একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ও দেশপ্রেমিক ছিলেন রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮)। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিক যুগের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি পরিচিত। কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা রামগোপাল যুবাবস্থায় ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য হন এবং নারী শিক্ষা, সতীদাহ প্রথা বিলোপ, ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেন। তাঁর প্রভাবশালী বক্তৃতার জন্য তিনি “বাঙালি ডেমোস্থেনিস” নামে পরিচিত ছিলেন। রামগোপাল ঘোষ বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতাও করতেন এবং তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শ্রেষ্ঠ বাগ্মী রামগোপাল ঘোষ
ঐতিহাসিক চরিত্র | রামগোপাল ঘোষ |
জন্ম | ১৫ মার্চ, ১৮১৫ খ্রি |
জন্মস্থান | কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, বক্তা, সাংবাদিক |
উল্লেখযোগ্য পরিচিতি | বাঙালি ডেমস্থিনিস |
প্রধান অবদান | নারী শিক্ষা প্রচার, সতীদাহ প্রথা বিলোপ, সমাজ সংস্কার |
সংগঠন | ব্রাহ্ম সমাজ-এর সক্রিয় সদস্য |
উপাধি | বাঙালির স্বাধীনচেতা পথিকৃৎ |
মৃত্যু | ২৫ জানুয়ারি, ১৮৬৮ খ্রি |
রামগোপাল ঘোষ
ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ রামগোপাল ঘোষ। সেকালে তাঁকে গ্রিস-এর জননেতা ও শ্রেষ্ঠ বাগ্মী, যাঁকে বলা হয় বিশ্বমানবতার বিবেকের বার্তাবহ, তাঁর সঙ্গে তুলনা করে বলা হত ইন্ডিয়ান ডেমোস্থেনিস। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন রামগোপাল, প্রতিহত করেছেন অন্যায়কারীকে। কেবল অনন্যসাধারণ বাগ্মীরূপেই নয়, সমাজ সংস্কার, স্ত্রীশিক্ষা, লোকশিক্ষার প্রসার, জ্বলন্ত দেশপ্রেম প্রভৃতি মহৎ কর্মকৃতিত্বের গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তিতে বাংলার জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রামগোপাল ঘোষ।
রামগোপাল ঘোষের জন্ম
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে উত্তর কলকাতায় বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে মাতুলালয়ে রামগোপালের জন্ম।
বাগ্মী রামগোপাল ঘোষের পরিবার
তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার ত্রিবেণীর কাছে বাঘাটি গ্রামে। পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ। পিতা গোবিন্দচন্দ্র কলকাতায় ছোটখাট ব্যবসা করতেন। সামান্য রুজিরোজগার যা হত তাতে একরকম স্বচ্ছল ভাবেই সংসারযাত্রা নির্বাহ হত।
রামগোপাল ঘোষের শৈশব
শিশু বয়সেই রামগোপালের অসাধারণ মেধা, সাহস ও উপস্থিতবুদ্ধি তাঁর অভিভাবকদের নজর আকর্ষণ করে। নতুন কিছু শেখা ও জানার আগ্রহও ছিল তাঁর প্রবল।
বাগ্মী রামগোপাল ঘোষের শিক্ষা
- (১) গৃহে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর ছয় বছর বয়সে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চিৎপুর রোডে শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে। অসাধারণ প্রতিভাধর বালকের উপযুক্ত পড়াশুনা সাধারণ একটি স্কুলে সুসম্পন্ন হবার সম্ভাবনা অল্পই ছিল। এই সময় ভাগ্যই যেন তাঁকে একটি সামান্য ঘটনার মাধ্যমে সঠিক পথে চালিত হবার পথ করে দিল।
- (২) সেকালের কলকাতায় প্রথম বাঙালি পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হরচন্দ্র ঘোষের নাম সুপরিচিত ছিল। তাঁর সঙ্গে রামগোপালের এক আত্মীয়ার বিবাহ হয়েছিল। বালক রামগোপাল তাঁর ঠাকুমার সঙ্গে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। বিবাহ মণ্ডপে সমবেত কমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেকালে ধাঁধার আসর বসত।
- (৩) ছোটদের বিদ্যাবুদ্ধি যাচাই করার উদ্দেশ্যেই প্রধানত এই ধরনের প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়েছিল। হরচন্দ্রের বিবাহ বাসরে ওইরকম এক আসরে অংশ নিয়ে রামগোপাল অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন হরচন্দ্র। তিনি বাসর ঘরে বসেই রামগোপালের মা ও ঠাকুমাকে পরামর্শ দেন তাঁকে হিন্দু কলেজে পড়াবার জন্য।
- (৪) এই ঘটনায় পরিবারের সকলে উৎসাহিত হয়ে রামগোপালকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু নিয়মিত এই স্কুলে ছেলের পড়ার খরচখরচা চালাবার মত সামর্থ গোবিন্দচন্দ্রের ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠাকুমার অর্থসাহায্যে তাঁকে হিন্দুস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়।
- (৫) এই স্কুলে ভর্তি হবার পর অল্প সময়ের মধ্যেই রামগোপালের মেধা ও অধ্যবসায়ের প্রতি মহামতি ডেভিড হেয়ারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। খুশি হয়ে তিনি নতুন ছাত্রটিকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন। গোবিন্দচন্দ্র এইভাবে পুত্রের পড়ার খরচের চিন্তামুক্ত হলেন।
রামগোপাল ঘোষের নামকরণ
এই সময়ে আকস্মিকভাবেই আরও একটি ইঙ্গিতবহ ঘটনা ঘটল রামগোপালের জীবনে। অনাগত ভবিষ্যতে যে নামে তিনি দেশবিশ্রুত খ্যাতি ও গৌরবের অধিকারী হবেন, নিয়তি যেন আপনা থেকেই তার ব্যবস্থা করে দিল। রামগোপালের প্রকৃত নাম ছিল গোপাল। তিনি তখন হিন্দু কলেজের জুনিয়ার বিভাগে ভর্তি হবেন। বয়স নয়ের কোঠায়। রেজিস্ট্রারে নাম তুলবার সময় হেডমাষ্টারমশাই ডি. এনসেলেস তাঁর নাম জানতে চাইলেন। গোপালের নাম ভালভাবে শুনতে না পাওয়ায় তিনি রেজিস্ট্রারে লিখে ফেলেন রামগোপাল। তখন থেকেই গোপাল রামগোপাল নামকরণ লাভ করলেন।
ডিরোজিও-এর সংস্পর্শে রামগোপাল ঘোষ
- (১) সেই সময় হিন্দু কলেজ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াতেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও নামে এক পর্তুগিজ যুবক। আদি কলকাতাতেই তাঁর জন্ম ও শিক্ষা। তিনি ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানী, সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী যুবক। নিজেকে তিনি ভারতীয় বলেই দাবি করতেন এবং এ দেশকে স্বদেশ বলে গণ্য করতেন।
- (২) ডিরোজিওর সাহচর্যে ও শিক্ষায় হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এক প্রবল পরিবর্তনের হাওয়া আলোড়ন তোলে। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কলেজের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক তালিকায় ইংরাজ কবি আলেকজান্ডার পোপ অনূদিত হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি, কবি ড্রাইডেনের ভার্জিল কাব্য, শেকসপিয়ার-এর একটি বিয়োগান্তক নাটক, কবি মিলটনের প্যারাডাইস লস্ট মহাকাব্য, গে’র ফেবলস প্রভৃতি পড়াবার জন্য সংযোজন করেছিলেন।
- (৩) নিজেও তিনি ক্লাশে রাজনৈতিক দর্শন বিধয়ের শ্রেষ্ঠ পুস্তক, বিভিন্ন দেশের ইতিহাস প্রভৃতি ছাত্রদের পড়ে শোনাতেন। অচিরেই ক্লাশে তীক্ষ্ণ বৃদ্ধি ও অসামান্য উপলব্ধি ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে রামগোপাল ডিরোজিওর মনোযোগ আবর্ষণ করতে সক্ষম হলেন। তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র-শিষ্যদের অন্যতম।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনে রামগোপাল ঘোষ
- (১) ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের ও যুক্তির ভিত্তি সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ডিরোজিও মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগান বাড়িতে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন নামে সম্মিলনী ও বিতর্ক-সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ, অদৃষ্টবাদ, নাস্তিকতা, আস্তিকতা, সাহিত্য, ইতিহাস, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা ও মত বিনিময় হত।
- (২) এই সভায় ছাত্রদের প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ডিরোজিওর প্রগতিপন্থী ছাত্র-শিষ্যরাই প্রধানত অংশ গ্রহণ করত। বলাবাহুল্য, রামগোপালও এখানে সামিল হলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদিতে মধ্যমণি হয়ে উঠলেন।
- (৩) ডিরোজিওর শিষ্যদলের মধ্যে যাঁরা এই সভায় নিয়মিত যোগ দিতেন তাঁদের মধ্যে আটজন, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর), শিবচন্দ্র দেব, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং রামগোপাল ঘোষ ছিলেন অগ্রণী।
- (৪) পরবর্তীকালে এঁরা প্রত্যেকেই বাঙলা তথা ভারতের সংস্কারমূলক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ক্রমে ডিরোজিওর এই সভার আকর্ষণে শহরের বিশিষ্ট শ্বেতাঙ্গ বুদ্ধিজীবী ও রাজপুরুষগণও উপস্থিত হতে লাগলেন।বিভিন্ন সময়ে নানান বিষয়ে ছাত্ররা সভায় স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ ও বিনিময় করতেন।
- (৫) তাদের বক্তৃতা শুনবার জন্য প্রায় সময়ই হাজির থাকতেন বাংলার ডেপুটি গভর্নর ডব্লু, ডব্লু বার্ড, সুপ্রিম কোর্ট-এর প্রধান বিচারপতি লর্ড রায়াস, ডেভিড হেয়ার, গভর্নর জেনারেলের ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল বেনসন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ মিল প্রমুখ।
- (৬) সেকালে এদেশের হিন্দুসমাজ ছিল অজ্ঞানতা, অন্ধ কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে নিমজ্জিত। বস্তুতঃ অজ্ঞানতা তথা প্রকৃত শিক্ষার অভাবই ছিল সকল অধোগতির মূলে। ডিরোজিও উপলব্ধি করেছিলেন উদারপন্থী পাশ্চাত্য শিক্ষায় ছাত্রদের গড়ে তুলতে পারলে তাঁরাই সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে।
- (৭) তাঁর সংকল্প সিদ্ধ হতেও বিলম্ব হয় নি। অচিরেই তাঁর ছাত্ররা ধর্মীয় আচার, জাতিবিচার, ছুঁৎমার্গ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ও নারীশিক্ষার প্রবর্তন, শিক্ষাবিস্তারের সপক্ষে এক প্রতিবাদী বিপ্লবের সূচনা করলেন। ডিরোজিওর ছাত্ররা মুখে যেমন সংস্কারের কথা বলতেন তেমনি তাঁরা আচরণও করতে লাগলেন প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে। তাঁরা জাতিবিচারের প্রতীক উপনয়ন পরিত্যাগ করলেন। নিয়মিত সন্ধ্যাহিকও পরিত্যক্ত হল।
- (৮) সেই সময় তাঁরা সময় কাটাতেন হোমারের মহাকাব্য পড়ে। ধর্মের ধ্বজাধারী সমাজপতি, টিকিধারী ফোঁটাকাটা ব্রাহ্মণ দেখলেই তাঁরা উপহাস বিদ্রূপে মুখর হয়ে উঠতেন। এমনকি তাঁদের অনেকেই ইংরাজদের সংশ্রবে থেকে নিষিদ্ধ খাদ্য খেতে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। মোটকথা, সংস্কারপন্থী ছাত্রদের জীবনযাপনের ধারাই আমূল বদলে গেল।
ডিরোজিয়ান
প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিপরীতে চলতে গিয়ে ডিরোজিওর ছাত্রদের যে সামাজিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সকল প্রকার চাপ ও নির্যাতন সত্ত্বেও নিজেদের মত ও বিশ্বাস থেকে কেউ বিচ্যুত হন নি। বাংলা তথা ভারতের শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে নবজাগরণ-এর দূত রূপে ডিরোজিওর এই ছাত্রদের নাম এদেশের সামাজিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ডিরোজিওর ছাত্ররা চিহ্নিত হয়েছিলেন ডিরোজিয়ান বা ইয়ং বেঙ্গল আখ্যায়।
কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রামগোপাল ঘোষ
রামগোপালের তীব্র জ্ঞান-পিপাসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর মেধা ও অধ্যবসায়। ডিরোজিওর প্রগতিমুখী সংস্কার আন্দোলনের প্রচারের পাশাপাশি কলেজের পড়াও চলছিল পুরোদমে। কিন্তু কথায় বলে অর্থচিন্তা চমৎকারা। তাই পারিবারিক প্রয়োজনে অর্থোপার্জনের জন্য কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখেই রামগোপালকে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল।
মুৎসুদ্দি ও বেনিয়ান রামগোপাল ঘোষ
অল্পদিনের চেষ্টাতেই যোসেফ নামে এক ইহুদী ব্যবসায়ীর গদিতে সামান্য বেতনের একটা কাজ জুটিয়ে নিলেন রামগোপাল। কিছুদিন পরে কেলসন নামে এক ধনী ব্যবসায়ী যোসেফের ব্যবসার অংশীদার হলে রামগোপালের পদোন্নতি হল। মুৎসুদ্দির দায়িত্ব পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আয় রোজগারও বাড়ল। অংশীদারী বিবাদের ফলে অল্পসময়ের ব্যবধানেই কেলসন ও যোসেফের ব্যবসা আলাদা হয়ে গেল। কেলসন রামগোপালকে তাঁর নিজস্ব কোম্পানিতে বেনিয়ান করে নিয়ে এলেন। ফলে তাঁর রোজগারও আগের তুলনায় বাড়ল অনেক গুণ। রামগোপালের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও বৈষয়িকজ্ঞানে সন্তুষ্ট হয়ে কেলসন তাঁকে নিজের কোম্পানির অংশীদার করে নিলেন। কোম্পানির পরিবর্তিত নাম হল কেলসন ঘোষ অ্যান্ড কোং।
রামগোপাল ঘোষের স্বাধীন ব্যবসা
খুব বেশিদিন এই যৌথ ব্যবসায়ে যুক্ত থাকতে হয় নি উদ্যোগী পুরুষ রামগোপালকে। অচিরেই তিনি আর জি ঘোষ কোম্পানি নামে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করলেন। সময়টা ছিল ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ। উচ্চশিক্ষিত বাঙালীরা যেকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি ছিলেন বিমুখ, সেই সময়ে প্রথম পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়ে রামগোপাল নিজস্ব স্বাধীন ব্যবসায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে অসাধারণ কর্মকুশলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রামগোপালের ব্যক্তিগত জীবনের সহৃদয়তা সততা ও সত্যপরায়ণতার মতো মূলধন। ফলে অচিরেই বাণিজ্যলক্ষ্মীর কৃপা লাভ করে তাঁর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিলাভ ঘটে।
শিক্ষা প্রসারের কাজে রামগোপাল ঘোষ
ছাত্রাবস্থায় শিক্ষাগুরু ডিরোজিওর কাছ থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন রামগোপাল, লক্ষ্মী লাভের পরও সেই চিন্তাধারা থেকে বিচ্যুত হন নি তিনি। শিক্ষাপ্রসারের মাধ্যমে দেশের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করার কাজে তিনি আজীবন লিপ্ত থেকেছেন। বস্তুতঃ তাঁর সকল কাজের প্রেরণার উৎস ছিল দেশপ্রীতি, দেশের সমাজ ও মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নতি। বাণিজ্যের কাজে ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিয়মিত পড়াশুনার চর্চা বজায় রেখেছিলেন। সুযোগ মতো সভাসমিতিতে যোগ দিতেন, অংশগ্রহণ করতেন জ্ঞানগর্ভ আলোচনায়।
লেখক রামগোপাল ঘোষ
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিওর পরলোক গমনের পর তাঁর শিষ্যরা গুরুর চিন্তাধারা সক্রিয় রাখার উদ্দেশ্যে একত্র মিলিত হয়ে গঠন করেছিলেন এপিস্টোনারি অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সমিতি। তাঁদের সম্পাদনায় জ্ঞানান্বেষণ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার লেখকদের মধ্যে রামগোপাল ছিলেন অন্যতম। লেখালেখির বাইরে সুবক্তা রূপেও যথাকালে খ্যাতিলাভ করেছিলেন তিনি।
জর্জ টমসন ও রামগোপাল ঘোষ
- (১) জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রিন্স দ্বারকানাথ ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসেন। সেই সময় জর্জ টমসন নামে এক ইংরাজ বাগ্মী তাঁর সঙ্গে এদেশে আসেন। এই সাহেব ছিলেন মানবতাবাদী সংগঠক। আমেরিকায় দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করেছিলেন।
- (২) সেই সময়ে অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন ভারতের মানুষের দুর্দশার কথা জানতে পেরে টমসন দ্বারকানাথের সঙ্গী হয়েছিলেন। এদেশে এসে তিনি ডিরোজিওর প্রারব্ধ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাঁর ভাষণ শুনে মানুষ উদ্বুদ্ধ হত। স্বভাবতঃই রামগোপাল ও তাঁর বন্ধুরা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
- (৩) ডিরোজিওপন্থী যুবকদল অচিরেই টমসন সাহেবকে সানন্দে গুরুর স্থলাভিষিক্ত করে নিলেন। রামগোপাল তাঁর একান্ত অনুগত শিষ্য হয়ে উঠলেন। তিনি টমসন সাহেবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি নামে এক সমিতি প্রতিষ্ঠা করে সংস্কার আন্দোলনের প্রচার শুরু করলেন। রামগোপাল ছিলেন এই সমিতির অন্যতম প্রধান বক্তা।
- (৪) টমসন সাহেবের প্রভাবে রামগোপাল ও ডিরোজিওর অন্যান্য শিষ্য ক্রমেই দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়তে লাগলেন। এই সময়ে রামগোপালের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় দেশব্যাপী গণচেতনার উদ্দীপনা ঘটে। তাঁর আগুনঝরা ভাষা ও শাণিত যুক্তির প্রভাবে এই সময়ে বহু অন্যায় অবিচারের প্রতিবিধান হয়েছে।
রামগোপাল ঘোষের বাগ্মীতার প্রভাব
- (১) তাঁর প্রদত্ত বহু বক্তৃতা সেইকালে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই তাঁর বাগ্মীতার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ এদেশে গভর্নর হয়ে এসে শিক্ষাবিস্তারের কাজে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন। এজন্য ভারতবাসী তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল।
- (২) তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা টাউন হলে স্মৃতিসভার আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে লর্ড হার্ডিঞ্জের একটি মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সেই সভায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গের মধ্যে লর্ড হিউম, টারটন ও কোলভিল প্রমুখ ইংরাজ ব্যারিস্টার এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভাষণ দেন। ফলে লর্ড হার্ডিঞ্জের মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বানচাল হতে বসে।
- (৩) সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রামগোপাল এবং ডিরোজিওর সুযোগ্য শিষ্য দলের অন্যতম কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। তাঁরা হার্ডিঞ্জের স্মৃতিরক্ষার প্রস্তাবের সপক্ষে বলার জন্য রামগোপালকে অনুরোধ জানালেন। রামগোপাল তখন হার্ডিঞ্জের প্রতি দেশবাসী কেন এত কৃতজ্ঞ তা ব্যাখ্যা করে ওজস্বী ভাষায় বক্তৃতা করেন।
- (৪) তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ আবেগময় বক্তব্য উপস্থাপনায় উচ্চারিত ভাষণ শ্রোতাদের এতটাই মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করল যে গোটা সভাগৃহ স্তব্ধ হয়ে রইল। বক্তৃতার শেষে তুমুল করতালিতে সকলে বক্তাকে অভিনন্দন জানাল। রামগোপালের শাণিত যুক্তির সামনে সেদিন নস্যাৎ হয়ে গেল ইংরাজ ব্যারিস্টারদের বিরোধী বক্তব্য।
- (৫) এইদিনের ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্রিকায়। তাঁরা লিখেছিলেন, “এ ডেমোস্থিনিস হ্যাজ আপিয়ার্ড অন দি প্লাটফর্ম এ ইয়ং বেঙ্গলি হ্যাড ফ্লোরড থ্রি ইংলিশ ব্যারিস্টারস।”
- (৬) রামগোপালের বক্তৃতার ফলে এরপরই দেশবাসীর আন্তরিক চেষ্টায় লর্ড হার্ডিঞ্জের একটি অপূর্ব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল গড়ের মাঠে। সেই মূর্তিসহ তদানীন্তনকালের বহু দেশহিতৈষী কর্মযোগী পুরুষের মূর্তি বর্তমানে অপসারিত হয়েছে। ফলে অতীত ইতিহাসের নিদর্শন দর্শনলাভে আজ দেশবাসী বঞ্চিত।
দেশহিতৈষী রামগোপাল ঘোষ
- (১) রামগোপালের অবদান দেশহিতৈষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত। তিনি স্কুল স্থাপনের কাজে ডেভিড হেয়ারকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। নিজ পল্লীতেও একটি স্কুল ও পাঠাগার স্থাপন করেছিলেন। এককালে বেনিভোলেন্ট সোসাইটির সম্পাদক রূপে হিন্দু চ্যারিটেবল ইনসটিটিউট স্থাপনেও সাহায্য করেন।
- (২) এডুকেশন কাউন্সিলের সদস্য থাকাকালে তাঁরই উদ্যোগে এদেশে বিদ্যালয় স্থাপনের বেসরকারী চেষ্টায় সরকারী সাহায্যদানের রীতি প্রবর্তিত হয়। নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সাহেবকে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে রামগোপাল সক্রিয় সাহায্যদান করেন।
- (৩) চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চশিক্ষালাভের জন্য দ্বারকানাথ চারজন ছাত্রকে বিলাতে পাঠাবার পরিকল্পনা করলে রামগোপাল পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনিই ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম প্রস্তাব করেন। সেইকালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির রাজনৈতিক বক্তৃতায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিতেন।
- (৪) সেইকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হত না। শ্বেতাঙ্গদেরই তাতে একচেটিয়া অধিকার ছিল। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রামগোপাল প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের সুযোগ দেবার জোরালো দাবি তোলেন।
- (৫) ভারতীয়দের আইন ও আদালতে সমানাধিকারের আইনের খসড়ার সমর্থনে রামগোপাল A few remarks on certain Draft Acts. Commonly called Black Act নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ ও নিন্দা এই পুস্তিকায় স্থান পেয়েছিল। এরফলে শ্বেতাঙ্গদের রোষোৎপত্তি ঘটে এবং তিনি অ্যাগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটির সহ-সভাপতি পদ থেকে অপসারিত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে রামগোপাল ঘোষ
নবীন বাংলা গঠনের অন্যতম পথিকৃত, অকৃত্রিম স্বদেশ হিতৈষী রামগোপাল ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন, উদার, সত্যনিষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী ও বন্ধুবৎসল। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালী। ধর্মীয় কুসংস্কারের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন আজীবন। বাগ্মী ও সমাজ সংস্কারক রামগোপাল স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের প্রসারে সচেষ্ট ছিলেন। মহাত্মা ডেভিড হেয়ারের স্কুল স্থাপনে তিনি নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। নিজ পল্লীতে একটি স্কুল ও পাঠাগার স্থাপন করেন। এছাড়া বেনিভোলেন্ট সোসাইটির সম্পাদক রূপে হিন্দু চ্যারিটেবল ইনসটিটিউশন স্থাপনেও সাহায্য করেন।
রামগোপাল ঘোষের বিবাহ
সংস্কারক রামগোপালের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খুব অল্পই জানা যায়। সেকালের সামাজিক প্রথা মেনে কৈশোরেই বিবাহ করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন অশেষ গুণশালিনী মহিলা। তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও সেবাপরায়ণতা ছিল অসাধারণ। অর্থবান স্বামীর ঘরণী হয়েও অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে জীবন যাপন করতেন তিনি। প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে রামগোপালের দুই পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। অল্প বয়সেই পুত্র দুটির মৃত্যু হয়েছিল। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর রামগোপাল দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় সংসারে তাঁর কোনও সন্তান ছিল না।
বাগ্মী রামগোপাল ঘোষের বন্ধুবাৎসল্য
- (১) বিষয়কর্মের ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও রামগোপাল নানা বিষয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। নানা সভাসমিতিতেও তিনি যোগ দিতেন এবং বক্তৃতা দিতেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা সকলের বিস্ময় উৎপাদন করত। রামগোপালের বন্ধুবাৎসল্য এমনই ছিল যে তখনকার কলকাতায় এ নিয়ে লোকের মুখে মুখে অনেক গল্প তৈরি হয়েছিল।
- (২) যে কোনও বিপদ আপদে তিনি তাঁর বন্ধুদের পাশে উপস্থিত থাকতেন। অর্থ, সামর্থ্য সকল প্রকারেই তিনি বন্ধুদের সাহায্য করতেন। বন্ধুরা একদিন তাঁর বাড়িতে না এলে তিনি অস্থির হয়ে তাঁদের খোঁজ নিতেন।
- (৩) রামগোপালের বাল্যবন্ধু ও ফাইভ ফ্লাওয়ার্স অব হিন্দু কলেজ-এর অন্যতম রসিককৃষ্ণ মল্লিক একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নিজের গঙ্গাতীরের বাগানবাড়িতে রেখে রামগোপাল চিকিৎসা ইত্যাদির যাবতীয় ভার বহন করেছিলেন। রামগোপালের সহৃদয়তা ও সত্যপরায়ণতার কথা লোকের মুখে মুখে ফিরত।
রামগোপাল ঘোষের প্রতি সমাজের উৎপাত
প্রগতিবাদী ডিরোজিওর শিষ্য ভক্ত হওয়ার ফলে রামগোপালকে সমাজের উৎপাতও কম সইতে হয় নি। তাঁর ঠাকুরদার মৃত্যুর পরে সমাজপতিরা মৃতের পারলৌকিক কাজে অংশ নিতে অস্বীকার করে প্রচার করতে লাগল রামগোপাল হিন্দু ধর্মবিদ্বেষী ও সমাজচ্যুত। ভয় পেয়ে রামগোপালের বাবা ছেলেকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন কাতরতা ও চোখের জল দেখে রামগোপালের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। চোখের জল ফেলতে ফেলতেই ব্যাকুলস্বরে তিনি বলেন, ‘বাবা, আপনার অনুরোধে আমি সব কাজ করতে পারি, সমস্ত ক্লেশ সহ্য করতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু বাবা মিথ্যা কথা বলতে পারব না।’ তাঁর এরূপ সত্যপরায়ণতা রামগোপালকে তাঁর দেশবাসীর হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ন্যায়নিষ্ঠ রামগোপাল ঘোষ
একবার, ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা সেটি, ব্যবসাসূত্রে এমন ঝুঁকি দেখা দিল যে প্রচুর দেনার দায় রামগোপালের কাঁধে চাপার উপক্রম হল। সেই দায় এড়াবার জন্য তাঁর বিষয়ী বন্ধুরা পরামর্শ দিল বিষয় সম্পত্তি সমস্ত বেনামী করে ফেলবার জন্য। তাঁদের সে পরামর্শ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে রামগোপাল বন্ধুদের বললেন, ‘আমি যদি সর্বস্বান্ত হই, তাও হাসিমুখে মেনে নেব। কিন্তু কাউকে আমি বঞ্চিত করতে পারব না। সবার ঋণ আমি পরিশোধ করব।’ বাণিজ্যকর্মী হলেও আপন ন্যায়নিষ্ঠার ক্ষেত্রে রামগোপাল ছিলেন নির্ভীক সৈনিকের মতোই অবিচল।
রামগোপালের কর্মকৃতিত্বের স্মারক নিমতলার শ্মশানঘাট
- (১) নিমতলার বর্তমান শ্মশানঘাট রামগোপালের কর্মকৃতিত্বের জয় ঘোষণার অন্যতম স্মারক হয়ে আছে। সময়টা ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ২৬ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন কলকাতার মিউনিসিপালিটি প্রস্তাব নিল গঙ্গাতীর থেকে নিমতলা শ্মশানঘাট অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হবে। এই সংবাদে কলকাতাবাসী হিন্দুরা মর্মাহত হল।
- (২) দীর্ঘকালের স্থায়ী শ্মশানঘাট পবিত্র গঙ্গার তীর থেকে অপসারিত হলে হিন্দুদের লাঞ্ছনার শেষ থাকবে না। সকলে মিলে একত্রিত হয়ে এই অন্যায় উদ্যোগের বিরোধিতা করবার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। কলকাতার হিন্দু সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা রামগোপালের শরণাপন্ন হলেন।
- (৩) সকলেরই বিশ্বাস, যুক্তিতর্কের অস্ত্রে একমাত্র রামগোপালের পক্ষেই সম্ভব মিউনিসিপ্যালিটির অন্যায় জেদ চূর্ণ করা। অচিরেই রামগোপালকে নেতা করে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা আয়োজিত হল। সেই সভায় রামগোপাল তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা ও যুক্তির সাহায্যে মিউনিসিপ্যালিটির প্রস্তাবের অসারতা প্রমাণ করলেন।
- (৪) তিনি বললেন, ‘হিন্দুমাত্রই কামনা করে মৃত্যুর পরে পবিত্র গঙ্গার তীরে তার দেহের দাহকার্য সম্পন্ন হবে এবং তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এই বিশ্বাস পোষণ করি। মহামান্য সরকার বাহাদুর যদি হিন্দুদের এই ঐকান্তিক বাসনার বিঘ্নসৃষ্টি করতে চান অন্য কোন স্থানে গঙ্গাতীরের শ্মশানঘাট স্থানান্তরিত করে তাহলে, দেশের প্রজাসাধারণের বৃহত্তম অংশ এ কাজকে তাঁদের জাতীয় জীবনে একটা মারাত্মক বিপর্যয় বলেই বিবেচনা করবে। শান্তিপ্রিয় প্রজাদের মধ্যে এইভাবে অসন্তোষের বীজ রোপন করা প্রশাসনের পক্ষে হিতজনক কখনোই হতে পারে না।’
- (৫) রামগোপালের জোরালো প্রতিবাদ, শানানো বক্তৃতার ফলেই শেষ পর্যন্ত কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি শ্মশানঘাট স্থানান্তরের প্রস্তাব কার্যকর করা থেকে বিরত হয়। নাগরিকদের এই জয়লাভের পেছনে রামগোপালের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করে দেশের মানুষ উল্লাসে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিল।
মহৎকর্মে রামগোপাল ঘোষ
শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় একসময় রামগোপাল বিষয়কর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবে মৃত্যুর পূর্বে আর এক মহৎকর্মের অনুষ্ঠান করেন তিনি। তখনো পর্যন্ত বন্ধুদের কাছে তাঁর অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। তিনি কারও কাছে সেই টাকার দাবি জানান নি। কেবল তাই নয় বন্ধুদের ঋণমুক্ত করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। পরপারের দুয়ারে পৌঁছে বন্ধুবৎসল রামগোপাল এই বন্ধুকৃত্য করে এক অবিশ্বাস্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন। রামগোপাল স্বল্পায়ু পেয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর সঞ্চিত অর্থের একটা বড় অংশ ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটির দেশীয় শাখায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দান করে যান।
রামগোপাল ঘোষের মৃত্যু
অবশেষে চুয়ান্ন বছর বয়সে ২৬ জানুয়ারি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধাপুরুষ অক্লান্তকর্মা রামগোপাল ঘোষ চিরবিশ্রাম লাভ করেন।
উপসংহার :- রামগোপাল ঘোষ ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট সমাজসংস্কারক ও দেশপ্রেমিক। ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বাংলার সমাজকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বক্তৃতার গভীরতা ও শক্তি বাঙালি জাতির আত্মসচেতনতা জাগিয়ে তোলে। তিনি নারী শিক্ষা, সতীদাহ প্রথা বিলোপ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে এক প্রগতিশীল সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তাঁর চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড শুধু তাঁর সময়ের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস। রামগোপাল ঘোষের জীবন এবং অবদান আজও বাঙালির ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।
(FAQ) রামগোপাল ঘোষ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
রামগোপাল ঘোষ তাঁর প্রভাবশালী ও উদ্দীপনামূলক বক্তৃতার জন্য বাঙালি ডেমোস্থেনিস নামে পরিচিত ছিলেন। ডেমোস্থেনিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিকের বিখ্যাত বক্তা, এবং রামগোপাল তাঁর সমান প্রতিভাবান বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
রামগোপাল ঘোষ সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করেছেন। তিনি নারী শিক্ষা প্রচার, সতীদাহ প্রথা বিলোপ, ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
রামগোপাল ঘোষ ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাংবাদিকতা করতেন।
রামগোপাল ঘোষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজে শিক্ষা, ন্যায়বিচার, এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।