙ্গজেবের স্ত্রীগণ ও পুত্রেরা রোশেনারার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে বাস করতে লাগলেন। শাজাহানের মৃত্যুকাল পর্যন্ত রোশেনারা এমন একটি নিসপত্ন অধিকার ভোগ করেছিলেন। এর পরেই দুর্ভাগ্য রোশেনারার, তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীনী জাহানারা দিল্লি সম্ৰাট ঔরঙ্গজেবের অন্দরমহল-এ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ঔরঙ্গজেব তার এই কুটচক্রী দিদি রোশেনারাকে যেন আর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেটাই তার স্বভাব। রোশেনারা ধীরে ধীরে চলে গেলেন যবনিকার আড়ালে।

কিন্তু কেন? কি অপরাধ রোশেনারার ? ঔরঙ্গজেব কি এতদূরই অকৃতজ্ঞ, যে বোন তার জীবনে চলার পথে এতখানি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে অগ্নিকুণ্ড এক অন্দরমহল থেকে – তাকে একেবারে পদদলিত করে দেবেন? অকৃতজ্ঞতা মোগল ইতিহাসে নতুন কোনো কথা নয়। তবে কি রোশেনারা তার ক্ষমতার সীমাহীনতায় পৌঁছে গিয়ে তার অপব্যবহার করছিলেন? ঘটনাটা তাই-ই।

ঔরঙ্গজেব প্রবল অসুস্থ (মে ১৬৬২)। রোশেনারা সেই সুযোগে তার রাজপ্রদত্ত শক্তির অপব্যবহার করতে লাগলেন। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে বালক রাজকুমার আজমকে সিংহাসনে বসানোর চক্ৰান্ত করতে লাগলেন। ভাল হয়ে সব কথা জানতে পারলেন ঔরঙ্গজেব। আর রাগে ফেটে পড়তে লাগলেন তিনি।

তাছাড়া একটি পর্তুগীজ দো-আঁশলা ক্রীতদাসী ভিতরের আরও কথা রটনা করলেন। রোশেনারা নাকি খোজাদের সহযোগিতায় ব্যভিচারের জীবন যাপন করে চলেছিলেন। আর ঔরঙ্গজেব নাকি সব শুনে বিষ পাঠিয়ে বোনের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। বিষের প্রভাবে ফুলে ঢোল হয়ে নাকি তার মৃত্যু হয়েছিল !

তবুও ইতিহাসে তার দয়ার সাক্ষ্যেরও অভাব নেই। কিন্তু সে সব গুণ তার পর্বতপ্রমাণ দোষের অন্তরালে চিরকালের জন্য অন্তরালবর্তী হয়ে গেছে।

(FAQ) রোশেনারা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য

১। রোশেনারা কে ছিলেন?

ভারতের মোঘল সম্রাট শাহজাহানের কন্যা হলেন রোশেনারা।

২। রোশেনারার মায়ের কী?

মমতাজমহল

৩। রোশেনারার বোনের নাম কী?

জাহানারা

৪। উত্তরাধিকার যুদ্ধে রোশেনারা কার পক্ষ নিয়েছিলেন?

ঔরঙ্গজেব

Leave a Comment