দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ হিসেবে বিশ্বের সহানুভূতি মিত্রপক্ষের দিকে, জার্মান আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ, অক্ষশক্তির দুর্বলতা, শক্তিশালী মিত্রপক্ষ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা, যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ, শীতের প্রকোপ, নৌশক্তির অভাব, রুশ অভিযানের ব্যর্থতা, হিটলারের চরিত্র, মিত্রপক্ষের সুযোগ্য নেতৃত্ব ও হেজ-এর মন্তব্য সম্পর্কে জানবো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ
পূর্ববর্তী যুদ্ধপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ
সময়কাল১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ
মিত্রপক্ষইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া
অক্ষশক্তিজার্মানি, ইতালি, জাপান
ফলাফলঅক্ষশক্তির পরাজয়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ

ভূমিকা:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এ জার্মানি, জাপান ও ইতালির মধ্যে অক্ষশক্তি জোট গড়ে ওঠে। যুদ্ধে এই জোট শক্তি চূড়ান্ত ভাবে পরাজিত হয়। জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির এই পরাজয়ের মূলে বেশ কিছু কারণ ছিল।

বিশ্বের সহানুভূতি মিত্রপক্ষের দিকে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিল অক্ষশক্তি-জার্মানি, ইতালি ও জাপান। তারা সমগ্র বিশ্বকে ফ্যাসিবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল। অপরদিকে মিত্রপক্ষের লক্ষ্য ছিল বিশ্বে গণতন্ত্র, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের সহানুভূতি ছিল মিত্রপক্ষের দিকে।

জার্মান আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ

অক্ষশক্তি কর্তৃক অধিকৃত দেশগুলির জনসাধারণেরও সমর্থন ছিল মিত্রপক্ষের দিকে। অত্যাচারী জার্মানরা যে দেশ দখল করত, সেই দেশকে তারা সর্বস্বান্ত করে দিত। এই কারণে ফ্রান্স, গ্রিস, যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশে জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

অক্ষশক্তি স্বদেশেই জনপ্রিয় ছিল না

হিটলারমুসোলিনি প্রমুখ স্বৈরাচারী শাসকরা নিজ দেশেই জনপ্রিয় ছিলেন না। যুদ্ধজনিত কারণে প্রাণহানি, অর্থনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা সাধারণ দেশবাসী মেনে নিতে পারেন নি। দেশে নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং একাধিকবার বলপূর্বক নাৎসি শাসন উৎখাতের চেষ্টা হয়। হিটলারকে তাঁর স্বদেশেই বারংবার মৃত্যুর মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দেই তাঁকে অন্তত আটবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ইতালির মুসোলিনিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাই এবং তিনি নিহত হন তাঁর দেশবাসীর হাতে।

অক্ষশক্তির দুর্বলতা

যুদ্ধের শুরু থেকেই অক্ষশক্তি ছিল দুর্বল। তাদের প্রধান ভরসা ছিল জার্মানি। তার দুই সহযোগী ইতালি ও জাপান ছিল অতি দুর্বল। ইতালি-র কোনও সামরিক শক্তি বা যুদ্ধপ্রস্তুতি ছিল না। তাকে জার্মানির সহযোগী না বলে, ‘বোঝা’ বলাই যুক্তিসংগত। স্পেনের একনায়ক ফ্রাঙ্কো জার্মানিকে কোনোভাবেই সাহায্য করেন নি। যুদ্ধের শুরু থেকেই নানা প্রশাসনিক দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য জাপানের আর্থিক অবস্থাও খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে। ফিনল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি সংকটকালে হিটলারের পক্ষ ত্যাগ করে।

শক্তিশালী মিত্রপক্ষ

ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষের অবস্থা সব দিক থেকেই ভালো ছিল। প্রয়োজনে তারা তাদের উপনিবেশগুলি থেকে অর্থ, অস্ত্র ও সৈন্য আনতে পারত। আমেরিকা তাদের নানাভাবে সাহায্য করে। যুদ্ধে যোগদানের পূর্বেই আমেরিকা মিত্রপক্ষকে প্রথমে নগদে এবং পরে ধারে অস্ত্র জোগাতে থাকে। সুতরাং একদিকে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা এবং রাশিয়ার সম্মিলিত সম্পদ ও উদ্যম, আর অপরদিকে জার্মানির একক সম্পদ ও উদ্যম। এই দুই অসম শক্তির মধ্যে যুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয় অনিবার্য ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান

যুদ্ধের সূচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল। ইতিমধ্যে জাপান দূরপ্রাচ্যে মার্কিন নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারে বিমান আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবল ক্ষুদ্ধ হয় এবং পূর্ণশক্তি নিয়ে মিত্রপক্ষের অনুকূলে যুদ্ধে যোগদান করে। এর ফলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হতে থাকে।

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা

  • (১) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হিটলারের শোচনীয় ব্যর্থতা জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। ফ্রান্স জয়ের পর হিটলার ইংল্যান্ড জয়ে অগ্রসর হন, কিন্তু নৌ-শক্তিতে অপ্রতিরোধ্য ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা হিটলারের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
  • (২) এই কারণে হিটলার বিমান পথে ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সেক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হন। কারণ, ইংল্যান্ডবাসীর সদাজাগ্রত দৃষ্টি এড়িয়ে কোনও জার্মান বিমানের পক্ষে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করা সম্ভব হয় নি।
  • (৩) উপরন্তু, ইংল্যান্ড পাল্টা বিমান আক্রমণ হেনে জার্মানির বহু শিল্প ও নগর ধ্বংস করে এবং বহু জার্মান বিমান ভূপাতিত করে। যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে গুরুত্ব

এই ধরনের সর্বগ্রাসী যুদ্ধে বিমানই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। জাপান এই সত্যটি বুঝতে পারে নি এবং এই কারণে সে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।

শীতের প্রকোপ

হিটলার মনে করেছিলেন যে, জার্মান বাহিনী অপ্রতিরোধ্য। তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন, কিন্তু সেখানকার প্রবল শীত মোকাবিলার জন্য কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। এর ফলে সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

নৌ শক্তির অভাব

জার্মানির নৌ-শক্তির অভাব তাকে যথেষ্ট বেগ দেয়। নৌ-শক্তির অভাবের ফলেই জার্মানির পক্ষে ভারতবর্ষ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেনে পাঠানো সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে মিত্রশক্তির জাহাজগুলি বাধা সৃষ্টি করায় জার্মানির সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়।

রুশ অভিযানের ব্যর্থতা

  • (১) হিটলারের রাশিয়া অভিযান তাঁর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া আক্রমণ করায় হিটলারকে একই সঙ্গে দুটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে হয়।
  • (২) হিটলার যদি রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রেখে সর্বশক্তি নিয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন, তবে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।
  • (৩) হিটলার চেয়েছিলেন যত শীঘ্র সম্ভব রুশ অভিযান শেষ করতে, কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় এবং তিনি রাশিয়ায় দীর্ঘদিনের জন্য আটকে পড়েন।
  • (৪) স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে হিটলার প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। রুশ সেনার প্রতিরোধ অতিক্রম করে নগরে প্রবেশ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞ সেনাপতিরা স্ট্যালিনগ্রাডকে অবরোধ করে রেখে রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল জয়ের পরামর্শ দেন। হিটলার তাদের পরামর্শে কর্ণপাত না করে মহা ভুল করেন।
  • (৫) স্ট্যালিনগ্রাড অভিযান তাঁর মর্যাদার প্রশ্নে রূপান্তরিত হয় এবং এখানেই তিনি তাঁর সব শক্তি নিয়োগ করেও ব্যর্থ হন। এই অভিযানের ব্যর্থতা জার্মানির পতনকে ত্বরান্বিত করে।

হিটলারের চরিত্র

  • (১) হিটলারের ব্যক্তিগত চরিত্রও জার্মানির পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তিনি ছিলেন উদ্ধত, আত্মম্ভরি, প্রভুত্বপরায়ণ, খামখেয়ালি, সবজান্তা এবং সন্দেহপ্রবণ।
  • (২) পদস্থ কর্মচারী বা অভিজ্ঞ সেনানায়কদের তিনি যোগ্য মর্যাদা দিতেন না। তিনি তাঁদের রচিত পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তাঁর ইচ্ছামতো পরিকল্পনা সেনাদল ও প্রশাসনের উপর চাপিয়ে দিতেন।
  • (৩) তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর গোয়েরিং ও হিমলার তাঁর অত্যাচার থেকে রেহাই পান নি। তাঁর স্বেচ্ছাচারে বিব্রত রোমেল-এর মতো দক্ষ তরুণ সেনাপতিও আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এইসব কারণে প্রশাসন ও সেনাদলে অনেকেই তাঁকে পছন্দ করত না এবং তিনিও তাদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন।

মিত্রপক্ষের সুযোগ্য নেতৃত্ব

আমেরিকা, রাশিয়া ও ব্রিটেন – বিশ্বের তিনটি শিল্পোন্নত ও শক্তিশালী দেশের জোট এবং তাদের ধনবল, অস্ত্রবল ও জনবল মিত্রপক্ষের জয়কে অনিবার্য করে তোলে। মিত্রপক্ষের নেতৃত্ব ছিল তিনজন সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়কের হাতে, ইংল্যান্ডে চার্চিল, আমেরিকায় রুজভেল্ট এবং রাশিয়ায় স্ট্যালিন। তাঁদের সুদক্ষ নেতৃত্ব, যুদ্ধ-পরিকল্পনা রচনা এবং যুদ্ধ-পরিচালনার কৃতিত্ব মিত্রপক্ষের জয়কে অনিবার্য করে তোলে।

হেজ -এর মন্তব্য

ঐতিহাসিক হেজ জার্মানির পরাজয়ের জন্য তিনটি কারণের উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল–

  • (১) অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম,
  • (২) রাশিয়ায় হিটলারের ভ্রান্ত রণকৌশল এবং
  • (৩) যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মিত্রপক্ষকে আমেরিকার সাহায্য দান।

উপসংহার:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষে যোগদানকারী দেশগুলি শুরু থেকেই ছিল দুর্বল। অন্যদিকে মিত্রপক্ষের দেশগুলি সব দিক থেকেই ছিল সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। তাই অক্ষশক্তির পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।

(FAQ) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ দুটির নাম কি?

মিত্রপক্ষ ও অক্ষশক্তি।

২. কোন কোন দেশকে নিয়ে মিত্রপক্ষ গঠিত হয়েছিল?

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া।

৩. কোন কোন দেশকে নিয়ে অক্ষশক্তি গঠিত হয়েছিল?

জার্মানি, জাপান ও ইতালি।

৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল কত?

১৯৩৯ খ্রি- ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment