নবজাগরণের কারণ

ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা, নবজাগরণের কারণ হিসেবে গির্জার শিক্ষা, ক্রুসেড, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, নগরগুলির ভূমিকা, অভিজাত সম্প্রদায়ের ভূমিকা, মানবতাবাদীদের ভূমিকা ও মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

নবজাগরণের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনানবজাগরণের কারণ
অর্থনবজন্ম বা পুনর্জন্ম
সময়কালপঞ্চদশ শতক
প্রথম সূচনাইতালি
কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ
নবজাগরণের কারণ

ভূমিকা:- ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বর্বর আক্রমণে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য-এর পতন ঘটলে ইউরোপ-এ গ্রিক ও ল্যাটিন-চর্চার অবলুপ্তি ঘটে। কেবলমাত্র কিছু পণ্ডিত পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা, অব্যাহত রেখেছিলেন। ইউরোপের সাধারণ মানুষ গ্রিক-ল্যাটিন সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা কিছুই জানত না।

নবজাগরণের সূচনা

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে অটোম্যান তুর্কিদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের পণ্ডিতরা তাঁদের পুঁথিপত্র নিয়ে ইতালিতে চলে আসেন। এর ফলে ইতালিতে গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য-দর্শনের চর্চা শুরু হয়, এবং এই প্রাচীন সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে শুরু হয় নবজাগরণ বা রেনেসাস। তাই ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দকে নবজাগরণের সূচনাকাল বলে ধরা হয়।

নবজাগরণের কারণ

নবজাগরণের সূচনাকাল নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নবজাগরণ হল দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি। এর পিছনে সংঘটিত বিভিন্ন কারণগুলি হল –

(ক) গির্জার শিক্ষা

  • (১) মধ্যযুগে গির্জাই ছিল বিদ্যাচর্চার একমাত্র কেন্দ্রস্থল। গির্জা-প্রদত্ত শিক্ষা মূলত ধর্মকেন্দ্রিক হলেও, এখানে অন্যান্য শিক্ষাও দেওয়া হত। বিভিন্ন পণ্ডিতরা আবার ব্যক্তিগতভাবেও শিক্ষা দিতেন। এই সবেরই ফলশ্রুতি হল দ্বাদশ শতকের নবজাগরণ।
  • (২) গির্জার নানা ত্রুটি ও অনাচার সত্ত্বেও এ কথা মানতেই হবে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপ মহাদেশে গির্জাই ছিল জ্ঞানের একমাত্র আলোকবর্তিকা, যা মধ্যযুগে বিদ্যাচর্চাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।

(খ) ক্রুসেড

  • (১) অনেকের মতে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলে নবজাগরণের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক মায়ার্স (Myers)-এর মতে, “ক্রুসেডের কারণ ছিল মধ্যযুগীয়, কিন্তু ক্রুসেডের ফলাফল ছিল আধুনিক।” ধর্মযুদ্ধে যোগ দিয়ে ইউরোপবাসী প্রাচ্যের ভোগবাদী জীবনদর্শন ও সভ্যতার সাথে পরিচিত হয়।
  • (২) প্রাচ্যের বিলাস দ্রব্যাদি রেশম, কার্পেট, লেবু, সরবৎ প্রভৃতি ইউরোপে প্রবেশ করতে থাকে। ধর্মযোদ্ধারা আরবীয় জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শনের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে তাদের মন যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে এবং তাদের উপর থেকে গির্জার প্রভাব শিথিল হয়ে পড়ে।

(গ) সামন্ততন্ত্রের পতন

মধ্যযুগে প্রচলিত সামন্তব্যবস্থায় কোনও প্রকার উন্নতি, সামাজিক গতিশীলতা, স্বাধীন চিন্তা বা সমানাধিকারের অবকাশ ছিল না। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে সামন্তপ্রথার অবসানে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী সবার মনে স্বাধীন চেতনার উন্মেষ হতে থাকে। এই স্বাধীন চেতনা বা চিন্তাই নবজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, বিজ্ঞানচর্চা—সর্বক্ষেত্রে নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটতে থাকে।

(ঘ) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব

  • (১) ফিশার (Fisher) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের বহু পূর্ব থেকেই ইউরোপে—বিশেষ করে ইতালিতে একটি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ই ছিল নবজাগরণের অগ্রদূত।
  • (২) দ্বাদশ শতক থেকেই ইউরোপের নানা স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। প্রথমে ইতালির বোলোগনা, রাভেনা, মিলান প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে প্যারিস, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, হিডেলবার্গ, হ্যামবুর্গ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
  • (৩) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে সাধারণ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এতদিন পর্যন্ত গির্জাই ছিল ইউরোপের একমাত্র শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে শিক্ষা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক।
  • (৪) বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অ্যারিস্টটল -এর তর্কশাস্ত্র ও দর্শন এবং গ্রিক ও আরবীয় দর্শন ও বিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে মানুষের মনে যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।
  • (৫) শিক্ষিত সম্প্রদায় যুক্তির আলোকে মধ্যযুগের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির বিচার শুরু করেন। এইভাবে নবজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

(ঙ) ইতালির নগরগুলির ভূমিকা

  • (১) নবজাগরণের উন্মেষে ইতালির নগরগুলির ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে ইতালিতে নগরজীবনের বিকাশ হয়। সামন্তপ্রভুদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই নগরগুলিতে স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ ছিল। এর ফলে এখানে মানুষের আত্মবিকাশের সুযোগ ছিল যথেষ্ট।
  • (২) ইতালীয় শহরগুলি প্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে ইতালীয় শহর রোম, ফ্লোরেন্স, মিলান, ভেনিস যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।
  • (৩) বাইজান্টিয়াম ও মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে গ্রিক ও আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান অতি সহজেই এই অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। এর ফলে যুক্তিবাদের বিকাশ সহজতর হয়।
  • (৪) মধ্যযুগে জার্মান আক্রমণে বিপর্যস্ত গ্রিক পণ্ডিতদের অনেকেই তাদের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে ইতালি ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যান। এর ফলে এইসব অঞ্চলে প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য শিল্পকলা সম্পর্কে উৎসাহ বৃদ্ধি পায়।
  • (৫) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটলে প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন পুঁথিপত্র নিয়ে গ্রিক পণ্ডিতরা দলে দলে ইতালির বিভিন্ন শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অনেকে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। এর ফলে প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন শিক্ষা-সংস্কৃতি ইতালির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই শিক্ষা-সংস্কৃতি মূল কথাই হল যুক্তিবাদ।

(চ) অভিজাত সম্প্রদায়ের ভূমিকা

  • (১) নবজাগরণের বিকাশে ইউরোপের বিভিন্ন রাজন্যবর্গ, পোপ, অভিজাত সম্প্রদায় এবং ধনীদের ভূমিকা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক আরবীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রের অনুরাগী ছিলেন।
  • (২) ফরাসি-রাজ প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ড-রাজ অষ্টম হেনরি, স্পেন-রাজ পঞ্চম চার্লস গ্রিক পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। রোমের পোপরাও প্রাচীন শিক্ষা-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার ও প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
  • (৩) প্রাচীন শিক্ষা, সাহিত্য ও শিল্পকলার বিকাশ এবং প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপারে পোপ দশম লিও, দ্বিতীয় জুলিয়াস এবং পোপ পঞ্চম নিকোলাসোর নাম উল্লেখযোগ্য।
  • (৪) ইতালির বিভিন্ন নগরীর ধনী ব্যক্তিরা প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতি এবং গ্রিক ও ল্যাটিন পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ইতালির ফ্লোরেন্স, মিলান ও ভেনিস নগর ছিল নবজাগরণের পীঠস্থান। এইসব শহরের শাসক ও অভিজাত সম্প্রদায় নানাভাবে নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

(ছ) মানবতাবাদীদের ভূমিকা

  • (১) নবজাগরণের সৃষ্টিতে ‘হিউম্যানিস্ট’ বা মানবতাবাদীদের গুরুত্ব অপরিসীম। মধ্যযুগে আত্মার উন্নতি ও ধর্মতত্ত্বের আলোচনার মধ্যেই মানুষের সব চিন্তাধারা সীমাবদ্ধ ছিল। ঈশ্বর ছিলেন সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।
  • (২) নবজাগরণের ফলে মানুষ (হিউম্যান) ও মানুষের জাগতিক উন্নতি সাধনই সকলের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়। যে সব পণ্ডিতরা মানুষের এই জাগতিক উন্নতির কথা চিন্তা করতেন তাঁদের বলা হত ‘হিউম্যানিস্ট’ বা ‘মানবতাবাদী”।
  • (৩) মানবতাবাদীরা ধর্ম নয়, মানুষের কথা বলতেন এবং মানুষকে প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী ছিলেন। সামাজিক ও ধর্মীয় অনাচার, গির্জা ও ধর্মযাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার হন।
  • (৪) মানবতাবাদীদের মধ্যে পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও, ম্যাকিয়াভেলি প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তাঁদের প্রচারকার্যের ফলে যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তার আদর্শ বলবতী হয়ে ওঠে।

(জ) মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব

  • (১) নবজাগরণের বিকাশে ছাপাখানা বা মুদ্রণযন্ত্রের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মধ্যযুগে মূল পাণ্ডুলিপি হাতে নকল করা হত। এতে বেশি সময় লাগত, ভুল থাকত এবং ব্যয়ও হত প্রচুর।
  • (২) ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির মেইনজ নামক শহরে গুটেনবার্গ সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্র ও সিসার অক্ষরের সাহায্যে বই ছাপাবার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সম্ভবত ল্যাটিন বাইবেল-ই হল প্রথম মুদ্রিত পুস্তক।
  • (৩) ছাপাখানা আবিষ্কারের ফলে অল্প সময়ে এবং স্বল্পমূল্যে বই ছাপাবার ব্যবস্থা হয়। ধনী-নির্ধন সকলেরই জ্ঞানলাভের সুযোগ হল। নবজাগরণের ভাবধারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

উপসংহার:- মধ্যযুগীয় অরাজকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক কুসংস্কার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল নবজাগরণ। নবজাগরণ মানুষকে ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঙিনায় উপস্থিত করেছিল।

(FAQ) নবজাগরণের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নবজাগরণ কথার অর্থ কি?

নবজন্ম বা পুনর্জন্ম।

২. কোন দেশে প্রথম নবজাগরণের সূত্রপাত হয়?

ইতালি।

৩. কোন শহরে প্রথম নবজাগরণ শুরু হয়?

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে।

৪. কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটে কখন?

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment