রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল

রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল প্রসঙ্গে সুফল হিসেবে আধুনিক যুগের সূচনা, ভূমিদাসদের স্বাধীনতা, ডেভিড টমসনের মন্তব্য, কৃষির উন্নতি, শিল্পের বিকাশ, মুক্তিদাতা জার, কুফল হিসেবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, কৃষকদের দুর্দশা বজায়, জালিয়াতি ও নিষ্ঠুর পরিহাস, জমির অধিক মূল্য, করের বোঝা, ভূমিদাসদের পক্ষে অনুর্বর জমি, জমিদারদের উচ্চ হারে কর প্রদান, অল্প নিকৃষ্ট জমি, শোচনীয় অবস্থা, মীরের কর্তৃত্ব, বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত, জারের মৃত্যু এবং মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদী মতাদর্শের প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল

ঐতিহাসিক ঘটনারাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল
সময়কাল১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ
বিলোপ ঘটানজার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার
মুক্তিদাতা জারদ্বিতীয় আলেকজান্ডার
ডিসেমব্রিস্ট বিদ্রোহ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ
রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল

ভূমিকা:- জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জানুয়ারি রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথা বিলোপ -এর উদ্দেশ্যে মুক্তির ঘোষণাপত্র জারি করেন। ‘মুক্তির ঘোষণাপত্র’ বা ভূমিদাসদের মুক্তি রাশিয়ার ইতিহাসে এক অতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল

মুক্তির ঘোষণাপত্র বা ভূমিদাসদের মুক্তি রাশিয়ার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও এর সুফল এবং কুফল দুইই ছিল।

(ক) সুফল

মুক্তির ঘোষণাপত্রের কতকগুলি সুফল লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) আধুনিক যুগের সূচনা

রুশ ইতিহাসের এক অতি কলঙ্কময় ও মধ্যযুগীয় কুপ্রথার অবসান ঘটে, রাশিয়ায় আধুনিক যুগের সূচনা হয় এবং রাশিয়াতে বেশ কিছু প্রগতিশীল সংস্কারের পথ খুলে যায়।

(২) ভূমিদাসদের স্বাধীনতা

ভূমিদাসদের উপর থেকে সামন্তপ্রভু বা জমিদারদের কর্তৃত্বের অবসান হয় এবং তারা মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করে। তারা ইচ্ছামতো স্থানান্তর গমন চুক্তি সম্পাদন, জীবিকা পরিবর্তন এবং অন্যান্য অধিকার অর্জন করে।

(৩) ডেভিড টমসনের মন্তব্য

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন-এর মতে, এই মহান ঘটনা রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাস-এ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর মতে, এই ঘটনা রাশিয়াতে এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করে এবং রুশ জনজীবনে ব্যাপক পাশ্চাত্যকরণের দরজা খুলে দেয়।

(৪) লিপসন ও কোচান-এর মন্তব্য

ঐতিহাসিক লিপসন এই ঘটনাকে আলেকজান্ডারের সর্বাপেক্ষা ‘স্মরণীয় অবদান’ বলে অভিহিত করেছেন। কোচান-এর মতে, এই আইনটি আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করে।

(৫) কৃষির উন্নতি

রাশিয়ায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি ঘটে, কৃষির সম্প্রসারণ হয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, জমির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, রাজস্ব খাতে সরকারের আয় বৃদ্ধি পায় এবং বহির্বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।

(৬) শিল্পের বিকাশ

এই প্রথার অবসানের ফলে রাশিয়ায় শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। ‘মির’-গুলির নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মুক্ত ভূমিদাসরা শ্রমিক হিসেবে কলকারখানা, খনি, যানবাহন প্রভৃতি শিল্পে নিযুক্ত হতে থাকে। এর ফলে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের সূচনা হয়, কায়িক শ্রম-নির্ভরতার স্থলে যান্ত্রিক শ্রম-নির্ভরতা দেখা দেয় এবং রাশিয়ায় সংঘবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণির উন্মেষ ঘটে।

(৭) মুক্তিদাতা জার

রাশিয়ায় এই কুপ্রথার অবসান ঘটেছিল একমাত্র দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ব্যক্তিগত চেষ্টায়, কোনও বৈপ্লবিক ঘটনার জন্য নয়। সুতরাং তাঁকে ‘মুক্তিদাতা জার’ হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক নয়।

(খ) কুফল

উপরোক্ত সুফলগুলি থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক নানাভাবে এই আইনের সমালোচনা করেছেন। যেমন –

(১) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেন, “এই আইনের ফলে রুশ ভূমিদাসরা আইনগত স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায় নি।”

(২) কৃষকদের দুর্দশা বজায়

ঐতিহাসিক লিপসন বলেন যে, এই আইনের কিছু আইনগত গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল থাকলেও এর দ্বারা কিন্তু রুশ কৃষকদের কোনও দুর্দশা মোচন হয় নি।”

(৩) জালিয়াতি ও নিষ্ঠুর পরিহাস

কোচান-এর মতে, এই মুক্তি একটি জালিয়াতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঐতিহাসিক জে. এ. এস. গ্রেনভিল এই আইনকে ‘নিষ্ঠুর পরিহাস’ বলে অভিহিত করেছেন।

(৪) জমির অধিক মূল্য

মুক্ত ভূমিদাসদের যে জমি দেওয়া হয় এবং তার জন্য যে অর্থ ধার্য করা হয়, তা জমির ন্যায্য মূল্য অপেক্ষা অনেক বেশি ছিল। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে যে জমির দাম ছিল ৫৪৪ মিলিয়ন রুবল, সেই জমির জন্য মুক্ত ভূমিদাসদের দিতে হয় ৮৬৭ মিলিয়ন রুবল।

(৫) ওয়াটসনের মন্তব্য

ঐতিহাসিক সেটন-ওয়াটসন বলেন যে, ভূমিদাসদের যে জমি দেওয়া হয় তার মোট মূল্য কখনোই ২৮৪ মিলিয়ন রুবলের বেশি ছিল না, অথচ কেবল উত্তর রাশিয়া থেকেই ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করা হয়েছিল ৩৪১ মিলিয়ন রুবল।

(৬) করের বোঝা

মুক্ত ভূমিদাসদের উপর নানা রকম করের বোঝা চাপানো হয়, যা দেওয়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। জমিদারের কাছ থেকে প্রাপ্য জমির জন্য তাদের বার্ষিক কিস্তিতে ক্ষতিপূরণের টাকা সুদ-সহ পরিশোধ করতে হত এবং সেই সঙ্গে মেটাতে হত নানা ধরনের সরকারি কর। ভূমিকর ছিল উৎপন্ন ফসলের ২/৩ অংশ। এর ফলে কার্যত তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এইভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি মেটাতেই তাদের সারা জীবন কেটে যায়, তারা কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারে নি।

(৭) ভূমিদাসদের পক্ষে অনুর্বর জমি

জমি বণ্টনের সময় সেচের সুবিধাযুক্ত ভালো উর্বর জমিগুলি জমিদারের ভাগে পড়ে। সেখানে পুকুর, গো-চারণক্ষেত্র, নিকাশি নালা সব কিছুরই সুবিধা ছিল। অপরপক্ষে, ভূমিদাসদের ভাগে পড়ে অনুর্বর, বন্ধ্যা, বালুকাময় ও জলাজমি, যেখানে ফসল উৎপন্ন হত খুবই কম।

(৮) জমিদারদের উচ্চ হারে কর প্রদান

জমি বণ্টন এমনভাবে করা হয়েছিল যার ফলে জমিদারের জমির জল, নিকাশি নালা বা গোচারণক্ষেত্র ব্যতীত ভূমিদাসের পক্ষে জমি চাষ করা কখনোই সম্ভব ছিল না। এইসব সুবিধা পাওয়ার জন্য ভূমিদাস জমিদারকে উচ্চহারে কর দিতে বাধ্য ছিল।

(৯) নিকৃষ্ট ও অল্প জমি লাভ

উচ্চ হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সত্ত্বেও ভূমিদাস পেয়েছিল নিকৃষ্ট জমি এবং সেই জমির পরিমাণও ছিল সামান্য। এতে তাদের ভরণপোষণ না হওয়ায় ভূমিদাস পুনরায় জমিদারের অবশিষ্ট জমিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। এর জন্য তাকে উচ্চ হারে খাজনা দিতে হয়।

(১০) শোচনীয় অবস্থা

ভূমিদাসদের মধ্যে অনেকে অর্থাৎ যারা জমির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তারা কোনও জমি পায় নি। তারা স্বাধীন শ্রমিক হিসেবে কলকারখানায় কাজ করতে থাকে। অনেকে আবার মজুর হিসেবে জমিদারের জমিতেই কাজ শুরু করে। জমিদারের প্রাপ্য মেটাতেই তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

(১১) মিরের কর্তৃত্ব

আগে ভূমিদাসদের উপর জমিদারদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু মুক্তিলাভের পর জমিদারের পরিবর্তে তাদের উপর ‘মির’-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদারের কাছ থেকে প্রাপ্ত জমির জন্য তারা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য ছিল, কিন্তু সেই জমির উপর তাদের কোনও মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তারা সেই জমি দান, বিক্রি বা বন্ধক দিতে পারত না। জমির প্রকৃত মালিক ছিল ‘মির’। ‘মির’ তাদের উপর কর ধার্য করত, রাষ্ট্র-আরোপিত কর আদায় করত ও নানা ধরনের অত্যাচার চালাত। মিরের নির্দেশ ছাড়া ভূমিদাস গ্ৰামান্তরে যেতে পারত না।

(১২) বিদ্রোহের পথ প্রশস্ত

এই আইন দ্বারা কৃষক, ভূমিদাস, জনগণ বা দেশের কোনও উপকার হয় নি, কৃষিব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয় নি, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কোনও সমৃদ্ধি ঘটে নি বা দেশে কোনও স্থায়ী বা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে নি বরং ভূমিদাসদের তা বিক্ষুব্ধ করে বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়।

(১৩) জারের মৃত্যু

এই আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার এক বছরের মধ্যেই এক হাজারেরও বেশি ভয়ঙ্কর ধরনের কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে আততায়ীর বোমার আঘাতে মৃত্যুর আগে ‘মুক্তিদাতা জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ১৮৬৬, ১৮৭৩ এবং ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে অন্তত তিনবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান।

(১৪) মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদী মতাদর্শের প্রভাব

বিক্ষুব্ধ জনগণ অতি সহজেই পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদী মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত

উপসংহার:- অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, ভূমিদাসদের মুক্তি তাদের কাছে অবিমিশ্র আশীর্বাদ না হলেও ভূস্বামীদের কাছে এই সংস্কার স্বাগত ছিল। এই সংস্কারের ফলে প্রায় ৫০ শতাংশ আবাদি জমি ভূস্বামীরা লাভ করেছিল, ভূমিদাসদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে তারা অব্যাহতি লাভ করেছিল এবং মানবসম্পদের মালিকানার পরিবর্তে তারা প্রচুর ক্ষতিপুরণ পায়। এই পরিবর্তনে অভিজাত সম্প্রদায় দুর্বল হয় নি, বরং শক্তিশালীই হয়।

(FAQ) রাশিয়ায় ভূমিদাসদের মুক্তির ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথার বিলোপ সাধন করেন কে?

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।

২. রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার উচ্ছেদ বা মুক্তির ঘোষণাপত্র কবে জারি করা হয়?

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।

৩. মুক্তিদাতা জার কাকে বলা হয়?

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।

Leave a Comment