রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত -এর প্রবর্তক, প্রবর্তন কাল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মোহমুক্তি, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের জনক, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলী, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সাথে রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের পার্থক্য, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল সম্পর্কে জানবো।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রসঙ্গে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কি, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন স্যার টমাস মুনরো, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে সরাসরি কৃষকদের থেকে রাজস্ব আদায়, জমিদারি বন্দোবস্তের পরিবর্তিত রূপ রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, রায়ত কথার অর্থ কৃষক, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে টীকা, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুপারিশ, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের শর্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুফল ও রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কুফল সম্পর্কে জানব।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত (The Ryotwari Settlement)

ঐতিহাসিক ঘটনারায়তওয়ারি বন্দোবস্ত
প্রবর্তকক্যাপ্টেন আলেকজাণ্ডার রীড ও টমাস মনরো
জনকটমাস মনরো
প্রবর্তন কাল১৮২০ খ্রিস্টাব্দ
প্রচলিত অঞ্চলমাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত

ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত-এ ইংরেজ শাসন সম্প্রসারিত হলে ঐ সব অঞ্চলে কী ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মোহমুক্তি

ইতিমধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ত্রুটিগুলি প্রকট হয়ে উঠতে থাকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়ে নতুন কিছু করার কথা চিন্তা করছিলেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলন অসম্ভব

এই সব অঞ্চলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের কোনও উপায়ও ছিল না। এর কারণ গুলি হল –

  • (১) এই সব স্থানে বাংলার মতো কোনও বৃহৎ জমিদারশ্রেণী ছিল না।
  • (২) এই সব স্থানের জমিদাররা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। সুতরাং এই সব বিরুদ্ধবাদী জমিদারদের সঙ্গে কোনও বন্দোবস্তে আসা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব ছিল না।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত

ক্যাপ্টেন আলেকজাণ্ডার রীড ও তাঁর সহকারী টমাস মনরো এই অঞ্চলের শাসনভার প্রাপ্ত ছিলেন। বহু অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার পর তাঁদের উদ্যোগে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে যে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় তা রায়তওয়ারি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের জনক

টমাস মনরোকে রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের জনক বলা হয়।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের শর্তাবলী

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বিভিন্ন শর্তগুলি হল –

  • (১) এই ব্যবস্থায় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কৃষকেরা সরাসরি সরকারকেই রাজস্ব দিত—কোনও জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে নয়।
  • (২) জমি জরিপ করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় এবং উৎপাদনের ভিত্তিতে জমিকে ৯টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়।
  • (৩) এই ব্যবস্থায় জমির ওপর কৃষকের মালিকানা-স্বত্ব ছিল না—ছিল জমি ভোগ করার স্বত্ব।
  • (৪) রাজস্বের হার ছিল খুব উঁচু—উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ, এবং সাধারণত কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর অন্তর রাজস্বের হার পরিবর্তন করা হত।
  • (৫) সরকারকে নিয়মিত খাজনা দিয়ে গেলে রায়তকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেত না।
  • (৬) খরা, বন্যা বা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হলেও রায়ত তার খাজনা দিতে বাধ্য ছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও রায়তওয়ারি ব্যবস্থার পার্থক্য

এই ব্যবস্থার সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন –

  • (১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু অনুসারে জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীই ছিল জমির মালিক। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কোনও জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর স্থান ছিল না।
  • (২) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগী রায়তের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে সরকার বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে উদ্বৃত্ত নিজের হাতে রাখত। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় সরকারই ছিল জমিদার। সরকারি কর্মচারীরাই খাজনা আদায় করত।
  • (৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার ইচ্ছামতো খাজনার হার বৃদ্ধি করে প্রজাকে উৎখাত করতে পারত। রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় খাজনার হার বৃদ্ধি পেত কুড়ি-ত্রিশ বছর অন্তর।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের সুফল

এই রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বিভিন্ন সুফল ছিল। যেমন–

  • (১) সরকারের পক্ষে এই ব্যবস্থা সুবিধাজনক ছিল। সরকারের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা ও ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
  • (২) নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সরকারের পক্ষে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ ছিল।
  • (৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব হয়, কিন্তু রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর কোনও অস্তিত্ব ছিল না—বরং বলা যায় যে, এই ব্যবস্থার ফলে দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর বিলোপ ঘটে এবং সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে যায়।
  • (৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার যেমন ইচ্ছামতো প্রজাদের জমি থেকে উচ্ছেদের সুযোগ পেত, এখানে তা ছিল না।
  • (৫) এই ব্যবস্থার ফলে দক্ষিণ ভারতীয় সমাজে প্রচলিত ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটে। অধিকাংশ রায়ত ছিল ছোট জমির অধিকারী। ভূমিদাস রাখার মতো আর্থিক ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা নিজেরাই নিজেদের জমি চাষ করত বা প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে অস্থায়ী মজুর নিয়োগ করত। এর ফলে ধীরে ধীরে ভূমিদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের কুফল

এই ব্যবস্থার কুফলও কম ছিল না। যেমন –

  • (১) জমিদারি প্রথার নানা কুফল লক্ষ্য করেই রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। কিন্তু কালক্রমে কৃষকরা জমিদারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথ্য সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়।
  • (২) ডঃ তারাচাঁদ বলেন যে, এই ব্যবস্থায় প্রজারা বহু জমিদারের পরিবর্তে এক বিরাট জমিদার বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।
  • (৩) এই ব্যবস্থায় জমিতে কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় নি। সরকার প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে যে, ভূমিরাজস্ব হিসেবে সরকার যা আদায় করেন তা খাজনা (Tax) নয়—ভাড়া (Rent)। এর ফলে জমির ওপর প্রজার অধিকারের দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়।
  • (৪) এই ব্যবস্থায় রাজস্বের হার ছিল খুবই উঁচু। কারণ, সরকারের যুদ্ধজয় ও রাজ্যবিস্তার নীতির জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এলাকা থেকে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের কোনও উপায় ছিল না। তাই বাড়তি রাজস্বের বোঝা চাপানো হয় রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত-ভুক্ত এলাকায়।
  • (৫) সূচনা পর্বে ক্যাপ্টেন রীড রাজস্বের হার ধার্য করেন উৎপন্ন ফসলের ১/২ ভাগ। পরে মনরো তা করেন উৎপাদিত শস্যের ১/৩ ভাগ। এই রাজস্ব মিটিয়ে কৃষকের জীবনধারণের জন্য প্রায় কিছুই থাকত না। এর ফলে তাদের দুঃখ দুর্দশার কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না।
  • (৬) বন্যা, খরা বা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শস্যহানি ঘটলেও প্রজাকে তার দেয় রাজস্ব মেটাতেই হত। এ কারণে রাজস্ব মেটাবার উদ্দেশ্যে ঋণের জন্য মহাজনের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। দরিদ্র কৃষক মহাজনের হাতে তার জমি-জমা সব তুলে দিয়ে ভূমিদাসে পরিণত হয়।
  • (৭) জমিদারি ব্যবস্থায় রাজস্ব বাকি পড়লে প্রজাকে উচ্ছেদের জন্য জমিদারকে আদালতে যেতে হত।কিন্তু রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় সরকারি আমলারাই রায়তের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত।
  • (৮) এই ব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো স্থায়ীভাবে রাজস্ব ধার্য করা হয় নি। সরকার ইচ্ছে করলে কুড়ি বা ত্রিশ বছর অন্তর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারত। বাড়তি রাজস্ব না দিলে রায়তকে জমি থেকে উৎখাত করা হত। রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, জমির অস্থায়ী বন্দোবস্তই জনসাধারণের দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ।
  • (৯) কোম্পানি ফসলের পরিবর্তে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের নিয়ম চালু করলে রায়তের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত বলেছেন যে, “এই ব্যবস্থায় শোষণের তীব্রতা অনেক বেশি ছিল এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেয়ে তা অধিকতর ক্ষতিকর ছিল। জমির অস্থায়ী বন্দোবস্তই ছিল জনসাধারণের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ।”

(FAQ) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রায়তওয়ারী ব্যবস্থা কে চালু করেছিলেন?

টমাস মনরো।

২. রায়তওয়ারী ব্যবস্থা  কোথায় প্রচলিত হয়?

মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে।

৩. রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় কখন?

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment