সন্ত্রাসের শাসনের কারণ

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতামত হিসেবে তেইনের মত, ওলারের মত, জোরেস ও মাতিয়ের মত, সবুলের মত, ডেভিড থমসনের মত, সিডেনহামের মত, সন্ত্রাসের শাসনের বৈদেশিক কারণ হিসেবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শক্তি জোট গঠন, ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফ্রান্সের পরাজয়, জাতির নিরাপত্তা বিঘ্নিত, আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে অরাজকতা ও প্রতিবিপ্লব, সরকারের বিরোধিতা, বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিদ্রোহে যাজকদের যোগদান, সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজনীয়তা, ন্যাশনাল কনভেনশনের সিদ্ধান্ত ও সন্ত্রাসের শাসনের সূচনা সম্পর্কে জানবো।

ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাসন্ত্রাসের শাসনের কারণ
সময়কাল২ জুন, ১৭৯৩ – ২৭ জুলাই, ১৭৯৪
স্থানফ্রান্স
লাল সন্ত্রাস১৩ এপ্রিল – ২৭ জুলাই, ১৭৯৪
নায়করোবসপিয়ার
সন্ত্রাসের শাসনের কারণ

ভূমিকা:- ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা জুন থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জুলাই পর্যন্ত তেরো মাস ফরাসি বিপ্লব -এর ইতিহাসে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ, ঘটনাবহুল ও ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। এই কালপর্বে ফ্রান্সের ইতিহাসে যে ধরনের আত্মঘাতী ও হিংসাশ্রয়ী ঘটনা ঘটে, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল। এই কাল পর্ব সন্ত্রাসের রাজত্ব নামে পরিচিত।

সন্ত্রাসের শাসনের কারণ

ফ্রান্সে এই আত্মঘাতী ও হিংসাত্মক ঘটনার কারণ গুলি হল নিম্নরূপ। –

(ক) ঐতিহাসিকদের মতামত

সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হওয়ার সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা নানা কথা বলেছেন। যেমন –

(১) তেইনের মত

ঐতিহাসিক তেইন (Taine) বলেন যে, বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পরিবর্তে কিছু উগ্র, অসাধু ও ক্ষমতালোভী মানুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। তারাই গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র-বিধ্বংসী সন্ত্রাসমূলক কাজে অবতীর্ণ হয়।

(২) ওলারের মত

ইতিহাসবিদ ওলার (Aulard) -এর মতে, বৈদেশিক যুদ্ধই সন্ত্রাসের শাসন নিয়ে আসে। শত্রু-বেষ্টিত ফ্রান্সের জন্য আত্মরক্ষার অন্য কোনও বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তাঁর মতে, দেশ ও বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য এমন কঠোর ও হৃদয়হীন শাসন অপরিহার্য ছিল।

(৩) জোরেস ও মাতিয়ের মত

বিখ্যাত ঐতিহাসিক জোরেস (Jaures), মাতিয়ে (Mathiez) প্রমুখের মতে, কেবলমাত্র যুদ্ধজয় নয়-সমাজ-বিপ্লব প্রতিষ্ঠা এবং সাঁকুলেৎদের দাবি-দাওয়া মিটিয়ে দেওয়ার জন্য জোকোবিন দল সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।

(৪) সবুলের মত

অধ্যাপক সবুল (Soboul) বলেন যে, সাঁকুলেৎদের প্রবল চাপের মুখে পড়েই জেকোবিন দল সন্ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়।

(৫) ডেভিড থমসনের মত

অধ্যাপক ডেভিড থমসন (David Thomson)-এর মতে, প্রচলিত শাসনব্যবস্থা দ্বারা দেশের অভ্যন্তরে প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলন এবং বৈদেশিক আক্রমণ একত্রে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না—এ জন্যই সন্ত্রাস অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

(৬) সিডেনহামের মত

ঐতিহাসিক সিডেনহাম (Sydeinham) সন্ত্রাসকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে বলেছেন যে, দেশরক্ষার প্রয়োজন সন্ত্রাসের মৌলিক বা একমাত্র কারণ নয়। বাস্তিল দুর্গের পতন -এর পর থেকে ফ্রান্সে যে হিংসার পরিবেশ গড়ে ওঠে সন্ত্রাস তারই সন্তান।

(খ) বৈদেশিক আক্রমণ

এই সময় বৈদেশিক আক্রমণ ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। যেমন –

 (১) ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শক্তিজোট গঠন

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপারে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ইউরোপ -এর বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী রাজন্যবর্গ আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরা বিপ্লবী ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি শক্তিজোট গঠন করেন।

(২) ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফরাসি বাহিনীর পরাজয়

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, সার্ডিনিয়া ও নেপলস্ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিজোট গঠন করে এবং দ্রুত ফ্রান্স অভিমুখে অগ্রসর হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রণাঙ্গনে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হতে থাকে।

(৩) জাতির নিরাপত্তা বিঘ্নিত

ফরাসি সেনাপতি দামরিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগদান করেন। শত্রু বাহিনী ফ্রান্সের উত্তর-পূর্ব সীমানা অতিক্রম করে দ্রুত প্যারিস অভিমুখে অগ্রসর হয়। এর ফলে গঠিত ফরাসি প্রজাতন্ত্র ও জাতির নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।

(গ) আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি

তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও নানা ভাবে সন্ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। যেমন –

 (১) অরাজকতা ও প্রতিবিপ্লব

ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও তখন চলছে চরম অরাজকতা ও প্রতি-বিপ্লবী আন্দোলন। চরম অন্নাভাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মহার্ঘতা ও অভাব এবং খাদ্যের সন্ধানে প্যারিসে বহিরাগতদের ভিড় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

(২) সরকারের বিরোধিতা

জনসাধারণের এক বৃহদংশ তখন প্রকাশ্যে প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরোধিতা করতে থাকে, সরকারি আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রকাশ করে এবং কর প্রদানে ও সেনাদলে যোগদানে অসম্মত হয়। বিদেশি গুপ্তচরে দেশ ছেয়ে যায়।

(৩) বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

ফ্রান্স তখন মজুতদার, কালোবাজারি ও ফাটকাবাজদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। রাজতন্ত্রের সমর্থকরা বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লা-ভেণ্ডি, রিতানি, লায়নস, তুলো, বোন, মার্সেই প্রভৃতি স্থান ছিল রাজতন্ত্রীদের প্রধান ঘাঁটি।

(৪) বিদ্রোহে যাজকদের যোগদান

ফ্রান্সের ৮৩ টি প্রদেশ (ডিপার্টমেন্ট)-এর মধ্যে ৬০টি প্রদেশেই বিদ্রোহ শুরু হয়। লা ভেভি-র বিদ্রোহী কৃষকদের সঙ্গে ক্ষুব্ধ যাজকরাও (ধর্মযাজকদের সংবিধানের জন্য) যোগ দেন।

সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়োজনীয়তা

জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির স্বার্থে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সে এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তারা উপলব্ধি করেন যে, প্রজাতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং দেশে শৃঙ্খলা স্থাপন- যা সম্ভব একমাত্র ভীতি-প্রদর্শন ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে।

সন্ত্রাসের শাসন সম্পর্কে ন্যাশনাল কনভেনশনের সিদ্ধান্ত

ফ্রান্সের ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসভা সিদ্ধান্ত নেয় যে, জরুরি পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের সরকার হবে বিপ্লবী এবং যতদিন না দেশে শান্তি ফিরে আসে এই ব্যবস্থাই চলতে থাকবে। তাঁরা প্রচার করতে থাকেন যে, সন্ত্রাসই হচ্ছে দ্রুত ও বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারের পথ।

সন্ত্রাসের রাজত্ব

বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ প্রবর্তিত এই ভয়াবহ শাসন ব্যবস্থা ‘সন্ত্রাসের শাসন’ নামে পরিচিত। মোটামুটিভাবে এর স্থায়িত্বকাল হল ২রা জুন, ১৭৯৩ থেকে ২৭শে জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

উপসংহার:- ফ্রান্সের নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের মতাে কঠোর শাসনের প্রয়ােজন ছিল। ঐতিহাসিক রাইকার বলেন যে, ভয়াবহতা ও নৃশংসতা সত্ত্বেও সন্ত্রাসের শাসন বাস্তব রাজনীতিজ্ঞানের পরিচায়ক।

(FAQ) সন্ত্রাসের শাসনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের সময়কাল কত?

২ জুন, ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

২. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের নায়ক কে?

রোবসপিয়ার।

৩. কোন সময় পর্বকে লাল সন্ত্রাস বলা হয়?

১৩ এপ্রিল থেকে ২৭ জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

৪. সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে কখন?

২৭ জুলাই ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ।

৫. কার মৃত্যুর মাধ্যমে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে?

রোবসপিয়ার।

Leave a Comment