ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ -এর জন্ম, নাম, পিতামাতা, শিক্ষা, বিবাহ, সিপাহি বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিত শপথ গ্রহণ, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও মৃত্যু, সাহিত্য কর্মে তাঁর উল্লেখ, চলচ্চিত্র ধারাবাহিক নির্মাণ, মূর্তি স্থাপন সম্পর্কে জানবো।

ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ প্রসঙ্গে লক্ষ্মীবাঈএর জন্ম, লক্ষ্মীবাঈএর পিতামাতার নাম, লক্ষ্মীবাঈএর শিক্ষা, লক্ষ্মীবাঈএর বিবাহ, ঝাঁসির সিংহাসনে লক্ষ্মীবাঈ, মহাবিদ্রোহে লক্ষ্মীবাঈএর ভূমিকা, মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাঈ, ঝাঁসির রানী ব্রিগেডের নেতৃত্ব, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে ঐতিহাসিক গ্ৰন্থ, লক্ষ্মীবাঈএর মৃত্যু ও সাহিত্য কর্মে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈএর উল্লেখ।

মহাবিদ্রোহের নেত্রী ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ

ঐতিহাসিক চরিত্রঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ
জন্ম১৯ নভেম্বর ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু১৭ জুন ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ
পিতামাতামরুপান্ত তাম্বে ও ভাগীরথী বাঈ তাম্বে
পরিচিতির কারণ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ -এ অংশগ্রহণ ও বীরত্ব প্রদর্শন
ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ

ভূমিকা :- ভারতবর্ষ -এর ইতিহাসে বিপ্লবী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে রয়েছেন রাণী লক্ষ্মী বাঈ। তিনি ঝাঁসীর রাণী বা ঝাঁসী কি রাণী হিসেবেও সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের জন্ম

১৯ নভেম্বর ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে কাশী বা বারাণসী শহরে এক মারাঠি করাডে  ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের নাম

তার প্রকৃত নাম ছিল মণিকর্ণিকা তাম্বে এবং ডাক নাম মনু। লক্ষ্মী বাঈকে ছাবিলি নামে ডাকতেন পেশোয়া, যার অর্থ “ক্রীড়াপ্রেমি সুন্দরী কন্যা”।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের পিতামাতা

তার বাবার নাম মরুপান্ত তাম্বে এবং মা ভাগীরথী বাঈ তাম্বে।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের শিক্ষা

আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি তিনি বাল্যবন্ধু নানা সাহেব এবং তাতিয়া টোপির কাছে ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি তার বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের বিবাহ

১৮৪২ সালে ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাওয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী বাঈ এবং ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিয়ের পরই তার নতুন নামকরণ হয় লক্ষ্মী বাঈ হিসেবে।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের সিংহাসন লাভে প্রতিবন্ধকতা

আনন্দ রাওকে দত্তক নেওয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসীর স্বত্ত্ববিলোপ নীতির কারণে স্বামীর মৃত্যুর পর তার সিংহাসন আরোহণে প্রতিবন্ধকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা

১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাটে ভারতীয় সিপাহীদের বিদ্রোহের সূচনা ঘটে। পরে ঝাঁসীতেও মহাবিদ্রোহের বিস্তার ঘটে।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের শপথগ্রহণ

হলদী-কুমকুম অনুষ্ঠানে ঝাঁসীর রমণীরা শপথ গ্রহণ করেছিল যে, তারা যে কোনো আক্রমণকেই মোকাবিলা করবে এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণকে তারা ভয় পায় না।

ব্রিটিশদের সঙ্গে ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের যুদ্ধ

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সময় প্রাণপণে লড়াই করেন ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ।

  • (১) তাঁর পুত্র সন্তান না থাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জানিয়েছিল ঝাঁসীর সিংহাসনে প্রকৃত উত্তরাধিকারী নেই। তাই ঝাঁসীকে কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণাধীনে নেওয়া হবে। এর উত্তরে রাণী জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর ঝাঁসী কখনোই দিতে রাজি নন।
  • (২) স্যার হিউ রোজ ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনীকে ঝাঁসী দখল করতে বাধ্য করেন। তিনি ঝাঁসী তার কাছে হস্তান্তরের দাবি করেন কিন্তু লক্ষ্মীবাই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
  • (৩) রাণী লক্ষ্মীবাই ব্রিটিশদের বলেছিলেন যে, “আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি। ভগবান কৃষ্ণের ভাষায়, আমরা যদি বিজয়ী হই, বিজয়ের ফল ভোগ করি, যদি যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হই এবং নিহত হই, তবে আমরা অবশ্যই অনন্ত গৌরব ও মুক্তি লাভ করব।”
  • (৪) ১৮৫৮ সালে রাণী লক্ষ্মী বাই তাঁর সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
  • (৫) প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত ব্রিটিশদের কাছ থেকে রাণী তাঁর দুর্গটি রক্ষা করতে পারেননি। ব্রিটিশ বাহিনী তাঁর শহরে প্রবেশ করে প্রাসাদের দিকে রওনা হয়।
  • (৬) রাতের অন্ধকারে দুর্গের দেওয়াল থেকে সন্তানসহ লাফ দিয়ে লক্ষ্মী বাঈ প্রাণরক্ষা করেন।
  • (৭) আনন্দ রাওকে সাথে নিয়ে রাণী তাঁর বাহিনী সহ কাল্পীতে যান। সেখানে তিনি অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেন। তাঁতিয়া তোপির নেতৃত্বেও একটি বিদ্রোহী দল ছিল। এরপর রাণী লক্ষ্মী বাঈ এবং তাঁতিয়া তোপি গোয়ালিয়রের দিকে রওনা দেন।
  • (৮) রাণী লক্ষ্মী বাঈ এবং তাঁতিয়া তোপির সম্মিলিত বাহিনী গোয়ালিয়র কেল্লা দখল করেন।
  • (৯) রাণী পুনরায় ব্রিটিশ আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তিনি আবার ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে হেরে যান।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের মৃত্যু

১৭ জুন ১৮৫৮ সালে ফুল বাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন রাণী লক্ষ্মী বাঈ।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের স্মরণে ঝাঁসী ব্রিগেড গঠন

সুভাষ চন্দ্র বসু তার আজাদ হিন্দ ফৌজ -এর প্রথম নারী দলের নামকরণ করেন রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণ করে ঝাঁসী ব্রিগেড।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের স্মরণে কবিতা রচনা

ভারতীয় মহিলা কবি সুভদ্রা কুমারী চৌহান রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণ করে কবিতা লেখেন ঝাঁসী কি রাণী’। কবিতায় তাকে জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।

পুস্তকে ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের উল্লেখ

১৮৭৮ সালে কর্ণেল ম্যালসন লিখিত “দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইন্ডিয়ান মিউটিনি” পুস্তকে লক্ষ্মী বাঈ বিষয়ে আলোকপাত করেন।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের মূর্তি নির্মাণ

ব্রোঞ্জ মূর্তিতে খচিত ভাস্কর্য্যে রাণী লক্ষ্মী বাঈকে ঝাঁসী এবং গোয়ালিয়র শহরে ঘোড়ায় আরোহিত অবস্থায় অঙ্কিত করা হয়েছে।

সাহিত্য কর্মে ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈের উল্লেখ

বিভিন্ন লেখক লক্ষ্মী বাঈ ও তার বীরত্বের কথা তাদের গ্ৰন্থে তুলে ধরেন। যেমন –

  • (১) জর্জ ম্যাকডোনাল্ড ফ্রেজার রচিত “ফ্ল্যাশম্যান ইন দ্য গ্রেট গেম” শীর্ষক ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক উপন্যাসে ফ্ল্যাশম্যান এবং রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের মধ্যে অনেকগুলো বৈঠকের কথা তুলে ধরা হয়।
  • (২) মাইকেল ডি গ্রেস কর্তৃক ফরাসী ভাষায় লিখিত “লা ফ্যামে সেক্রি” উপন্যাসে ঝাঁসীর রাণীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তুলে ধরা হয়।
  • (৩) ২০০৭ সালে জয়শ্রী মিশ্র ইংরেজি ভাষায় “রাণী” নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক গ্ৰন্থ

মহাশ্বেতা দেবীঝাঁসী কি রাণী” নামে একটি বই লিখেছেন। বইটিতে রাণী লক্ষ্মী বাঈ সম্বন্ধে ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ধারাবাহিক

রাণী লক্ষ্মী বাঈকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র।

  • (১) দ্য টাইগার এণ্ড দ্য ফ্লেম (বাঘ এবং শিখা) ১৯৫৩ সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম টেকনিকালার চলচ্চিত্রের একটি। ছবিটির পরিচালক ও নির্দেশক ছিলেন চলচ্চিত্রকার সোহরাব মোদী।
  • (২) ঝাঁসী কি রাণী নামে একটি হিন্দি টেলিভিশন সিরিজ সম্প্রচার করা হয়েছে।
  • (৩) কেতন মেহতা নির্মিত ছবি দ্য রেবেল বা বিদ্রোহী। মঙ্গল পান্ডেঃ দ্য রাইজিং ছবির একটি সহযোগী চলচ্চিত্র এটি।
  • (৪) ২০১৮ সালে রাধা কৃষ্ণ ও জগরলামুদি মণিকর্ণিকাঃ দ্যা কুইন অফ ঝাঁসি নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রে কঙ্গনা রানাওয়াত রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

উপসংহার :- তিনি ছিলেন ভারতের একজন অত্যন্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। রাণী লক্ষ্মীবাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ হারানো একজন মহান শহীদ হিসেবে তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি সকল নারীর সাহস, বীরত্ব, সাহসিকতা এবং প্রেরণার প্রতীক।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ বিখ্যাত কেন?

ঝাঁসি রাজ্য কোম্পানির অধিগ্রহণ করার প্রতিবাদে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ সিপাহী বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি মহা বিদ্রোহের একজন উল্লেখযোগ্য নেত্রী ছিলেন এবং তিনি পুরুষের বেশে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে অসম সাহস ও বীরত্ব দেখানো সত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মুখযুদ্ধে 17ই জুন 1858 খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

২. ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ কোন আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন?

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহী বিদ্রোহে।

৩. মেদিনীপুরের লক্ষীবাঈ নামে কে পরিচিত?

রাণী শিরোমণি।

৪. ঝাঁসীর রাণীর প্রকৃত নাম কি?

মণিকর্ণিকা তাম্বে।

৫. কবে কার নেতৃত্বে ঝাঁসির রানী ব্রিগেড তৈরি হয়?

১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে লক্ষ্মী সাইগলের নেতৃত্বে।

Leave a Comment