প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা প্রসঙ্গে বাণিজ্যের অবনতি, জমি ও গ্ৰাম দান, মধ্যস্বত্ব, কৃষকদের উচ্ছেদ, বেগার শ্রম, সামন্ত কর, কর আদায় ও গ্ৰামগুলির বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে জানবো।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়২০০ গ্ৰাম
জমি দানভূমি পট্টলী
বেগার প্রথাবিস্তৃতি
ভরতপুর লিপিরাজা ভোজ
প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা

ভূমিকা :- ৭৫০-১০০০ খ্রিস্টাব্দে পাল-প্রতিহার-রাষ্ট্রকুট যুগে সামন্ত প্রথার দ্রুত প্রসার ঘটে। এই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় শক্তির পতন ও বৈদেশিক আক্রমণ সামন্তপ্রথার উদ্ভবে সহায়ক হয়ে ওঠে।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে বাণিজ্যের অবনতি

এই যুগে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় শক্তির পতন ও বৈদেশিক আক্রমণের জন্য ভারত -এর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে খুবই মন্দা দেখা দেয়। তাছাড়া বণিকদের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হলে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে কৃষির ওপর চাপ বাড়ে এবং শক্তিশালী লোকেরা সামন্ত শ্রেণীতে নিজেদের স্থান করে নেয়।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে জমি ও গ্ৰাম দান

  • (১) বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শৈব মন্দির ও সন্তদের সামন্ত শর্তে বহু জমি দান করা হয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় যথা, নালন্দার অধীনে প্রায় ২০০ গ্রাম ছিল। বিক্রমশীলা, সোমপুরী বিশ্ববিদ্যালয়েরও অধীনস্থ গ্রাম ছিল। এই গ্রামগুলিতে কৃষকরা ভূমিদাসে পরিণত হয়।
  • (২) প্রতিহার রাজারা ব্রাহ্মণদের যে সকল জমি অগ্রহার দান করেন সেই জমিগুলিতেও সামন্ত স্বত্বের উদ্ভব হয়। রাষ্ট্রকূট রাজারা মন্দির ও ব্রাহ্মণদের বহু গ্রাম দান করেন। একজন রাষ্ট্রকূট রাজা ১৪০০ গ্রাম, ৬০০ অগ্রহার, ৮০০ গ্রাম মন্দির ব্রাহ্মণকে দান করেন।
  • (৩) রাষ্ট্রকুট-পাল-প্রতিহার রাজারা তাদের কর্মচারী ও সেনাপতিদের বেতনের পরিবর্তে গ্রাম দান করতেন। এই কর্মচারীরা তাদের দান প্রাপ্ত জমি পুনরায় বন্দোবস্ত দিত।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে মধ্যস্বত্ব

এই যুগে সামন্তদের অধীনে অধি সামন্ত অর্থাৎ মধ্যবর্তী সামন্ত শ্রেণীর ব্যাপক প্রসার হয়। পাল রাজাদের একটি ভূমি পট্টলী থেকে দেখা যায় যে, জনৈক রাজকর্মচারী বিগ্রহপালের অনুমোদন ক্রমে তার দানপ্রাপ্ত জমি পুনরায় বন্দোবস্ত দেয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও এরূপ প্রথা চলত। প্রতিহার ভূমিপাট্টায় দেখা যায় যে, জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সঙ্গে চাষীকে উচ্ছেদ করার অধিকার মধ্যস্বতভোগী পেত।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে কৃষকদের উচ্ছেদ

মধ্যস্বত্ব প্রথার প্রসারের ফলে সামন্ত প্রভু বেশী অর্থের লোভে মধ্যস্বত্ব বা অধি সামন্ত পাল্টাতেন এবং এই সঙ্গে নতুন বন্দোবস্ত গ্রহীতা পুরাতন কৃষকদের উচ্ছেদ করে লাভজনক শর্তে নতুনভাবে কৃষকদের বন্দোবস্ত দিত। কৃষকদের জমির ওপর কোনো নিরাপদ স্বত্ব থাকত না। ক্রমে মধ্যস্বত্ব ভোগীর বিভিন্ন স্তর বাড়তে থাকে। ব্যাস স্মৃতিতে চার রকমের মধ্যস্বত্ব ভোগীর কথা বলা হয়েছে।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে বেগার প্রথা

  • (১) সামন্ত প্রভু যখন অধীনস্থ জমি অধি সামন্ত বা মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করতেন তাতে কৃষক চাষী কোনো আপত্তি করতে পারত না। জমিতে তার কোনো স্বত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় তার অবস্থা ছিল করুণ। ভূমিদাসের মতই তাকে বেগার দিতে হত নতুবা তাকে ইচ্ছামত জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেত।
  • (২) রাজা মিহির ভোজ -এর ভরতপুর লিপি থেকে একথা জানা যায়। পাল লিপি থেকে দেখা যায় যে, কৃষকদের ‘সর্বপীড়’ বা বাধ্যতামূলক বেগার খাটতে হত। প্রতিহাররা ‘ভিস্তি’ বা বেগার খাটাত। চাষের জমিতে বেগার খাটিয়ে জমি আবাদ করানোর প্রথা ব্যাপক ছিল।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে সামন্ত কর

কৃষককে নানাবিধ সামন্ত কর দিতে হত। যথা –

  • (১) পাল লিপিতে বিভিন্ন করের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে “ইত্যাদি” অর্থাৎ আরও কর ছিল।
  • (২) সামস্ত প্রত্যয় কর – সামন্ত প্রভুর সন্তোষের জন্যে দিতে হত।
  • (৩) প্রতিহার লিপিতে ‘সর্ব-আয়-সমেত’ কথাটি কৃষকের করের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
  • (৪) রাষ্ট্রকুটরা ৭/৮টি কর আদায় করত।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে কর আদায়

মধ্যস্বত্বভোগীকে কোনো নতুন কর আদায় করতে দেওয়া হত না। বে-আইনী বা বাড়তি কর আদায় করলে কৃষক কোনো প্রতিকার করতে পারত না। সমকালীন স্মৃতিশাস্ত্র বা শিলালিপিতে কৃষকের কোনো অধিকারের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়নি।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে বাণিজ্যের উপর সামন্ত প্রথার প্রভাব

শুধুমাত্র ভূমিই নয়, বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিও সামন্ত প্রথার কবলে পড়ে। ধর্মপাল -এর একটি লিপি থেকে দেখা যায় যে, তিনি গ্রামের বাজার সামন্ত শর্তে দান করেন। গ্রহীতা এই বাজারের বণিকদের ওপর সামন্ত প্রভুর স্বত্ব লাভ করে। প্রতিহার পেহোর লিপিতেও অনুরূপ ঘটনার কথা জানা যায়।

প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট যুগে গ্ৰামগুলির বিচ্ছিন্নতা

পাল-প্রতিহার যুগে সামন্ত প্রথার ফলে গ্রামগুলি বদ্ধ স্বয়ং-সম্পূর্ণ অর্থনীতির কবলে পড়ে। গ্রামের প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য গ্রামেই উৎপাদন হত। তার বেশী কিছু পাওয়ার আশা ছিল না। স্থানীয় ওজনের হার, স্থানীয় জমির মাপের প্রথা, স্থানীয় ভিত্তিতেই চলত। একই মুদ্রা সকল স্থানে চলত না।

উপসংহার :- পাল প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট যুগে সামন্ত প্রথার চারটি বৈশিষ্ট্য হল সরকারী বা সমষ্টিগত মালিকানার স্থলে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার, জমিতে কৃষকের স্বত্বলোপ ও কৃষককে নানা সামন্ত করের ভারে অবনত করা, বাণিজ্যের অর্থকে জমিদারী বা সামন্ত জমিতে লগ্নী করার প্রবণতা ও গ্রামের বদ্ধ অর্থনীতি।

(FAQ) প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট সামন্ত প্রথা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কতগুলি গ্ৰাম ছিল?

২০০ গ্ৰাম।

২. বেগার প্রথা কি নামে পরিচিত ছিল?

ভিস্তি।

৩. রাজা ভোজের লিপির নাম কি?

ভরতপুর লিপি।

৪. ‘সর্ব-আয়-সমেত’ কথাটি কোথায় পাওয়া যায়?

প্রতিহার লিপিতে।

Leave a Comment