মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি (Nature of the Great Revolt)

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি (Nature of the Great Revolt), সিপাহি বিদ্রোহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি, সনাতনপন্থী বা সামন্ত বিদ্রোহ বলার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি এবং অন্যান্য মতামত।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি প্রসঙ্গে মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র আলোচনা, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ইংরেজদের অভিমত, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে সিপাহী বিদ্রোহ, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ।

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি (Nature of the Revolt of 1857)

ঐতিহাসিক ঘটনামহাবিদ্রোহের প্রকৃতি
সিপাহি বিদ্রোহজন লরেন্স, অক্ষয়কুমার দত্ত
জাতীয় বিদ্রোহডিসরেলী, কার্ল মার্কস
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধভি. ডি. সাভারকর
সামন্ত বিদ্রোহড. রমেশচন্দ্র মজুমদার
মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি

ভূমিকা :- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ -এর প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদের সীমা নেই। অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামরিক বিদ্রোহ। অনেকে আবার ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকের মতে এটি ছিল নিছক একটি সামন্ত বিদ্রোহ।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ইংরেজদের অভিমত

ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আউট্রাম একে ‘মুসলমানদের ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। বড়লাট ক্যানিং এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন ‘ব্রাহ্মণদের প্ররোচনা ও অন্যান্যদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি’। অনেকের মতে, এটি ছিল কৃষক বিদ্রোহ।

সিপাহি বিদ্রোহ

  • (১) স্যার জন লরেন্স, স্যার জন সিলি, চার্লস রেকস্, আর্ল রবার্টস প্রমুখ ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে এই বিদ্রোহ একটি সামরিক বিদ্রোহ ব্যতীতঅপর কিছু ছিল না।
  • (২) সমকালীন বিদগ্ধ ভারতীয়দের মধ্যে প্রায় সকলেই – অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কিশোরীচাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি, সৈয়দ আহমেদ খান, রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
  • (৩) কিশোরীচাঁদ মিত্র বলছেন, “এই বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের অভ্যুত্থান। এতে গণ আন্দোলনের কোনও উপাদান ছিল না।”
  • (৪) দেশীয় কোনও রাজনৈতিক সংগঠন এই বিদ্রোহ সমর্থন করে নি। শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহের নিন্দা করেছেন।
  • (৫) ভারত -এর ব্যাপক অঞ্চলে বিদ্রোহের কোনও প্রভাব পড়ে নি এবং দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গেও বিদ্রোহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। এই কারণে এই বিদ্রোহকে সিপাহি বিদ্রোহ বলা হয়।

সিপাহি বিদ্রোহ আখ্যা যুক্তিযুক্ত নয়

  • (১) কিন্তু এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করা যুক্তিসম্মত নয়।
  • (২) ইংল্যান্ড -এর পার্লামেন্টে আলোচনাকালে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে টোরি পার্টির নেতাডিসরেলী এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেন।
  • (৩) সমকালীন ইংরেজ ঐতিহাসিক নর্টন, জন কে, ডাফ, চার্লস বল, হোমস, আউট্রাম, ম্যালেসন এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
  • (৪) বিশিষ্ট মনীষী কার্ল মার্কস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলেছেন। তিনি বলছেন যে, ব্রিটিশ শাসকরা “যাকে সামরিক বিদ্রোহ বলে ভাবছে, আসলে সেটা একটা জাতীয় বিদ্রোহ।”
  • (৫) কার্ল মার্কস আবার অন্যত্র বলেছেন, “বর্তমান ভারতীয় অশান্তিটা সামরিক হাঙ্গামা নয়—জাতীয় বিদ্রোহ।” তাঁর মতে, সিপাহিরা জাতীয় বিদ্রোহের ‘ক্রিয়াশীল হাতিয়ার মাত্র’।
  • (৬)এই বিদ্রোহ কেবল সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।বরং এর একটি গণ-চরিত্র ছিল। ভারতের বিভিন্ন স্থানের জনসাধারণ, বিশেষত অযোধ্যা, বুন্দেলখণ্ড, রোহিলখণ্ড ও বিহারের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিদ্রোহে যোগদান করে।
  • (৭) বিভিন্ন ইংরেজ ঐতিহাসিকের মতে অযোধ্যায় ইংরেজ শাসন কার্যত অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী ভূ-ভাগে এমন কোনও মানুষ ছিল না যে ইংরেজ বিরোধী নয়।
  • (৮) ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব, কুনওয়ার সিং প্রমুখ রাজন্যবর্গ, বহু জমিদার ও তালুকদার এই বিদ্রোহে যোগ দেন।
  • (৯) বিদ্রোহীরা দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে ভারতে বিদেশি প্রভাবমুক্ত এক দেশীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগী হয়। সুতরাং এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ বলা অযৌক্তিক।

‘প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ’

বীর সাভারকর (V. D. Savarkar) প্রমুখ লেখক এই বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। বলা বাহুল্য, এই মত-ও গ্রহণযোগ্য নয়। এই মতের বিপক্ষে যুক্তি গুলি হল –

(ক) বিপক্ষে যুক্তি

  • (১) ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম- প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়।
  • (২) ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে এই বিদ্রোহে ভারতের সকল অঞ্চলের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করে নি। ভারতের কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ ছিল।
  • (৩) ভারতের বেশ কিছু নৃপতি বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেন। শিখ ও গুর্খা সৈনিকরা সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের পক্ষে ছিল। সমগ্র দাক্ষিণাত্য এবং বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিলেন।
  • (৪) পাঞ্জাব, সিন্ধুদেশ ও রাজপুতানায় এই বিদ্রোহের সামান্যতম কোনও স্ফূরণ দেখা যায় নি। বিদ্রোহীদের নৃশংসতা ও লুঠতরাজে সাধারণ জনসাধারণ তাদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।
  • (৫) বোম্বাই প্রেসিডেন্সির মহারাষ্ট্র অঞ্চলে বিদ্রোহের ক্ষীণ প্রকাশ দেখা যায় মাত্র। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের কোনও কোনও অঞ্চলে এই বিদ্রোহ সাময়িকভাবে সাফল্য লাভ করলেও, কেবল অযোধ্যাতেই তা ‘জাতীয়’ রূপ ধারণ করে।
  • (৬) বিদ্রোহ চলাকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দূরে থাকুক, অনেক স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং সম্রাট হিসেবে বাহাদুর শাহের স্বীকৃতিতে শিখ, রাজপুত ও মারাঠারা ক্ষুব্ধ হয়।
  • (৭) এই মহাবিদ্রোহে বিদ্রোহীদের লক্ষ্যেরও কোন স্থিরতা ছিল না। বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।
  • (৮) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় নি। এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দিলে এর পূর্ববর্তী ওয়াহাবি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ ও অন্যান্য বিদ্রোহগুলিও সেই একই গৌরব দাবি করতে পারে।
  • (৯) ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার (‘Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 ), ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন ( ‘Eighteen Fifty Seven ) ও ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী (Civil Rebellion in the Indian Mutinies, 1857-59) এই বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের মতামতের অবতারণা করেছেন।
  • (১০) তারা এই বিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলেন নি, তবে কোনও কোনও অঞ্চলে জনগণের সমর্থনে তা জাতীয় বিদ্রোহের স্তরে উন্নীত হয়।
  • (১১) ডঃ সেন বলেন যে, সামরিক বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও কোনও কোনও স্থানে তা জাতীয় বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। ডঃ মজুমদারের মতে বিভিন্ন এলাকায় এর প্রকৃতি ছিল বিভিন্ন ধরনের।
  • (১২) বিশিষ্ট মার্কসবাদী রাজনৈতিক নেতা ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত তাঁর সুবিশাল গ্রন্থে (A History of Indian Freedom Struggle’) বলেছেন যে, এই বিদ্রোহে যত সংখ্যক সৈন্য যোগদান করেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি সৈন্য বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করে এবং এ কারণেই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়।
  • (১৩) তার মতে ভারতীয় সেনাদের সাহায্য না পেলে, ব্রিটিশদের পক্ষে বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হত। তিনি বলছেন যে, “বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা ও জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা যখন ১৮৫৭-৫৯ সালের সংগ্রামকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেন, তখন বুঝতে হবে যে তাঁরা এই সত্যটার দিকে চোখ বুজেই আছেন।”

(খ) পক্ষে যুক্তি

বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ ও ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ বলেই অভিহিত করেছেন। তাদের যুক্তি গুলি হল –

  • (১) অধ্যাপক সুশোভন সরকার নানা যুক্তি সহকারে ও অতি সুদৃঢ়ভাবে ডঃ মজুমদার ও ডঃ সেনের বক্তব্য খণ্ডন করে বলেন যে, কোনও বিদ্রোহে সুপরিকল্পিতভাবে সকল শ্রেণীর মধ্যে অভ্যুত্থানের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
  • (২) তিনি বলেছেন যে, এটি খুবই পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা রাজপুতদের বীরত্ব, শিবাজির-অভ্যুত্থান বা আকবর -এর শাসননীতিতে জাতীয়তাবাদী ভাব দেখলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহে তার কোনও চিহ্ন দেখতে পান না।
  • (৩) তাঁর মতে, ১৮৫৭-র বিদ্রোহ জাতীয় সংগ্রাম না হলে ইতালিকার্বোনারি আন্দোলন, জোয়ান অব আর্কের নেতৃত্বে ফ্রান্স থেকে ইংরেজ বিতাড়নের যুদ্ধ বা নেপোলিয়ন -এর বিরুদ্ধে রাশিয়ার কৃষকদের যুদ্ধকেও জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে না।
  • (৪) পি. সি. যোশীতাঁর ‘1857 in Our History’ প্রবন্ধে অনুরূপ মতামত প্রকাশ করেছেন।

সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ

জওহরলাল নেহরু, রজনীপাম দত্ত, এম. এন. রায় এবং ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ এই বিদ্রোহকে সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হন।

(ক) পক্ষে যুক্তি

সনাতনপন্থী বা সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলার পক্ষে এই ঐতিহাসিকরা বেশ কিছু যুক্তি খাড়া করেছেন। যেমন –

  • (১) তাঁদের মতে, এই বিদ্রোহ হল ভারতীয় সনাতনপন্থীদের শেষ বিদ্রোহ। ডঃ মজুমদারের মতে, এই বিদ্রোহ ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র ও মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণীর ‘মৃত্যুকালীন আর্তনাদ”। তাঁর মতে, এই বিদ্রোহ স্পষ্টতই ছিল ‘প্রতিক্রিয়াশীল।
  • (২) ডঃ সেনের মতে,সিপাহি বিদ্রোহের নেতাদের লক্ষ্য ছিল ‘প্রতি-বিপ্লব’। তাঁদের মতে ইংরেজ শাসনের অধীনে দ্রুত পাশ্চাত্য সভ্যতার বিস্তারে দেশীয় জনসাধারণ ও সামন্ত প্রভুদের মনে এক ভীতির উদ্রেক হয়। প্রাচীনপন্থী এই সব সামন্ত প্রভুদের হাতেই ছিল বিদ্রোহের নেতৃত্ব।
  • (৩) সিপাহিরা জয়যুক্ত হলে সনাতনপন্থীরা নিশ্চয়ই পুরাতন ভারতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে ভারতে এক প্রতি-বিপ্লবের সূচনা করতেন। মনে হয়, এই কারণেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় সম্প্রদায় এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি।

(খ) বিপক্ষে যুক্তি

বলা বাহুল্য, এই মতও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। এই মতের বিপক্ষে যুক্তি গুলি হল –

  • (১) অধ্যাপক সুশোভন সরকার বলেন যে, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হজরত মহল, কুনওয়ার সিং প্রমুখ সামন্ত জমিদার ও তালুকদারদের হাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল বলে এই বিদ্রোহকে কখনোই সামন্ত বিদ্রোহ ও প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না।
  • (২) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তাঁরাই ছিলেন সমাজের ‘স্বাভাবিক নেতা’। এই কারণে এই অভ্যুত্থানও সামন্তপ্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল।
  • (৩) সুশোভন সরকারের মতে, অভ্যুত্থান জয়যুক্ত হলে তা রক্ষার জন্য সামন্ত-প্রভাব মুক্ত নতুন শক্তির, নতুন কৌশলের ও নতুন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটত।
  • (৪) তিনি বলেন যে, সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও বিদ্রোহে যোগ দেন নি এবং অযোধ্যার বাইরে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে।
  • (৫) বিদ্রোহে যোগদান করা দূরের কথা প্রকৃত সামন্ত নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহ বানচাল করতেই ব্যস্ত ছিলেন। সুতরাং এই বিদ্রোহকে কখনোই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যায় না।
  • (৬) পি. সি. যোশী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে রুশ-সামন্ত, পোল্যান্ড -এর ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে পোল-সামন্ত, ইতালির ঐক্য আন্দোলন -এ ম্যাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি, ক্যাভুর ও ভিক্টর ইম্যানুয়েলের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে সামন্তদের গৌরবজনক ভূমিকা থাকলে ভারত ইতিহাসেও তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
  • (৭) তাঁর মতে সামন্ত-নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও ১৮৫৭-র বিদ্রোহ ছিল প্রকৃতপক্ষেই জাতীয় সংগ্রাম।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে অন্যান্য মত

  • (১) এই বিদ্রোহকে নিছক সিপাহি বিদ্রোহ, সামন্ত বিদ্রোহ বা সনাতনপন্থীদের বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা ঠিক হবে না।
  • (২) কেবল ধর্মীয় কারণ বা এনফিল্ড রাইফেলের টোটার জন্যই এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয় নি। এই বিদ্রোহ হল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ।
  • (৩) বাহাদুর শাহ, নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ বিদ্রোহে প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে যোগ দিতে বাধ্য করে।
  • (৪) নানা ত্রুটি, নানা গোলযোগ, নানা বিদ্বেষ সত্ত্বেও এই বিদ্রোহের গণ-চরিত্রকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না বা একে স্বাধীনতা সংগ্রাম বললেও অত্যুক্তি হয় না।
  • (৫) ডঃ হরপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক রণজিৎ গুহ, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, ডঃ রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গবেষক এই বিদ্রোহে সাধারণমানুষের অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব দান ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
  • (৬) আসলে এই মহাবিদ্রোহ নানা জনের কাছে প্রতিভাত হয়েছে নানাভাবে। অধ্যাপক এরিখ স্টোকস বলেন যে, এই বিদ্রোহ এক সুরে বাঁধা ছিল না। এর মধ্যে ছিল নানা ধারা, উপধারা, যেমন কৃষকদের প্রতিরোধ, তেমনি জাতীয় প্রতিরোধ। নানা তরঙ্গ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে একত্রিত হয়েছিল।

উপসংহার :- কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক বেইলি (C. A. Bayly)-র মতে, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ নিছক একটি মাত্র আন্দোলন ছিল না, কেবল কৃষক বিদ্রোহ বা জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম নয়,এর নানা রূপ ছিল।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’বলে অভিহিত করেন কে?

ভি. ডি. সাভারকর।

২. ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে সামন্ত বিদ্রোহ বলেছেন কে?

ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।

৩. কোন ইংরেজ নেতা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেন?

টোরি দলের নেতা ডিসরেলী।

৪. কার্ল মার্কস ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে কি বলে অভিহিত করেছেন?

জাতীয় বিদ্রোহ।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পগুলি

Leave a Comment