নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ

সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ প্রসঙ্গে পরিচয়, চরিত্র ও নীতি, বলবনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রধানমন্ত্রী রূপে বলবনের শাসন ও বলবনের তিনটি কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ

সুলতাননাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ
রাজত্ব১২৪৬-১২৬৫ খ্রি
বংশদাস বংশ
প্রথম সুলতানকুতুবউদ্দিন আইবক
পূর্বসূরিআলাউদ্দিন মাসুদ শাহ
উত্তরসূরিগিয়াসউদ্দিন বলবন
সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ

ভূমিকা :- নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ চল্লিশের চক্রের নায়ক বলবনের সহায়তায় ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক আছে।

নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর পরিচয়

দীর্ঘকাল ধরে ঐতিহাসিকরা তাকে সুলতান ইলতুৎমিস-এর পুত্র বলে মনে করতেন। সম্প্রতি ডঃ কে. এ. নিজামী, ফেরিস্তা প্রমুখ ঐতিহাসিক মিনহাজ ও ইসামীর রচনার আলোকে প্রমাণ করেছেন যে, নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ ছিলেন ইলতুৎমিসের মৃত জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দিনের পুত্র, অর্থাৎ ইলতুৎমিসের পৌত্র। ইলতুৎমিস তার এই পৌত্রকে তার পিতার নামেই নামকরণ করেন এবং নিজ সন্তানের মত যত্নের সঙ্গে লালন-পালন করেন।

সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর চরিত্র ও নীতি

  • (১) পিতামহ ইলতুৎমিসের কোনো গুণ তাঁর চরিত্রে ছিল না। মিনহাজের রচনা থেকে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও নিরীহ প্রকৃতির লোক। কোরাণ নকল করে তিনি তার সময় কাটাতেন। রাজকার্যে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না।
  • (২) বলবন ও চল্লিশ ক্রীতদাসের সমিতিই রাষ্ট্রের কাজের দায়িত্ব বহন করত। নাসিরুদ্দিন অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। ডঃ নিজামীর মতে, “নাসিরুদ্দিন পরিপূর্ণভাবে তুর্কী দাস কর্মচারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন”।
  • (৩) তার পূর্ববর্তী সামসী সুলতানদের অবস্থা দেখে তিনি এই শিক্ষা নেন যে, চল্লিশের সমিতির বিরোধিতা করলেই প্রাণ সংশয় হবে। এজন্যই তিনি নিরাসক্ত ও নির্বিরোধী হয়ে থাকতেন। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা তার নায়েব গিয়াসুদ্দিন বলবনের হাতে চলে যায়।
  • (৪) ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে বলবন তাঁর কন্যাকে যুবক নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাঁর নিজ ক্ষমতাকে পাকা করে ফেলেন। বলবন নায়েব-ই-মামলিকাৎ উপাধি নেন।

বলবনের বিরুদ্ধে নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর বিদ্রোহ

  • (১) বলবনের এই একচ্ছত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে তুর্কী আমীরদের মধ্যে এক চাপা অসন্তোষ দেখা দিলে সেই সুযোগে রৈহন (Raihan) নামে এক হিন্দুস্থানী মুসলমান অভিজাত কর্মচারী সুলতান নাসিরুদ্দিনকে পরামর্শ দেন যে, তিনি যেন বলবনকে হান্সি প্রদেশে বদলি করে রাজধানী থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন।
  • (২) বলবন হান্সিতে বদলি হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। এদিকে হিন্দুস্থানী মুসলমান রৈহন দরবারে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে তুর্কী আমীররা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বলবনকে ফিরে আসতে অনুরোধ জানায়। বলবন সসৈন্যে রাজধানীর দিকে চলে এলে সুলতান নাসিরুদ্দিন মনোবল হারিয়ে পুনরায় বলবনের বশ্যতা স্বীকার করেন।
  • (৩) হিন্দুস্থানী মুসলিমদের ক্ষমতা লাভের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১২৫৪-১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বলবন একাদিক্রমে নায়ের-ই-মামলিকাৎ পদে থেকে রাজ্য শাসন করেন। সুলতান নাসিরুদ্দিন এই সময় তাঁর একান্ত বশম্বদ হতে বাধ্য হন।

নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর আমলে প্রধানমন্ত্রী রূপে বলবনের শাসন

  • (১) ১২৫৪ থেকে ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নায়েব-ই-মামলিকাৎ পদে বসে বলবন সুলতানি সাম্রাজ্য-এর ঐক্যরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলার শাসনকর্তা তুঘ্রিল খান স্বাধীন সুলতানের মত আচরণ করলে বলবন তাকে বিতাড়িত করেন।
  • (২) তারপর বাংলায় কিছুকাল উজবেগ খান রাজত্ব করেন। তারপর আরসলান খান বাংলার শাসনভার নিয়ে স্বাধীন নবাবের মতই রাজত্ব করতে থাকেন। বলবন নিজে সুলতান পদ গ্রহণ করার আগে বাংলায় দিল্লীর অধিকার আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় নি।
  • (৩) সুলতান নাসিরুদ্দিনের শাসনকালে মোঙ্গলরা পশ্চিম পাঞ্জাব দখল করে। বলবন বহু চেষ্টায় মোঙ্গোল নেতা হলাগুর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। এই সন্ধির দ্বারা মোঙ্গলদের কাছ থেকে উত্তর-পশ্চিমের নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়া যায়।
  • (৪) খোক্কর ও মেওয়াটীদের দ্বারা উপদ্রব ও অরাজকতা চলতে থাকে। বলবন কালিঞ্জর দুর্গ অধিকার করে চান্দেল্ল রাজপুতদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। বলবন গোয়ালিয়র ও রণথস্তোর জয়ে বিফল হন। বলবন দোয়াবের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেন। ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের মৃত্যু হলে বলবন সুলতান রূপে সিংহাসনে বসেন।

নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহর আমলে বলবনের তিনটি কৃতিত্ব

সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের মন্ত্রী হিসেবে বলবন তিনটি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। যথা – 

  • (১) বিদ্রোহী তুর্কী সেনাপতিদের দমন করে দিল্লী সুলতানির ঐক্য রক্ষা,
  • (২) বিদ্রোহী হিন্দু রাজাদের বশ্যতা জ্ঞাপনে বাধ্য করা,
  • (৩) মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা। এই তিন প্রচেষ্টার দ্বারা বলবন সুলতানিকে ভেঙে পড়তে দেননি। কাজেই সুলতানি সিংহাসনে বসার দাবী তিনি নিজ যোগ্যতার জোরেই অর্জন করেন।

উপসংহার :- সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ প্রায় ২০ বছর রাজত্ব করলেও রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা ছিল চল্লিশ চক্রের নায়ক গিয়াসউদ্দিন বলবনের হাতে। পরবর্তীতে বলবনই দিল্লী সুলতানির সিংহাসনে আরোহণ করেন।

(FAQ) সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ কে ছিলেন?

সুলতান ইলতুৎমিসের পৌত্র।

২. নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ কতদিন রাজত্ব করেন?

১২৪৬-১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

৩. নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

৪. নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের পর কে দিল্লী সুলতানির সিংহাসনে আরোহণ করেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

Leave a Comment