সুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

সুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে হিন্দুরা নিকৃষ্ট, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রমান, শরিয়ত মানতেন না, স্বৈরাচারী রাজা, পোত্তলিকদের দমন থেকে বিরত, ধর্মভীরু ফিরোজ শাহ তুঘলক, মন্দির ধ্বংস, হিন্দুদের উৎসবে যোগদান, জিজিয়া কর ও অমুসলিমরা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হত না বিষয়ে জানবো।

সুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা
জিজিয়াহিন্দু সম্প্রদায়
রাষ্ট্রের প্রভূখলিফা
ধর্মভীরুফিরোজ শাহ তুঘলক
দোলযাত্রা বা হোলি উৎসবমহম্মদ বিন তুঘলক
সুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

ভূমিকা :- ডঃ এ এল শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সুলতানি আমলে ভারতীয় হিন্দুরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। সুলতানি রাষ্ট্র শরিয়তী আইন দ্বারা শাসিত হত। হিন্দুদের সমমর্যাদা এই আইনে দেওয়া হত না।

সুলতানি শাসনে হিন্দুরা নিকৃষ্ট

হিন্দুদের ওপর বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর চাপান হত। গোঁড়া উলেমারা হিন্দুদের বিধর্মী হিসেবে ঘৃণা প্রকাশ করতেন। এমনকি তাদের জিম্মী অপেক্ষা নিকৃষ্ট গণ্য করা হত।

সুলতানি শাসনে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রমান

এই শ্রেণীর লেখকরা সুলতানদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রমাণ হিসেবে হিন্দু মন্দির ভাঙ্গার কথাও উল্লেখ করেন। তত্ত্বগত দিক থেকে উপরোক্ত মত কিছুটা ঠিক হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এই মতের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায় না।

দিল্লির সুলতানরা শরিয়ত মানতেন না

  • (১) সুলতানরা তাত্বিক দিক থেকে শরিয়ত মানলেও হাতে কলমে তা মানতেন না। শরিয়ত অনুযায়ী কোনো ইসলামীয় রাষ্ট্রে কোনো রাজা সিংহাসনে থাকতে পারেন না। কারণ, আল্লাহ হলেন সকল রাষ্ট্রের একমাত্র মালিক।
  • (২) আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে খলিফাই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রভু। আলাউদ্দিন খলজি ব্যতীত অন্যান্য দিল্লী সুলতানগণ খলিফার প্রতি আনুগত্য জানাতেন মুসলিম অভিজাত উলেমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষমতা রক্ষার জন্য।

সুলতানি শাসনে স্বৈরাচারী রাজা

আসলে সুলতানরা প্রত্যেকে ছিলেন স্বৈরাচারী রাজা। সামরিক শক্তিই ছিল তাদের ক্ষমতার উৎস। কাজেই এক্ষেত্রে তারা কার্যত শরিয়ত মানতেন না। আলাউদ্দিন খলিফাকেও মানতেন না। তিনি ও মহম্মদ বিন তুঘলক শাসনকার্যে উলেমাদের পরামর্শ নিতেন না। এর থেকে বুঝা যায় যে, সুলতানি শাসন সঠিকভাবে শরিয়ত সম্মত ছিল না।

পোত্তলিকদের দমন থেকে সুলতানরা বিরত

  • (১) সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মনীতির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ড: মুজিবের মতে, “মুসলিম ধর্মীয় আইন অনুযায়ী আহল-ই-কিতাব অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্রে যাদের নাম নেই তারা হল পৌত্তলিক। তাদের হত্যা বা দাসে পরিণত করা কর্তব্য”।
  • (২) কিন্তু দিল্লী সুলতানরা ছিলেন বাস্তববাদী। তাদের বিরাট সংখ্যক হিন্দু প্রজাকে এই নিয়মের অধীনে আনা সম্ভব নয় বলে তারা জানতেন। কাজেই ইসলামে পৌত্তলিকদের দমন করার জন্য যে সকল বিধান ছিল তারা তা প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতেন।

ধর্মভীরু ফিরোজ শাহ তুঘলক

ফিরোজ শাহ তুঘলকের মত ধর্মভীরু সুলতানও স্বীকার করেন যে তার প্রাসাদের পাশ দিয়ে প্রত্যহ হিন্দুরা যমুনাতে দেব-দেবীর মূর্তি বিসর্জন দিতে যায় শাখ, ঘণ্টা ও বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে। তিনি এই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই নেন না। কারণ তিনি অসহায়।

সুলতানি শাসনকালে মন্দির ধ্বংস

  • (১) একথা ঠিক যে তুর্কী বিজয়ের প্রথম দিকে বেশ কিছু সংখ্যক মন্দির ও নগর ধ্বংস হয়। উদাহরণস্বরূপ দিল্লির বিষ্ণু মন্দির ভেঙ্গে (মতান্তরে জৈন মন্দির) কুতুবমিনারের নিকটে কুওয়াৎ-উল-ইসলাম মসজিদ নির্মিত হয়।
  • (২) সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও কাতার জ্বালামুখী মন্দির ভেঙ্গে ফেলেন। কিন্তু তুর্কী বিজয়ের প্রথম দিকে তুর্কীদের বিজয় অভিযানের নায্যতা প্রতিপন্ন করতেই মন্দিরগুলি ভাঙ্গা হয়েছিল।
  • (৩) যুদ্ধের সময় আক্রান্ত দেশ ছিল সুলতানের শত্রুপক্ষ। সুতরাং শত্রু হিন্দু হোক বা শিয়া বা ইসমাইলি মুসলিম হোক তাকে ধ্বংস করাই ছিল সামরিক লক্ষ্য। এক্ষেত্রে শত্রুর মনোবল নষ্ট করার জন্য মন্দিরগুলি ভেঙ্গে ফেলা হত নিছক সামরিক ও রাজনৈতিক কারণে।
  • (৪) শরিয়তের হানাফী ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাম্রাজ্য-এর ভেতর ইসলামীয় নয় এমন ধরনের নতুন উপাসনা হল নির্মাণ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পুরাতন উপাসনা স্থল, বিশেষ করে মন্দির প্রভৃতি রক্ষা করার নির্দেশ ছিল। সুলতানরা শান্তির সময় এই নির্দেশ মোটামুটি মেনে চলতেন। যুদ্ধের সময় তাতে কিছু বিচ্যুতি ঘটত, যেমন ফিরোজ তুঘলকের আমলে ঘটেছিল।
  • (৫) তাছাড়া ড: মুজিবের মতে, হানাফি আইন বিধি অনুযায়ী সুলতান তার নিজ রাজ্যের ভেতর অবস্থিত পুরাতন মন্দিরগুলি রক্ষা করতে বাধ্য ছিলেন। রাজ্যের বাইরের মন্দির রক্ষা তিনি নাও করতে পারতেন। উড়িষ্যা ফিরোজের রাজ্যের ভেতর ছিল না। তাছাড়া তার বিজয়কে প্রতিপন্ন করার জন্যই সম্ভবত ফিরোজ পুরীর মন্দিরে ধ্বংস চালান।

সুলতানি শাসনে হিন্দুদের উৎসবে সুলতাদের যোগদান

  • (১) যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকত না তখন সুলতানি সাম্রাজ্যের অনুগত হিন্দু প্রজা ও রাজারা খোলাখুলি তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারত। জাকজমকের সঙ্গে হোলি, দশেরা প্রভৃতি উৎসব পালিত হত। মহম্মদ তুঘলকের মত উদারপ্রাণ, যুক্তিবাদী সুলতান তাতে যোগ দিতেন।
  • (২) মাঝে মাঝে রক্ষণশীল, অন্ধ বিশ্বাসী গোঁড়া উলেমারা অমুসলিমদের এই সকল ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ করার জন্য সুলতানি সরকারকে চাপ দিতেন। তাতে তেমন কোনো কাজ হত না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সহযোগিতার দাম সুলতানরা বুঝতেন।

দিল্লির সুলতানি শাসনে জিজিয়া কর

  • (১) জিজিয়া কর স্থাপন দ্বারা সুলতানি সরকার অমুসলিমদের ওপর বৈষম্যমূলক ধর্মকর চাপান এই মত যথার্থ নয়। জিজিয়া কর যদিও শরিয়তী কর ছিল, কিন্তু ভারতে জিজিয়ার অন্য অর্থ ছিল।
  • (২) ডঃ নিজামীর মতে জিজিয়াকে ভূমি কর ব্যতীত অমুসলিমদের প্রদেয় অন্য এক প্রকার কর হিসেবেই দেখা উচিত। ফিরোজ তুঘলক ছাড়া অন্যান্য সুলতানরা কাগজ কলমে জিজিয়ার কথা বললেও, হাতে কলমে তা আদায়ে বিশেষ উদ্যম দেখাতেন না।
  • (৩) কারণ, জিজিয়া আদায় ছিল বহু জটিল ও গোলযোগের ব্যাপার। এজন্য তারা ভূমিকর থেকে ক্ষতিপূরণ করতেন। ফিরোজ তুঘলক অবশ্য জিজিয়া আদায় করেন। ডঃ নিজামীর মতে, তাঁর এই কর না আদায় করাই উচিত ছিল।
  • (৪) ফিরোজ যেহেতু অন্যান্য বাড়তি কর রহিত করেন সেহেতু তিনি জিজিয়া আদায় করেন। তাছাড়া তিনি উলেমাদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন। অন্তত তার শেষ ১৮ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে কিছুটা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার অভিযোগ নায্যভাবে করা যায়।

সুলতানি শাসনে অমুসলিমরা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হত না

  • (১) মোট কথা সুলতানি আমলে অ-মুসলিমরা বিশেষত হিন্দুরা তেমন কোনো ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হত না। সুলতানরা হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেন নি।
  • (২) হিন্দুরা হিন্দু হিসেবেই বাস করার অধিকার পায়। কারণ, তারা বুঝেছিলেন যে, বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু সমাজকে ভাঙ্গা যাবে না। যদি তারা বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন করে ইসলামে দীক্ষিত করার নীতি নিতেন তবে রাজধানী দিল্লীর চারদিকে এত হিন্দু থাকত না।
  • (৩) অনেক সময় যুদ্ধ বন্দীদের ধর্মান্তরিত করা হত। শুধু হিন্দু যুদ্ধ বন্দী নয়, মোঙ্গল বন্দীদেরও জালালউদ্দিন খলজি ধর্মান্তরিত করেন। অপরাধী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে কখনও কখনও শাস্তি মকুব হত।

ফিরোজ তুঘলকের বিরুদ্ধে অভিযোগ

  • (১) ফিরোজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে ইসলামকে নিন্দা করার জন্য এবং এক মুসলিম মহিলাকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য তিনি এক ব্রাহ্মণকে হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অথবা আগুনে পুড়ে মৃত্যু, যে কোনো একটি শাস্তি বেছে নিতে বলেন।
  • (২) ব্রাহ্মণ শেষেরটি বেছে নেন। এখানে বলা দরকার যে, ইসলামীয় আইনে অপরাধীকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যার নিয়ম নেই। যদি ফিরোজ এই কাজ করেন তা ইসলাম-সম্মত কাজ ছিল না। তবে একথা ঠিক যে, ফিরোজ শাহ তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে কিছু গোঁড়ামির পরিচয় দেন, যা ছিল দুর্ভাগ্যজনক।
  • (৩) কিন্তু তাঁর ৩৭ বছর রাজত্বের গোটা সময় গোঁড়ামির দ্বারা চিহ্নিত ছিল না। হিন্দুরা নির্ভয়ে তাদের ধর্মপালন করতে পারত। তাছাড়া নিম্নবর্ণের বেশ কিছু হিন্দু বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতার দরুন স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়াকে বেরাদরী আন্দোলন বলা হয়।

উপসংহার :- রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার আশায় অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। সুফী সন্তদের প্রভাবেও অনেকে ইসলামে আকৃষ্ট হয়। তথাপি ভারত-এ হিন্দুদের তুলনায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল বহু কম।

(FAQ) সুলতানি শাসনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভেঙ্গে ফেলেন কে?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

২. হোলি উৎসবে কোন সুলতান যোগ দিতেন?

মহম্মদ বিন তুঘলক।

৩. দিল্লির কোন সুলতান ধর্মভীরু ছিলেন?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৪. আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের প্রভূ কে?

খলিফা।

Leave a Comment