ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী বিরোধ, কৃষকদের রক্ষণশীলতা, জাতি বৈরিতা, কর্মপন্থা ও মতাদর্শগত বিরোধ, নেতৃত্বের অভাব, সামরিক শক্তি ও বিপ্লবীদের মধ্যে সংহতির অভাব সম্পর্কে জানবো।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ
সময়কাল২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ
নেতাথিয়ার্স, লা মার্টিন
স্থানফ্রান্স
ফলাফলব্যর্থতা
মেটারনিখের পদত্যাগ১৩ মার্চ, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ
হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনীলুই কসুথ
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ

সূচনা:- ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাথমিকভাবে এই বিপ্লব সারা ইউরোপকে কাঁপিয়ে দেয়। অভিজাতদের সরিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ামকে পরিণত হয় এবং ইউরোপের দেশে দেশে ভীত-সন্ত্রস্ত শাসকরা প্রজাদের অনুকূলে উদারনৈতিক সংবিধান জারি করতে বাধ্য হন।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতা

প্রবল উন্মাদনার মধ্যে গণজাগরণ শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়, এবং স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রই আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের এই ব্যর্থতার জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করা যায়। যেমন –

(ক) মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী বিরোধ

  • (১) অধ্যাপক সীম্যান বলেন যে, “সমকালীন ইউরোপের সামাজিক বিন্যাস ১৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়।”তাঁর মতে, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ইউরোপের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের পশ্চাতে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হতাশাবোধ।
  • (২) শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল শিল্পপতি ও ভূস্বামী সম্প্রদায়। পরে আসে অসংখ্য কৃষক ও শহরের শ্রমজীবী মানুষ, যারা দাঙ্গা ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে নিজেদের দাবি আনতে সচেষ্ট ছিল।
  • (৩) মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিবর্তন চেয়েছিল, কিন্তু অস্থিরতা বা অরাজকতা নয়। এর ফলে বিপ্লবের দুই শরিকের মধ্যে সংঘাত বাধে, এবং মধ্যবিত্ত বুর্জোয়াদের হাতে বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে, যা বিপ্লবকে নিশ্চিতভাবে দুর্বল করে দেয়।

(খ) কৃষকদের রক্ষণশীলতা

  • (১) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব মূলত শহরকেন্দ্রিক হলেও এতে কৃষক ও সাধারণ মানুষব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। কৃষকদের অংশগ্রহণে এই বিপ্লব নতুন মাত্রা পায়, কিন্তু কৃষকদের আদর্শবাদ ও বিপ্লবী চেতনা অতটা গভীর ছিল না।
  • (২) ফ্রান্সে জমির উপর কৃষক-মালিকানা স্বীকৃত হলে তারা রক্ষণশীল ও প্রতি-বিপ্লবী হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে অস্ট্রিয়া-তে সরকার কৃষকদের উপর থেকে সামন্ততান্ত্রিক কর প্রত্যাহার করে নিলে তারা সরকারের সমর্থকে পরিণত হয়। কোনও আদর্শবাদ নয়—সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা-প্রসূত এই আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই ছিল দুর্বল।

(গ) জাতি বৈরিতা

  • (১) জাতিবৈরিতা ও জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষার পরস্পর-বিরোধিতা এই বিপ্লবের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। বিপ্লবের ফলে হাঙ্গেরিতে লুই কসুথের নেতৃত্বে ম্যাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (২) ম্যাগিয়ার জাতি হাঙ্গেরিকে ম্যাগিয়ার রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করতে উদ্যোগী হলে স্লাভ, সার্ব, ক্রোট, শ্লোভাক জাতিগোষ্ঠী এর বিরোধিতা শুরু করে। অনুরূপভাবে বোহেমিয়ায় চেক ও জার্মানদের দ্বন্দ্ব জটিলতর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এর ফলে এইসব স্থানে সহজেই অস্ট্রিয়ার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

(ঘ) কর্মপন্থা ও মতাদর্শগত বিরোধ

  • (১) কর্মপন্থা ও মতাদর্শ নিয়ে বিপ্লবীদের মধ্যে মতভেদ ছিল। ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের মিলিত চেষ্টায় বিপ্লব জয়যুক্ত হয়, কিন্তু নীতি ও কর্মপন্থা নিয়ে দুই দলের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য ছিল।
  • (২) প্রজাতান্ত্রিক দলের বক্তব্য ছিল যে, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের কাজ শেষ হয়েছে—এখন দরকার ফ্রান্সের সংহতি সাধন। অপরদিকে সমাজতন্ত্রীরা মনে করত যে, বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক কাজ শেষ হয়েছে— গঠনমূলক কাজ এখনও বাকি।
  • (৩) দুই মতাদর্শের বিরোধের ফলে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হয়। ইতালির ক্ষেত্রেও অনুরূপ মতপার্থক্য ছিল। সংগ্রামের পদ্ধতি নিয়ে ম্যাৎসিনি ও ক্যাভুর-এর মধ্যে স্পষ্ট নীতিগত বিরোধ ছিল। এছাড়া ইতালিতে রাজতন্ত্র, পোপতন্ত্র না প্রজাতন্ত্র কি প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল, যা ইতালীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।
  • (৪) ভাবী জার্মান রাষ্ট্রের কাঠামো কি হবে তা নিয়ে ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য ছিল। এইসব বিবাদ-বিসংবাদের ফলে বিপ্লবী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

(ঙ) নেতৃত্বের অভাব

  • (১) যোগ্য নেতৃত্বের অভাব বিপ্লবের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপ্লবসংঘটিত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়াই। অনেকেই বিপ্লবের জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন না। তাও বিপ্লব আসে।
  • (২) শহরের মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। তাঁদের নেতৃত্ব আবেগ-সঞ্চারী ও আদর্শনিষ্ঠ হলেও তা ছিল বাস্তবতাবর্জিত। ফ্রান্সের লা-মার্টিন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা ছিলেন না।
  • (৩) ম্যাৎসিনি ছিলেন আদর্শবাদী—রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতা তার ছিল না। জনগণই ছিল এই বিপ্লবের প্রকৃত নেতা।

(চ) সামরিক শক্তি

  • (১) জাতীয়তাবাদ, প্রজাতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি অপেক্ষা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ও ধর্মবোধের প্রতি মানুষের আনুগত্য ছিল বেশি। তাই গণ-আন্দোলনের ভয়ে রাজরা উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র মঞ্জুর করলে মানুষ রক্ষণশীলতার আবর্তে ফিরে যায়—বিপ্লব স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
  • (২) এই সুযোগে রাষ্ট্রশক্তি বিপ্লবীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বিপ্লব দমিত হয়। তাছাড়া এই সময় কোনও রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বিপ্লবীদের পক্ষে যোগ দেয় নি। অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার সেনাদল বিপ্লব ধ্বংস করে এবং তাদের সঙ্গে যোগ দেয় রাশিয়া -র সেনাবাহিনী।

(ছ) বিপ্লবীদের মধ্যে সংহতির অভাব

  • (১) বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের মধ্যে কোনও ঐক্য, সংহতি বা পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল না। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া প্রভৃতি দেশের বিপ্লবীদের মধ্যে কোনও ঐক্য গড়ে ওঠে নি।
  • (২) যখন এক দেশের বিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল, তখন অন্যদেশের বিপ্লবীরা তাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হয় নি। ফ্রান্স ছিল বিপ্লবী চেতনার উৎসভূমি। ফ্রান্স কোথাও বিপ্লবীদের সাহায্য করে নি, বরং রোম-এর প্রজাতন্ত্র ধ্বংস করতে অস্ট্রিয়াকে সাহায্য করে।

উপসংহার:- ঠিক এই সময়েই প্রকৃতিও বিরূপতা সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ডেভিড টমসন লিখেছেন যে, এই সময় ইউরোপে প্লেগের মহামারী দেখা দেয়। চিন থেকে আগত এই মারণ-ব্যাধি সারা পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচুর জীবনহানি ঘটায়। মৃত্যুভয়ে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যায়।

(FAQ) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কখন কোথায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংঘটিত হয়?

২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।

২. কোন বছরকে ইউরোপের বিপ্লবের বৎসর বলা হয়?

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ।

৩. হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনী নামে কে পরিচিতি?

হাঙ্গেরির বিখ্যাত নেতা লুই কসুথ।

৪. মেটারনিখ কখন ইংল্যান্ডে পলায়ণ করেন?

১৫ মার্চ, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment