প্রতিহার বংশ

প্রতিহার বংশ প্রসঙ্গে প্রথম নাগভট্ট, বৎসরাজ, দ্বিতীয় নাগভট্ট, রামভদ্র প্রতিহার, প্রথম ভোজ, ত্রিশক্তি দ্বন্দ্ব, মহেন্দ্রপাল, মহীপাল প্রতিহার, তুর্কী আক্রমণ ও প্রতিহার বংশের পতন সম্পর্কে জানবো।

গুর্জর প্রতিহার বংশ প্রসঙ্গে প্রতিহার বংশের প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিহার বংশের প্রথম রাজা, প্রতিহার বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা, প্রতিহার বংশের শেষ রাজা, প্রতিহার বংশের রাজা নাগভট্ট, প্রতিহার বংশের রাজা বৎসরাজ, প্রতিহার বংশের রাজা মহেন্দ্রপাল, ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে প্রতিহার বংশের অবদান, প্রতিহার বংশের পতন।

গুর্জর প্রতিহার বংশ

বিষয়প্রতিহার বংশ
প্রতিষ্ঠাতাহরিচন্দ্র
শ্রেষ্ঠ রাজামিহির ভোজ
শেষ রাজারাজ্যপাল
বিখ্যাত সংগ্রামত্রিশক্তি সংগ্রাম
প্রতিহার বংশ

ভূমিকা :- ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন -এর মৃত্যু হলে উত্তর ভারত -এ সর্বশেষ কেন্দ্রীয় শক্তির পতন ঘটে। হর্ষবর্ধনের পর যে আঞ্চলিক শক্তিগুলির উদ্ভব হয় তাদের মধ্যে বাংলার পাল শক্তি ও প্রতিহার শক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

প্রতিহার বংশ

হরিচন্দ্র ছিলেন প্রতিহার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি।

প্রতিহার বংশের রাজা প্রথম নাগভট্ট

এর পর প্রথম নাগভট্ট (৭২৫-৭৪০ খ্রি) সিন্ধুপ্রদেশ থেকে আগত আরব আক্রমণকারীদের পরাস্ত করে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি নন্দীকুনী ও যোধপুর অধিকার করেন। মানব, গুজরাট ও রাজপুতানার কিছু অংশ নিয়ে তার রাজ্য স্থাপিত হয়।

গুর্জর প্রতিহার বংশের রাজা বৎসরাজ

  • (১) এর পর বৎসরাজ (৭৭৫-৮০০ খ্রি:) প্রতিহার বংশের শক্তিশালী রাজা। বৎসরাজ তাঁর পৈত্রিক রাজ্য মালব, গুজরাট ও রাজপুতানার কিছু অংশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি গাঙ্গেয় উপত্যকার কনৌজ রাজ্য অধিকারের জন্য পাল সম্রাট ধর্মপালের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রত হন।
  • (২) তিনি ধর্মপালকে যুদ্ধে পরাস্ত করলেও দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুব তাকে পরাস্ত করে রাজপুতানার মরু অঞ্চলে বিতাড়ন করেন। বৎসরাজ আর তাঁর হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

প্রতিহার বংশের রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট

  • (১) বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট পিতার সিংহাসনে বসে সিন্ধু, বিদর্ভ, কলিঙ্গ ও অন্ধ্র অধিকার করেন বলে তার শিলালিপিতে দাবী করেছেন। কলিঙ্গ ও অন্ধ্র তার রাজ্যসীমা থেকে দূরে থাকায় এই অঞ্চল প্রকৃতই তিনি অধিকার করেন কিনা বলা যায় না।
  • (২) তবে নাগভট্টের রাজত্বকালের প্রধান ঘটনা ছিল পাল-প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট দ্বন্দ্ব। তাঁর পিতার নীতি নিয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকার উন্নত কৃষি ও বাণিজ্য অধিকারের জন্য নাগভট্ট কনৌজের চক্রায়ুধকে পরাস্ত করেন। তিনি মুঙ্গেরের যুদ্ধে ধর্মপালের বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন।
  • (৩) কিন্তু নাগভট তাঁর বিজয়কে স্থায়ী করার আগেই দক্ষিণ হতে রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দ তার দক্ষিণী বাহিনী নিয়ে নাগভট্টকে পরাস্ত করেন। বুন্দেলখণ্ডের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে নাগভট্ট পালিয়ে যান। রাষ্ট্রকুট সেনা প্রতিহার রাজ্য লুঠ করে দক্ষিণে ফিরে যায়।
  • (৪) নাগভট্ট এই যুদ্ধে পরাস্ত হলেও তিনি একটি প্রাদেশিক প্রতিহার শক্তিকে সর্বভারতীয় শক্তিতে পরিণত করেন। নাগভট্ট যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন তার উপরেই প্রথম ভোজের আমলে প্রতিহার শক্তি চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হয়।

প্রতিহার বংশের রাজা রামভদ্র প্রতিহার

দ্বিতীয় নাগভট্টের পর রামভদ্র প্রতিহার কিছুকাল প্রতিহার সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে প্রতিহার শক্তির বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি।

প্রতিহার বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম ভোজ

  • (১) রামভদ্রের পুত্র প্রথম ভোজ বা মিহির ভোজ (৮৩৬-৮৮৫ খ্রি) ছিলেন প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। তার আমলে প্রতিহার শক্তি চূড়ান্ত সীমায় ওঠে। ভোজরাজ সর্বপ্রথম প্রতিহার শক্তিকে দৃঢ় করার কাজে হাত দেন। বুন্দেলখণ্ড ও রাজপুতানায় প্রতিহার শক্তির যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল তিনি তা দূর করেন।
  • (২) বৎসরাজ ও নাগভট্ট যে সকল ভূমিপট্টলী দান করেন এবং মাঝে দ্বিতীয় নাগভট্টের পরে যা হাতছাড়া হয় তিনি তা পুনরায় দান করেন। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, তিনি তার পৈত্রিক রাজ্যের ওপর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর তিনি পূর্বদিকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজ্য বিস্তারের জন্য তাঁর পূর্বপুরুষদের মতই হাত বাড়ান।
  • (৩) তিনি কালাঞ্জর, দক্ষিণ রাজপুতানা অধিকার করে কনৌজে তার আধিপত্য স্থাপন করেন। পাল সম্রাট দেবপাল গুর্জর-প্রতিহার শক্তিকে বাধাদানের জন্য এগিয়ে আসেন। দেবপালের সাফল্যজনক বাধার সম্মুখীন হয়ে ভোজ পিছু হঠতে বাধ্য হন।
  • (৪) ভোজ প্রতিহার এর পর দক্ষিণে মুখ ঘুরিয়ে নর্মদা পার হয়ে দাক্ষিণাত্যে অভিযানের চেষ্টা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রকূট দ্বিতীয় ধ্রুবর হাতে তিনি ৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে পরাস্ত হন।

ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে প্রতিহার বংশের ভূমিকা

  • (১) এইসময় দেবপালের মৃত্যু হলে পাল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট শক্তি পূর্ব চালুক্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত থাকে। এই সুযোগে প্রথম ভোজ পূর্বদিকে মুখ ফিরিয়ে পুনরায় গাঙ্গেয় উপত্যকা ও কনৌজ জয় করার চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি গোরক্ষপুরের চেদি এবং গুহিলোৎ শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে আগ্রাসন চালান।
  • (২) তিনি পাল শক্তিকে বিধ্বস্ত করে কনৌজ অধিকার করেন। তিনি রাষ্ট্রকুট দ্বিতীয় কৃষ্ণকে পরাস্ত করেন এবং মালব ও গুজরাটের একাংশ জয় করেন। রাষ্ট্রকূট দ্বিতীয় কৃষ্ণ ভোজকে পুনরায় বাধা দিলে উজ্জয়িনীর যুদ্ধে ভোজ রাষ্ট্রকূট শক্তিকে প্রতিহত করেন। তিনি গুজরাট ও মালবে তার অধিকার বহাল রাখেন।

প্রতিহার বংশের রাজা মহেন্দ্রপাল

  • (১) রাজা ভোজের পর প্রতিহার মহেন্দ্রপাল (৮৮৫-৯১০ খ্রি:) প্রতিহার সিংহাসনে বসেন। মহেন্দ্রপাল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পাল শক্তিকে পরাস্ত করে মগধ ও উত্তর বাংলার কিছু অংশ অধিকার করেন। তবে পাঞ্জাবের কিছু অংশ তিনি কাশ্মীরের রাজাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পাঞ্জাবের কার্নাল জেলা পর্যন্ত তার অধিকার বজায় ছিল।
  • (২) তিনি পাল-প্রতিহার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে পাল শক্তিকে কোণঠাসা করে ফেলেন। কনৌজের ওপর প্রতিহার শক্তির অপ্রতিহত অধিকার স্থাপিত হয়। মহেন্দ্রপাল শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। বিখ্যাত সংস্কৃত সাহিত্যকার রাজশেখর, যিনি কাব্য মীমাংসা নামে কাব্য সমালোচনা গ্রন্থ ও কর্পূরমঞ্জরী নাটক রচনা করেন তিনি মহেন্দ্রপালের পৃষ্ঠপোষকতা পান।

প্রতিহার বংশের রাজা মহীপাল প্রতিহার

  • (১) মহেন্দ্রপালের পর দ্বিতীয় ভোজ ও তার পর মহীপাল প্রতিহার সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে পুনরায় প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় ইন্দ্ৰ মহীপাল প্রতিহারকে পরাস্ত করে প্রতিহার রাজধানী কনৌজ বিধ্বস্ত করেন।
  • (২) কাব্য স্বরলিপি থেকে জানা যায় যে, তৃতীয় ইন্দ্ৰ ‘মহোদয়’ বা কনৌজ নগরীকে ধ্বংস করেন এবং প্রয়াগ পর্যন্ত এগিয়ে যান। রাষ্ট্রকূট আক্রমণে প্রতিহার সাম্রাজ্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সৌরাষ্ট্র ও বেশ কিছু অঞ্চল প্রতিহার শক্তির হাতছাড়া হয়ে যায়।
  • (৩) পরবর্তী রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় কৃষ্ণ কালাঞ্জর, চিত্রকূট বা চিতোর অধিকার (৯৪০ খ্রি) করেন। আল-মাসুদি নামে আরব পর্যটক যখন সিন্ধুদেশে আসেন তখন প্রতিহার শক্তির বেশ পতনশীল অবস্থা চলছিল।

গুর্জর প্রতিহার শক্তির পতন

মহীপালের পর দেবপাল বিজয়পাল প্রমুখ সীমিত ক্ষমতা নিয়ে প্রতিহার সিংহাসনে বসেন। ইতিমধ্যে প্রতিহার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে থাকে। যমুনা ও নর্মদা অঞ্চলে চান্দেল্ল, দক্ষিণ রাজপুতানায় গুহিলোৎ, মালবে পারমার, গুজরাটে চালুক্য, গোয়ালিয়রে কচ্ছবাহ ও চহমান প্রভৃতি স্থানীয় শক্তি প্রতিহার সাম্রাজ্যের ওপর গড়ে ওঠে।

প্রতিহার বংশের শেষ লগ্নে তুর্কী আক্রমণ

দশম শতকে রাজ্যপাল প্রতিহার যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তখন রাজ্যপাল তুর্কী আক্রমণের বিরুদ্ধে বাধাদানের চেষ্টা করেন।

উপসংহার :- ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ কনৌজে রাজ্যপালের রাজধানী লুণ্ঠন করেন। এর পর চান্দেল্ল আক্রমণে রাজ্যপাল নিহত হলে প্রতিহার শক্তির চূড়ান্ত পতন ঘটে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “প্রতিহার বংশ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) প্রতিহার বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রতিহার বংশের প্রতিষ্ঠাতা কে?

হরিচন্দ্র।

২. প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা কে?

প্রথম ভোজ বা মিহির ভোজ।

৩. প্রতিহার বংশের শেষ রাজা কে?

রাজ্যপাল।

৪. সুলতান মামুদের আক্রমণের সময় প্রতিহার রাজা কে ছিলেন?

রাজ্যপাল।

অন্যান্য ঐতিহাসিক যুগগুলি

Leave a Comment