ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত গুণাবলী, বিপ্লব সম্পর্কে জনসাধারণের হতাশা, ডিরেক্টরি শাসনের ব্যর্থতা, বিভিন্ন যুদ্ধে নেপোলিয়নের সাফল্য, নেপোলিয়ন ও বিপ্লবের আদর্শ এবং নেপোলিয়নের সুবিধাবাদ সম্পর্কে জানবো।

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ প্রসঙ্গে নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত প্রতিভা, নেপোলিয়নের দক্ষতা, নেপোলিয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেপোলিয়নের আত্মবিশ্বাস, নেপোলিয়নের সামরিক ও রাজনৈতিক কূটকৌশল, নেপোলিয়নের সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত গুণাবলী, নেপোলিয়নের চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব, নেপোলিয়নের বাকপটুতা, নেপোলিয়নের প্রতি ফরাসি জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা সম্পর্কে জানব।

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ
জন্ম১৫ আগস্ট, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ
পিতামাতাকার্লো বোনাপার্ট, লেটিজিয়া
ইউরোপ-এর মুক্তিদাতানেপোলিয়ন বোনাপার্ট
ফরাসি জাতির সম্রাট১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ

সূচনা :- একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই নেপোলিয়ন ফ্রান্স-এর সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রভূত রক্তপাত ও বিপ্লবের মাধ্যমে যে ফরাসি জাতি একদিন বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিল, তারাই আবার গণভোটের মাধ্যমে তাঁকে সম্রাট পদে বরণ করে নেয়।

সাফল্যের কারণ

আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান কোনও আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর এই উত্থানের পথকে সহজতর করেছিল। তাঁর সাফল্যের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন –

(১) নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত গুণাবলী

  • (ক) নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত প্রতিভা, কর্মশক্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস, সামরিক ও রাজনৈতিক কূটকৌশল এবং উন্নত রণকৌশল ও সাংগঠনিক ক্ষমতা তাঁকে সাফল্যের কাছে পৌঁছে দেয়।
  • (খ) তিনি সেনাদলের প্রীতি ও বিশ্বাস অর্জন করেন। জনসাধারণও তাঁর প্রতি সমর্থন জানায়। ফ্রান্সের মানুষ তাঁর মধ্যে খুঁজে পায় এমন একজন নেতাকে যিনি তাদের রক্ষা করবেন এবং তাদের গৌরববোধ ফিরিয়ে দেবেন।

(২) বিপ্লব সম্পর্কে হতাশা

  • (ক) বিপ্লব সম্পর্কে ফরাসি জাতির গভীর হতাশাবোধ নেপোলিয়নের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্নীতিগ্রস্ত ও পচনশীল পুরাতনতন্ত্রকে ধ্বংস করে নতুন জীবনের আশায় মানুষ বিপ্লবে সামিল হয়েছিল।
  • (খ) বিপ্লব কার্যত ফ্রান্সে চরম নৈরাজ্য নিয়ে আসে। পুরাতনতন্ত্র ভেঙে পড়ে, একের পর এক নতুন শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, সন্ত্রাসের রাজত্ব এবং তারপর থার্মোডোরীয় প্রতিক্রিয়া ফ্রান্সের বুকে সীমাহীন নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। বিপ্লব সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হয়।
  • (গ) ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, “ফ্রান্সের জনমানস রাজনৈতিক সংঘাত, বিরামহীন নির্বাচন, বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সংকটের জন্য বিপ্লবের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। মানুষ ভাবতে থাকে যে বিপ্লবের অর্থই যদি অজস্র রক্তপাত হয়, তবে এই শাসন রাজতন্ত্র অপেক্ষা ক্ষতিকর।
  • (ঘ) মানুষ আশা করে যে, নেপোলিয়নের মতো একজন শক্তিশালী সেনাপতির নেতৃত্বে নিশ্চয়ই ফ্রান্সে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবেএবং জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা ফিরে আসবে। তাই ঐতিহাসিক রাইকার বলেন যে, “আশা বিপ্লবের জন্ম দেয়, এবং হতাশা নেপোলিয়নের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে।

(৩) ডিরেক্টরি শাসনের ব্যর্থতা

  • (ক) ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা ফ্রান্সের ইতিহাসে ঘোরতর দুর্যোগের সময়। ইতিপূর্বে বিপ্লবী ফ্রান্সে এমন অপদার্থ, অযোগ্য, অদক্ষ, অসৎ ও স্বার্থপর শাসনব্যবস্থা আর কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
  • (খ) জেকোবিনদের দমনের নামে বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং ফ্রান্সে আবার এক প্রতিক্রিয়াশীল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদেলাঁ বলেন যে, “বিপ্লবের প্রকৃত সন্তানরা দমিত হয়। সাকুলেৎ শ্রেণি রঙ্গমঞ্চ থেকে অপসৃত হয়।
  • (গ) এই সময় খাদ্যাভাব ও দ্রব্যমূল্য চরমে ওঠে এবং ডিরেক্টরদের দুর্নীতি, অমিতব্যয়িতা ও বৈদেশিক যুদ্ধের ব্যয়ভার ফ্রান্সকে চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
  • (ঘ) ঐতিহাসিক টমসন বলেন যে, “বিপ্লবের দুরন্ত গতি নিঃশেষিত হওয়ায় সাংগঠনিক ও সামরিক প্রতিভাদীপ্ত সৈনিকের ক্ষমতালাভের পথ প্রশস্ত হয়।”

(৪) যুদ্ধে নেপোলিয়নের সাফল্য

  • (ক) চতুর্দশ লুইয়ের আমল থেকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্সের একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে ইউরোপীয় রাজনীতিতে ফ্রান্স যথেষ্ট মর্যাদ ভোগ করত।
  • (খ) বিপ্লবের প্রাক্কালে বৈদেশিক ক্ষেত্রে ফ্রান্স কোনও কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারে নি। এই অবস্থায় তুলোঁ বন্দর অবরোধমুক্ত করা, কনভেনশনকে রক্ষা করা এবং ইতালি, অস্ট্রিয়াইংল্যান্ড-এর বিরুদ্ধে নেপোলিয়নের সাফল্য ফরাসিবাসীর কাছে তাঁকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে।
  • (গ) তিনি ফরাসি জাতির জাতীয়তাবাদের প্রতিভূতে পরিণত হন। ইউরোপের মানুষ তাকে ‘মুক্তির দূত” বলে অভিনন্দিত করে। ঐতিহাসিক হেজ বলেন যে, এই সময় নেপোলিয়নই ছিলেন “ফ্রান্সে সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি।”
  • (ঘ) তাঁর বাক্‌চাতুর্য ও ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি সাধারণ সৈনিক ও জনসাধারণকে মন্ত্রমুগ্ধ করত। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় শক্তিজোট গঠিত হলে ফরাসি জাতি তাঁকে রক্ষক হিসেবে বেছে নেয়।

(৫) নেপোলিয়ন ও বিপ্লবের আদর্শ

  • (ক) ব্যক্তিগত জীবনে স্বার্থপর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ক্ষমতালিপ্সু হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিপ্লবী আদর্শকে সামনে রেখে তিনি নানাবিধ সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
  • (খ) তাঁর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং বিরোধী দলগুলির প্রতি উদার আচরণ জনগণের আস্থা অর্জন করে। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে তাঁর উত্তরণ তাকে বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত করে। এই কারণে তিনি দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হন।

(৬) সুবিধাবাদ

তিনি চরম সুবিধাবাদী ছিলেন। এই সুবিধাবাদ তাঁর উত্থানে সাহায্য করে। জেকোবিন দলের সমর্থক নেপোলিয়ন এক সময় এই দলের সমর্থনে প্রচারপত্র রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনিই আবার রোবসপিয়রের পতন ঘটাতে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলান।

উপসংহার :- রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক না থাকায় ডিরেক্টরির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই অবশ্য সর্বপ্রধান হয়ে ওঠেন।

(FAQ) ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সাফল্যের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফ্রান্স ও ইউরোপের মুক্তিদাতা কাকে বলা হয়?

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

২. কখন কোথায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্ম হয়?

১৫ আগস্ট, ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরের কর্সিকা দ্বীপে।

৩. নেপোলিয়ন ফরাসি জাতির সম্রাট উপাধি ধারণ করেন কখন?

১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment