ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল

ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল হিসেবে ভূগোল ও ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, ঔপনিবেশিকতাবাদ মেক্সিকোর স্বর্ণভাণ্ডার, মর্যাদা বৃদ্ধি, ক্রীতদাস আমদানি, সোনা আমদানি, নতুন বাণিজ্য পথ, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, ইতালির বাণিজ্য হ্রাস ও কৃষির উন্নতি সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপের ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল

ঐতিহাসিক ঘটনাভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল
সময়কালপঞ্চদশ শতক
অগ্ৰণী দেশস্পেন, পোর্তুগাল
কম্পাস আবিষ্কারদ্বাদশ শতাব্দী
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ
ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল

ভূমিকা :- পঞ্চদশ শতক ও তার পরবর্তীকালে ইউরোপীয় দেশ গুলির সামুদ্রিক অভিযান বা ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল বা তাৎপর্য ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল

ভৌগলিক আবিষ্কারের বিভিন্ন ফলাফল গুলি ছিল নিম্নরুপ। –

(১) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ভূগোল ও ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধি

  • (ক) নতুন এই ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীর নানা স্থানের ভূগোল ও প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে ইউরোপ -এর জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জলবায়ু ও মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে নানা কথা জানা যায়। ভৌগোলিক গবেষণা বৃদ্ধি পায়।
  • (খ) সমুদ্রের মানচিত্র রচনা এবং অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে সমুদ্র ও পৃথিবীকে বিভক্ত করে বিভিন্ন দেশের অবস্থান নির্ণয়ের কাজ সহজ, হয়। সমুদ্রের কোন অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি হয় এবং কখন সমুদ্র শান্ত থাকে এইসব তথ্যাদি জানা যায়।
  • (গ) নতুন মহাদেশ আমেরিকা আবিষ্কারের ফলে সর্বপ্রথম এই মহাদেশের নানা সভ্যতার কথা জানা যায়। এই সময়েই প্রথম মধ্য আমেরিকার ‘মায়া’ ও ‘আজটেক’ সভ্যতা এবং দক্ষিণ আমেরিকার ‘ইন্কা’ সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
  • (ঘ) বিভিন্ন দেশ, সভ্যতা ও মানব সমাজের সংস্পর্শে আসার ফলে ইউরোপীয়দের মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হয়। নতুন দেশ ও সভ্যতা সম্পর্কে এইসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় সাহিত্যে দেখা যায়।

(২) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ

  • (ক) পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ‘সাগরীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ‘মহাসাগরীয়’ ব্যবসা-বাণিজ্যে পরিণত হয়।
  • (খ) আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে সামুদ্রিক বাণিজ্য পৃথিবীময় বিস্তৃত হয়। জলপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। এইভাবে বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
  • (গ) ভূমধ্যসাগরের পথে প্রাচ্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলার ফলে এতদিন ইতালীয় নগরগুলিই এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এর ফলে ইতালীয় নগরী ভেনিস, জেনোয়া, পিসা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল।
  • (ঘ) ইতিমধ্যে আটলান্টিকের জলপথ আবিষ্কৃত হওয়ায় ভূমধ্যসাগরের গুরুত্ব কমে যায়। এর ফলে ইতালীয় নগরীগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে। পর্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস), ইংল্যান্ড সেই বাণিজ্য দখল করে। আমস্টারডাম, ঘেন্ট, মার্সাই, তুলোঁ, লন্ডন প্রভৃতি শহর সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। সমুদ্রপথে মাল চলাচলের প্রয়োজনে নৌ-নির্মাণ কেন্দ্র ও নৌ-বন্দরগুলির ব্যাপক প্রসার ঘটে।
  • (ঙ) এশিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন বিলাস-সামগ্রী ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপীয়রা আমেরিকার কাছ থেকে শেখে আলু, টম্যাটো ও তামাকের চাষ এবং এশিয়া থেকে শেখে চা ও কফির ব্যবহার। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচারকরাও বণিকদের সঙ্গে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে শুরু করেন।

(৩) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ঔপনিবেশিকতাবাদের বিস্তার

  • (ক) বাণিজ্যের সূত্র ধরে ইউরোপীয় দেশগুলি প্রাচ্যের দেশগুলিতে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন শুরু করে। পৃথিবীর নানা স্থানে পর্তুগাল, স্পেন ও পরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়।
  • (খ) উপনিবেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাঁচামাল সংগ্রহের উৎস ও উৎপাদিত পণ্যাদি বিক্রির খোলা বাজারে পরিণত হয়। এইসব উপনিবেশগুলির অধিবাসীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার ও সীমাহীন শোষণ চালানো হত। জোর করে তাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হত।
  • (গ) স্পেন ও পর্তুগাল তাদের অধিকৃত দেশগুলির অধিবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুঠত। পরে ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিরাও এই ব্যবসায় লিপ্ত হয়। আমেরিকায় নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হওয়ায় আফ্রিকার নিগ্রোদের বন্দি করে আমেরিকায় শ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত করা হতে থাকে।

(৪) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে মেক্সিকোর স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান

  • (ক) মেক্সিকো, পেরু প্রভৃতি অঞ্চলে স্পেনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অঞ্চলে সোনার খনি আবিষ্কৃত হয় এবং তার উপর স্পেনের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে স্পেন অতি শক্তিশালী ও ধনবান দেশে পরিণত হয়।
  • (খ) অধ্যাপক কার্লটন হেজ (Carlion Hayes) বলেন যে, বিনা পরিশ্রমে বিপুল সম্পদের মালিকানা পেয়ে স্পেন উৎপাদনমুখী অর্থনীতি ত্যাগ করে এবং আমোদ-প্রমোদ, ষাঁড়ের লড়াই, কবিতা রচনা প্রভৃতিতে সময় কাটাতে থাকে।
  • (গ) তিনশো বছর পর মেক্সিকো ও পেরুর স্বর্ণভাণ্ডার শেষ হয়। দীর্ঘদিন ধরে স্পেনের লোকেরা পরিশ্রম-সাপেক্ষ কাজ করে নি। এর ফলে স্পেন একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়।

(৫) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপের মর্যাদা বৃদ্ধি

ভৌগোলিক আবিষ্কারে সফল দেশগুলি ইউরোপে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। সফল সামুদ্রিক অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতা করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত হন।

(৬) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ক্রীতদাস আমদানি

স্পেন, পোর্তুগাল, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ ভৌগোলিক সম্প্রসারণের দ্বারা আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষের উপর নিদারুণ অত্যাচার চালিয়ে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে।এই ক্রীতদাসদের ইউরোপে আমদানি করা হত।

(৭) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে প্রচুর সোনা আমদানি

আমেরিকা থেকে প্রচুর পরিমাণ সোনা ও রুপা ইউরোপে আমদানি করা হলে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।

(৮) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে নতুন বাণিজ্যপথের সন্ধান

ভৌগোলিক অভিযানের দ্বারা বিভিন্ন নতুন বাণিজ্য পথের সন্ধান পাওয়া যায়।এর ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগের পূর্বেকার গুরুত্বপূর্ণভূমধ্যসাগরীয় পথ তার গুরুত্ব ও মর্যাদা হারায়।

(৯) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশ

ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে।ইউরোপে যৌথ বাণিজ্যিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যেগুলি আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়।

(১০) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইতালির বাণিজ্য হ্রাস

ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় পথের গুরুত্ব কমলে ইতালির বাণিজ্যে যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ইতালির জেনোয়া, ভেনিস, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি শহরের বাণিজ্যিক প্রাধান্য ও গুরুত্ব নষ্ট হয়।

(১১) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে কৃষির উন্নতি

ভৌগলিক অভিযানের দ্বারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে উভয় অঞ্চলের মধ্যে কৃষি প্রযুক্তি ও কৌশলের আদান-প্রদান ঘটে। এর ফলে কৃষির উন্নতি সাধন হয়।

উপসংহার :- সামুদ্রিক অভিযানের সূত্র ইউরোপে বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি প্রভৃতির বিকাশ ঘটে। এর ফলশ্রুতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ঘটে, যারা শীঘ্রই প্রগতিশীলতা ও বিপ্লবের পথপ্রদর্শক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(FAQ) ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সময়ে ভৌগোলিক অভিযান শুরু হয়?

পঞ্চদশ শতকে।

২. দিক নির্ণয় করা যন্ত্রের নাম কি?

কম্পাস।

৩. ভৌগোলিক অভিযানে সাহায্যকারী উল্লেখযোগ্য রাজা ও রানীর নাম লেখ।

স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা।

৪. ভৌগোলিক আবিষ্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য কি ছিল?

বাণিজ্যের প্রসার।

Leave a Comment