ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ

ভৌগোলিক আবিষ্কার, ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ হিসেবে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, শহরের চাহিদা, নবজাগরণের প্রভাব ক্রুসেডের প্রভাব, মার্কোপোলোর বিবরণ, কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন, ধর্ম প্রচার, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, বাণিজ্যিক স্পৃহা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, অভ্যন্তরীণ সুস্থিতি, রাজা সহায়তা, চার্চের উৎসাহ দান ও জনসংখ্যার হ্রাস সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপের ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ
সময়কালপঞ্চদশ শতক
অগ্ৰণী দেশস্পেন, পোর্তুগাল
কম্পাস আবিষ্কারদ্বাদশ শতাব্দী
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ
ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ

ভূমিকা :- পঞ্চদশ শতকের আগে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সম্পর্কে ইউরোপবাসীর কোনও ধারণাই ছিল না। টলেমির ‘ভৌগোলিক বিবরণ’-ই ছিল একমাত্র বই, যা থেকে তারা পৃথিবী সম্পর্কে একটি ধারণা পেত।

ইউরোপের বাণিজ্য বন্ধ

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপ -এর কিছু বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এই অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে সে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে ইউরোপের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় এবং ইউরোপের অর্থনীতি কৃষি-নির্ভর হয়ে পড়ে।

অজানাকে জানার আগ্রহ

এই অবস্থায় নবজাগরণ মানুষের মনে অজানাকে জানার আগ্রহ প্রবলভাবে বৃদ্ধি করে। এর ফলে একদল মানুষ দুঃসাহসে ভর করে নতুন নতুন দেশ ও জলপথ আবিষ্কারে রত হয়।

ভৌগোলিক আবিষ্কার

বণিক ও নাবিকদের চেষ্টায় ইউরোপে নতুন নতুন জলপথ আবিষ্কৃত হয় এবং ইউরোপের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই ঘটনা ‘ভৌগোলিক আবিষ্কার’ নামে খ্যাত।

ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ

ভৌগোলিক অআবিস্কারের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ।

(১) কৃষি ও শিল্প উৎপাদনবৃদ্ধি

মধ্যযুগের শেষ দিকে নানা ধরনের নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এর ফলে কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এইসব কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি বিক্রির জন্য নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজন দেখা দেয়।

(২) শহরের চাহিদা

এই সময়েই ইউরোপের নানা স্থানে নতুন নতুন অনেক শহর গড়ে ওঠে এবং শহরের জনসংখ্যাও ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। শহরের এইসব বাসিন্দাদের কাছে বিভিন্ন ভোগ্যবস্তুর প্রয়োজন ছিল। একদিকে নতুন বাজারের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরদিকে নবগঠিত শহরগুলির ক্রমবর্ধমান চাহিদা থেকেই নতুন দেশ আবিষ্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়।

(৩) নবজাগরণের প্রভাব

নবজাগরণ মানুষের মনে নানা অনুসন্ধিৎসু মনোভাব এবং অজানাকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক ফিশার (Fisher) বলেন যে, মানুষের জ্ঞানস্পৃহা বৃদ্ধি করে। এর ফলে একদল মানুষ যেমন নতুন সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানচর্চায় রত হয়, তেমনি আরেক দল মানুষ অদম্য উৎসাহ নিয়ে ভৌগোলিক আবিষ্কারে মনোনিবেশ করে। এই ব্যাপারে পর্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি দেশ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।

(৪) ক্রুসেডের প্রভাব

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে ইউরোপের বহু মানুষ মধ্যপ্রাচ্য অভিযানে যায়। এর ফলে প্রাচ্যের সুগন্ধি মশলা, মণিমুক্তা, রেশম, চন্দন, দামি পাথর প্রভৃতি নানা বিলাস-দ্রব্য ইউরোপে আসতে থাকে। এগুলির ব্যবসা করে ইতালির শহরগুলি খুব সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। এতে ইউরোপের অন্যান্য দেশের বণিকেরা খুব ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। তারা এই লাভজনক ব্যবসা হস্তগত করার চেষ্টা শুরু করে। এর থেকেই শুরু হয় প্রাচ্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন ও নতুন জলপথ আবিষ্কারের উদ্যোগ।

(৫) মার্কোপোলোর বিবরণ

  • (ক) ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ইউরোপের বহু বণিক ও পর্যটক প্রাচ্যদেশে আসতে শুরু করে।
  • (খ) ত্রয়োদশ শতকে মার্কোপোলো নামে ইতালির ভেনিস শহরের জনৈক বণিক প্রাচ্যের চীন, পারস্য, সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা), জাপান, ব্রহ্মদেশ, ভারত প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে ইউরোপে ফিরে যান।
  • (গ) তাঁর রচিত ভ্রমণ কাহিনি ‘মার্কোপোলোর ভ্রমণ’ পাঠ করে ইউরোপবাসী প্রাচ্যের অগাধ ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারে। এর ফলে ইউরোপে প্রাচ্যদেশ সম্পর্কে গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
  • (ঘ) পর্তুগালের যুবরাজ নাবিক হেনরি মার্কোপোলোর বিবরণ পাঠ করেই প্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে জলপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা-র সঙ্গে এই গ্রন্থই ছিল।
  • (ঙ) সুতরাং এইসব থেকেই বোঝা যায় যে, সমুদ্রপথে নতুন দেশ আবিষ্কারে এই গ্রন্থ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

(৬) কনস্টান্টিনোপলের পতন

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতন হলে তুর্কিরা ভূমধ্যসাগরের পথে প্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেয়। প্রাচ্যজাত দ্রব্যের অভাবে সমগ্র ইউরোপে গভীর সংকট দেখা দেয়। মশলার অভাব ইউরোপের সমস্যাকে তীব্রতর করে তোলে, কারণ মাংসই ইউরোপের প্রধান খাদ্য। মশলার অভাবে মাংস রান্নায় গভীর সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলে ইউরোপের নাবিকরা মশলা-দ্বীপের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।

(৭) ধর্মপ্রচার

কেবলমাত্র বাণিজ্যিক কারণই নয়—দেশ-দেশান্তরে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেও অনেকে এই সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারি ও রাজন্যবর্গের অনেকেই পৃথিবীর সর্বত্র খ্রিস্টের বাণী প্রচারকে নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করতেন এবং এই মানসিকতা থেকেই খ্রিস্টান মিশনারিরা বহুক্ষেত্রে নাবিকদের সহযাত্রী হতেন।

(৮) সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের ইউরোপ ছিল অভিজাত-প্রধান। এই সম্প্রদায় ইউরোপের বাইরে নতুন দেশ জয় করে তাদের ক্ষমতা দেখাবার চেষ্টা করে। নতুন দেশ আবিষ্কার ও জয় করলে ইউরোপীয় সমাজে তাদের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে—এই মানসিকতা থেকে অনেকে এই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হয়।

(৯) বাণিজ্যিক স্পৃহা

নতুন দেশে বাণিজ্য ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাও ছিল ইউরোপের সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য। পর্তুগিজ, স্পেনীয়, ওলন্দাজ, ইংরেজ প্রভৃতি জাতিগুলি এই উদ্দেশ্যনিয়েই এই অভিযানে যোগদান করে।

(১০) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার

  • (ক) নবজাগরণের সূচনাকালেই নাবিকের কম্পাস বা দিকনির্ণয়যন্ত্র, নক্ষত্র পরিমাপক যন্ত্র ও অ্যাস্ট্রোলেব বা অক্ষরেখা পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়।
  • (খ) ইতালির বাজারে তখন বিজ্ঞানসম্মত মানচিত্র ও মহাসমুদ্রের পথ-নির্দেশক মানচিত্রের অভাব ছিল না। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয়রা জানতে পারল যে, পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়— গোলাকার। সুতরাং পৃথিবীর যে কোনও স্থান থেকে রওনা হলে আবার সেই স্থানেই ফিরে আসা সম্ভব।
  • (গ) এই সময় দাঁড়-টানা নৌকোর মতো ছোটো ছোটো জাহাজের পরিবর্তে বড়ো বড়ো পালতোলা জাহাজ তৈরি শুরু হয়। এইসব নতুন আবিষ্কার মানুষকে সামুদ্রিক অভিযানে উদ্বুদ্ধ করে এবং এতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে পর্তুগাল ও স্পেন।

(১১) আভ্যন্তরীণ সুস্থিতি

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে পর্তুগালের শান্তি ও সুস্থিতি পরিবেশ ভিসার বিরাজ করায় পর্তুগাল নিশ্চিন্তে ভৌগোলিক অভিযানের দিকে মনোনিবেশ করতে পেরেছিল।

(১২) রাজকীয় সহায়তা

কোনো কোনো দেশের শাসকরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের বিষয়ে বিশেষভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় অভিযানের কাজ সহজ হয়েছিল। স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা ভৌগোলিক অভিযানে সেই দেশের নাবিকদের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

(১৩) চার্চের উৎসাহ দান

কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর ইসলামের প্রসার প্রতিহত করে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটানোর তাগিদ শুরু হয়ে যায়।এইজন্য দূর সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটানোর জন্য খ্রিস্টান চার্চও সামুদ্রিক অভিযানে উৎসাহ দেয়।

(১৪) জনসংখ্যার হ্রাস

চতুর্দশ শতকে ইউরোপে প্লেগের প্রাদুর্ভাবেঅসংখ্য মানুষের মৃত্যু হলে জনসংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমে যায়।জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস), ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নেয়।

উপসংহার :- পঞ্চদশ শতকের ভৌগোলিক আবিষ্কারের কাহিনী ছিল বহুদুঃসাহসী নাবিক ও অভিযাত্রীদের বীরত্বের কাহিনী। এইসব নাবিক ও অভিযাত্রীরা নিজেদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও জাতীয় গৌরব বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে অজানা সমুদ্রের পাড়ি দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল।

(FAQ) ভৌগোলিক আবিষ্কারের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সময়ে ভৌগোলিক অভিযান শুরু হয়?

পঞ্চদশ শতকে।

২. দিক নির্ণয় করা যন্ত্রের নাম কি?

কম্পাস।

৩. ভৌগোলিক অভিযানে সাহায্যকারী উল্লেখযোগ্য রাজা ও রানীর নাম লেখ।

স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা।

৪. ভৌগোলিক আবিষ্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য কি ছিল?

বাণিজ্যের প্রসার।

Leave a Comment