ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ

ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে নেপোলিয়নের ভীতি দূর, পারস্পরিক স্বার্থ, সদস্যদের মধ্যে বিবাদ, ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য, আদর্শগত বিরোধ, আভ্যন্তরীন হস্তক্ষেপের নীতি, ইংল্যান্ডের আপত্তি অগ্ৰাহ্য, ইংল্যান্ডের শক্তি সমবায় ত্যাগ, স্পেনীয় উপনিবেশের বিদ্রোহ, মনরো নীতি, শক্তি সমবায়ের গুরুত্ব ও ল্যাসেমের মন্তব্য সম্পর্কে জানবো।

শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ
সময়কাল১৮১৫-১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ
আই-লা-স্যাপেলের অধিবেশনের১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ
ট্রপো বৈঠক১৮২০ খ্রিস্টাব্দ
ব্যর্থতার অন্যতম কারণনেপোলিয়ন ভীতি দূর
পতনমে, ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ
ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ

ভূমিকা :- বিশ শতকের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইউরোপীয় শক্তি সমবায়‘ বা ‘কনসার্ট অব ইউরোপ‘-এর আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র দশ বছর। এর ব্যর্থতা বা পতনের পশ্চাতে নানা কারণ ছিল। যেমন –

(১) নেপোলিয়ন-ভীতি দূর

তীব্র নেপোলিয়ন-ভীতি ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং তারাই এই শক্তি সমবায় গঠন করে। কালক্রমে নেপোলিয়ন-ভীতি দূর হয়ে গেলে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত প্রকট হয়ে ওঠে এবং এর ফলস্বরূপ এই সংস্থার পতন ঘটে।

(২) পারস্পরিক স্বার্থ

ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক স্বার্থ, উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা এবং সন্দেহ কখনোই তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি। আই-লা-স্যাপেলের অধিবেশনের (১৮১৮ খ্রিঃ) সময় থেকেই সদস্যদের মধ্যে মতপার্থক্য শুরু হয়।

(৩) সদস্যদের মধ্যে বিবাদ

দাসব্যবস্থা ও বার্বারী জলদস্যুদের ব্যাপারে সদস্যদের মধ্যে বিবাদ চলে। এছাড়া, জারের লক্ষ্য ছিল অপরাপর শক্তির সহযোগিতায় ইংল্যান্ডের অগ্রগতি রোধ করা।

(৪) ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য

ইংল্যান্ড -এর উদ্দেশ্য ছিল বলকান অঞ্চলে রুশ অগ্রগতিকে প্রতিহত করা। গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্পেন ও নেপলস্-এর বিদ্রোহ দমনের ব্যাপারে এই মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(৫) আদর্শগত বিরোধ

কেবল পারস্পরিক স্বার্থই নয়, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শগত বিরোধও এর পতনের অন্যতম কারণ। ইংল্যান্ড ছিল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক ও উদারপন্থী ইংল্যান্ডের পক্ষে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে একসঙ্গে চলা সম্ভব ছিল না।

(৬) আভ্যন্তরীন হস্তক্ষেপের নীতি

প্রথম থেকেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে এই সংস্থার সম্পর্ক ভালো ছিল না। গণতান্ত্রিক ইংল্যান্ডের পক্ষে অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের নীতি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ইংল্যান্ডের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ট্রপো বৈঠকে অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নীতি গৃহীত হয়।

(৭) ইংল্যান্ডের আপত্তি অগ্ৰাহ্য

১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ফ্রান্স স্পেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এবং ফ্রান্সকে সমর্থন জানায় প্রাশিয়া, রাশিয়াঅস্ট্রিয়া

(৮) ইংল্যান্ডের শক্তি সমবায় ত্যাগ

বিভিন্ন কারণে বীতশ্রদ্ধ ব্রিটেনের নবনিযুক্ত বিদেশমন্ত্রী ক্যানিং ইউরোপীয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর ফলে এই সঙ্ঘ দুর্বল হয়ে পড়ে।

(৯) স্পেনীয় উপনিবেশের বিদ্রোহ

দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত স্পেনীয় উপনিবেশগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করলে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় সেখানে হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত হয়। তখন ইংল্যান্ড নিজ বাণিজ্যিক স্বার্থে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

(১০) মনরো নীতি

তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি মনরো বিখ্যাত ‘মনরো নীতি’ ঘোষণা করে বলেন যে ‘আমেরিকা আমেরিকাবাসীদের জন্য’ এবং আমেরিকা মহাদেশের কোনও ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আমেরিকা মেনে নেবে না। ইংল্যান্ডের পদত্যাগ এবং আমেরিকার হুমকির ফলে ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

শক্তি সমবায়ের গুরুত্ব

ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। যেমন –

  • (১) বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে ‘শক্তিসাম্য’ স্থাপন করে ইউরোপে বেশ কিছুদিনের জন্য শান্তি বজায় রাখা এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কৃতিত্ব।
  • (২) এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ইউরোপের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়। এই প্রতিষ্ঠান ‘কংগ্রেস কূটনীতি’-র সূচনা করে এবং পরবর্তীকালে এর দ্বারা শান্তিপূর্ণভাবে বহু সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়।
  • (৩) লন্ডন কংগ্রেসের দ্বারা ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়ামের স্বাধীনতা, প্যারিস কংগ্রেসের দ্বারা ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্বাঞ্চল সমস্যা, বার্লিন কংগ্রেস -এর দ্বারা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বাঞ্চল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

ল্যাসেমের মন্তব্য

অধ্যাপক ল্যাসেম-এর মতে, ‘কংগ্রেস প্রথা বিলোপের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

উপসংহার :- নরওয়ে ও সুইডেনের মধ্যে বিরোধ, মোনাকোর রাজার সঙ্গে প্রজাদের বিরোধ, ব্যাডেনের উত্তরাধিকার সমস্যা, দাসব্যবসা নিষিদ্ধকরণ এবং জলদস্যুতাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা প্রভৃতি বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

(FAQ) ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের সময়কাল কত?

১৮১৫-১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ।

২. ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের প্রথম অধিবেশন কোথায় হয়?

আই-লা-স্যাপেলে ১৮১৮খ্রিস্টাব্দ।

৩. ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ কী ছিল?

নেপোলিয়নের ভীতি দূর হওয়া।

৪. কোন দেশ ইউরোপীয় শক্তি সমবায় ত্যাগ করেছিল?

ইংল্যান্ড।

৫. ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের পতন ঘটে কখন?

১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে।

Leave a Comment