আজ আমরা মহাপদ্ম নন্দ (Mahapadma Nanda) -এর বংশ পরিচয়, নন্দের রাজত্বকাল, নন্দের রাজ্যাভিষেক, নন্দ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট, নন্দের রাজ্য বিস্তার প্রভৃতি সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন মগধ সাম্রাজ্যের নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম নন্দ প্রসঙ্গে তার জন্ম পরিচয়, বংশ পরিচয়, বৌদ্ধ গ্ৰন্থে মহাপদ্ম নন্দ, পুরাণে মহাপদ্ম নন্দ, মহাপদ্ম নন্দর উপাধি, মহাপদ্ম নন্দর দ্বারা ক্ষত্রিয়দের উচ্ছেদ, মহাপদ্ম নন্দর রাজ্যাভিষেক, মহাপদ্ম নন্দর রাজত্বকাল, প্রথম নন্দ রাজার বংশ বিতর্ক, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় নন্দ রাজা, পুরাণ ও বৌদ্ধ গ্ৰন্থের ভিন্ন মত, জৈন উপাদানে মহাপদ্ম নন্দ, গ্ৰিকো রোমান উপাদানে মহাপদ্ম নন্দ, নন্দ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা মহাপদ্ম নন্দ, মহাপদ্ম নন্দর সাম্রাজ্য বিস্তার, মহাপদ্ম নন্দর বিশাল সেনাবাহিনী, মহাপদ্ম নন্দর দক্ষিণ ভারত অভিযান, মহাপদ্ম নন্দ কর্তৃক আর্যদের উপনিবেশ দখল, কলিঙ্গ ও মহাপদ্ম নন্দ, মহাপদ্ম নন্দ কর্তৃক প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন, মহাপদ্ম নন্দকে অনুসরণ ও ধননন্দের সিংহাসনে আরোহণ।
রাজা মহাপদ্ম নন্দ (Raja Mahapadma Nanda)
ঐতিহাসিক চরিত্র | মহাপদ্ম নন্দ |
জন্ম | আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টপূর্ব |
পিতা | মহানন্দি |
উপাধি | একরাট |
ধর্ম | জৈন ধর্ম |
মৃত্যু | আনুমানিক ৩২৯ খ্রিস্টপূর্ব |
ভূমিকা :- পুরাণ অনুসারে, মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন প্রাচীন ভারত -এর নন্দ বংশ -এর প্রথম সম্রাট।
মহাপদ্ম নন্দের বংশ পরিচয়
পুরাণ মহাপদ্ম নন্দকে শেষ শৈশুনাগ রাজা মহানন্দিন ও একজন শূদ্র নারীর পুত্র হিসেবে বর্ণনা করে এবং তাকে ব্যাপক বিজয়ের কৃতিত্ব দেয়।
বৌদ্ধ গ্ৰন্থে মহাপদ্ম নন্দ
ভারতের বৌদ্ধ গ্রন্থে মহাপদ্ম নন্দের উল্লেখ নেই। তার পরিবর্তে প্রথম নন্দ শাসকের নাম ডাকাত থেকে পরিণত হওয়া রাজা উগ্রসেন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তার আট ভাই। এদের মধ্যে শেষ নন্দরাজা ছিলেন ধননন্দ।
পুরাণে মহাপদ্মনন্দ
ভারতের পুরাণ অনুসারে প্রথম নন্দ রাজাকে বলা হত মহাপদ্ম বা মহাপদ্ম-পতি, আক্ষরিক অর্থে “মহান পদ্মের অধিপতি”।
মহাপদ্ম নন্দের উপাধি
পুরাণ মহাপদ্ম নন্দকে একরাট (একমাত্র সার্বভৌম) এবং সর্ব-ক্ষত্রান্তক (সমস্ত ক্ষত্রিয়দের ধ্বংসকারী) হিসাবে বর্ণনা করেছে। তাছাড়া দ্বিতীয় পরশুরাম নামেও তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সম্রাট মহাপদ্ম নন্দ কর্তৃক ক্ষত্রিয়দের উচ্ছেদ
মহাপদ্ম নন্দ দ্বারা উচ্ছেদ হয়েছিল বলে কথিত ক্ষত্রিয়দের (যোদ্ধা ও শাসকদের) মধ্যে রয়েছে মৈথাল, কাশেয়, ইক্ষ্বাকু, পাঞ্চাল, শূরসেন, কুরু, বিতিহোত্র, কলিঙ্গ এবং অশ্মক।
মহাপদ্ম নন্দের রাজত্বকাল
তাঁর শাসনকাল নিয়ে মতভেদ আছে।
- (১) মৎস্য পুরাণে মহাপদ্ম নন্দের শাসনকাল অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ ৮৮ বছর নির্ধারিত করা হয়েছে।
- (২) বায়ু পুরাণে মহাপদ্ম নন্দের রাজত্বের দৈর্ঘ্য মাত্র ২৮ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।
- (৩) পুরাণে আরও বলা হয়েছে যে মহাপদ্ম নন্দের আট পুত্র পর পর মোট ১২ বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এই পুত্রদের মধ্যে শুধুমাত্র একজনেরই নাম পাওয়া যায় – সুকল্প।
সম্রাট মহাপদ্ম নন্দের রাজ্যাভিষেক
প্রথম নন্দ রাজা মহাপদ্ম নন্দের রাজ্যাভিষেক নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।
- (১) এফ. ই. পারগিটার মহাপদ্ম নন্দের রাজ্যাভিষেকের সময়সীমা ৩৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে উল্লেখ করেন।
- (২) ইতিহাসবিদ আর. কে. মুখার্জি ৩৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাপদ্ম নন্দের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল বলে মনে করেন।
- (৩) এইচ. সি. রায়চৌধুরীর মতে, ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাপদ্ম নন্দের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।
- (৪) অবশ্য নন্দ রাজত্বের সূচনা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বলে মনে করা হয়।
প্রথম নন্দ রাজা উগ্ৰসেন, মহাপদ্ম নয়
বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থ অনুসারে প্রথম নন্দ রাজা ছিলেন উগ্রসেন, মহাপদ্ম নয়।
প্রথম নন্দ রাজা মহাপদ্ম নন্দের বংশ বিতর্ক
প্রথম নন্দ রাজা ও তার বংশ পরিচয় নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে।
- (১) পুরাণগুলি মহাপদ্ম নন্দকে মিশ্র রাজকীয়-শূদ্র বংশ হিসেবে উল্লেখ করে।
- (২) বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি উগ্রসেনকে “অজানা বংশ” হিসাবে বর্ণনা করে।
- (৩) মহাবংশ-টিকা অনুসারে উগ্রসেন সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ডাকাত দলের দ্বারা বন্দী হন এবং পরে তাদের নেতা হন।
আলেকজান্ডারের সময় নন্দরাজা
গ্রিকো-রোমান সূত্রগুলি আলেকজান্ডার -এর আক্রমণের সময় নন্দ রাজাকে “অ্যাগ্রামেস” বলে অভিহিত করে। এটি সম্ভবত সংস্কৃত শব্দ “অগ্রাসেনিয়া” (আক্ষরিক অর্থে, “উগ্রসেনের পুত্র বা বংশধর”) এর অপভ্রংশ।
মহাপদ্ম নন্দ সম্পর্কে পুরাণ ও বৌদ্ধ গ্ৰন্থের ভিন্ন মত
পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে যে, মহাপদ্ম নন্দ ও তার আট পুত্র পর পর রাজত্ব করেন। কিন্তু বৌদ্ধ গ্রন্থে পরবর্তী আট রাজাকে ভাই হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, পুত্র নয়।
জৈন উপাদানে মহাপদ্ম
- (১) মহাবীর সম্পর্কিত জৈন ধর্মগ্রন্থ পরিশিষ্ঠপার্বণ এবং আবশ্যক সূত্রে, “মহাপদ্ম” নামেরও উল্লেখ নেই, যিনি ছিলেন একজন নাপিত ও গণিকার পুত্র।
- (২) জৈন উপাদান গুলি উল্লেখ করে যে, নন্দ একজন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার কাছ থেকে তার মৃত্যুর পর উদয়ীনের স্থলাভিষিক্ত হন।
- (৩) জৈন উপাদানে একজন অহিংস জৈন কল্পকাকে প্রথম নন্দ রাজার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যিনি শান্তির জন্য তার জীবন উৎসর্গ করায় বিশ্বাসী ছিলেন।
গ্রিকো-রোমান উপাদান
গ্রিকো-রোমান সূত্র থেকে জানা যায় যে, নন্দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন নাপিত, যিনি পূর্ববর্তী রাজবংশের শেষ রাজার কাছ থেকে সিংহাসন দখল করেছিলেন।
- (১) রোম -এর ঐতিহাসিক কার্টিয়াস বলেছেন যে, পোরাসের বক্তব্য অনুযায়ী এই নাপিত তার আকর্ষণীয় চেহারার জন্য প্রাক্তন রাণীর প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল এবং তৎকালীন রাজাকে হত্যা করেছিল।
- (২) তৎকালীন রাজকুমারদের অভিভাবক হিসাবে কাজ করার ছলে কৌশলে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দখল করেছিল এবং পরে রাজকুমারদের হত্যা করে।
নন্দ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট মহাপদ্ম নন্দ
মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন নন্দ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট।
মহাপদ্ম নন্দের রাজ্য বিস্তার
তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি কোশল, কুরু, মৎস্য, চেদী, অবন্তী, যার রাজধানী উজ্জয়িনী প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন।
সম্রাট মহাপদ্ম নন্দের বিশাল সেনাবাহিনী
দিগ্বিজয়ের উদ্দেশ্যে তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন। তৎকালীন ইতিহাস অনুসারে মহাপদ্ম নন্দের অধীনে ২০০০০০ পদাতিক, ২০০০০ অশ্বারোহী, ৪০০০ যুদ্ধরথ ও ২০০০ হস্তীবাহিনী ছিল। অবশ্য এ নিয়ে মতান্তর আছে।
মহাপদ্ম নন্দের দক্ষিণ ভারত অভিযান
সোমদেবের “কথাসরিৎসাগর” থেকে জানা যায় যে, মহাপদ্ম নন্দ দক্ষিণ ভারতেরও বিরাট অংশ জয় করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের কলিঙ্গ ও অশ্মক রাজ্য দুটো জয় করেছিলেন।
সম্রাট মহাপদ্ম নন্দ কর্তৃক আর্যদের উপনিবেশ দখল
অশ্মক হল মহারাষ্ট্রের পূর্ব অংশে একটি প্রাচীন রাজ্য। এটি দক্ষিণ ভারতে আর্যদের একটি বিখ্যাত উপনিবেশ ছিল, যা মহাপদ্ম নন্দ দখল করেন বলে মনে করা হয়।
কলিঙ্গ ও মহাপদ্ম নন্দ
ভারতে কলিঙ্গ হল উড়িষ্যার প্রাচীন নাম। কলিঙ্গের হাতিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি কলিঙ্গে জল সেচের জন্য একটি বিরাট জল প্রণালী নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কলিঙ্গ থেকে একটি জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তিও রাজধানীতে নিয়ে যান।
মহাপদ্ম নন্দ কর্তৃক প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন
তিনি আমাদের দেশ ভারতবর্ষ -এর ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হন।
নন্দ রাজা মহাপদ্ম নন্দকে অনুসরণ
সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করে মহাপদ্ম নন্দ একরাট উপাধি গ্রহণ করেন। পরে তাকে অনুসরণ করে পশ্চিম ভারতের রাজারা বিরাট ও দক্ষিণ ভারতের রাজারা সম্রাট উপাধি গ্রহণ করে।
মহাপদ্ম নন্দের পর ধননন্দের সিংহাসনে আরোহণ
সম্রাট মহাপদ্ম নন্দের পর তার পুত্র ধননন্দ বা উগ্রনন্দ রাজা হন। ধননন্দের সময় রাজ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। ধননন্দের সময়ে পাটলিপুত্র নগরে পাঁচটি ধর্মস্তূপ নির্মিত হয়েছিল।
উপসংহার :- ডাক্তার রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় এর মতে, মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম মহান ঐতিহাসিক সম্রাট।
(FAQ) মহাপদ্ম নন্দ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহাপদ্ম নন্দ।
ধননন্দ।
একরাট ও সর্বক্ষত্রান্তক।