নেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব

ফ্রান্সে নেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব প্রসঙ্গে সমকালীন পরিস্থিতি হিসেবে অষ্টাদশ লুইয়ের গ্ৰহণযোগ্যতা, অভিজাতদের প্রত্যাবর্তন, অষ্টাদশ লুইয়ের শান্তিবাদী নীতি, বিজয়ী শক্তিবর্গের বিতণ্ডা, নেপোলিয়নের ফ্রান্স অভিযান, কৃষক ও সাধারণ মানুষের অভ্যর্থনা, গ্ৰিনোবল নগরে প্রবেশ, নেপোলিয়নের ঘোষণা, সিংহাসন লাভ, একশত দিবসের রাজত্ব, মিত্রপক্ষের পরিকল্পনা, ওয়াটার্লুর যুদ্ধ, নেপোলিয়নের নির্বাসন, মৃত্যু, প্যারিসের দ্বিতীয় সন্ধি ও তার শর্ত সম্পর্কে জানবো।

নেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনানেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব
সময়কাল২০ শে মার্চ – ২৯ শে জুন, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ
ফরাসি সম্রাটনেপোলিয়ন
ওয়াটার্লু যুদ্ধ১৮ জুন, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ
সেন্ট হেলেনা দ্বীপনেপোলিয়নের নির্বাসন ও মৃত্যু
নেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব

ভূমিকা:- এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে নেপোলিয়ন হতাশায় ভেঙে পড়েন নি। সেখান থেকেও তিনি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতেন। এই কারণে সুদূর এলবাতে বসেও তিনি ফ্রান্স ও ইউরোপ-এর ঘটনাবলীর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন।

সমকালীন পরিস্থিতি

তৎকালীন ফ্রান্স -এর পরিস্থিতি নেপোলিয়নের কাছে আশার সঞ্চার করেছিল।যেমন –

(১) অষ্টাদশ লুইয়ের গ্ৰহণযোগ্যতা

নেপোলিয়নের পতনের পর বুরবো-বংশীয় অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। তিনি ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না।

(২) অভিজাত শ্রেণীর প্রত্যাবর্তন

বুরবোঁ শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দেশত্যাগী অভিজাতরা দেশে ফিরে আসে এবং তাদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য দেশে প্রবল বিতণ্ডা শুরু করে। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিষয়টি সুনজরে দেখে নি।

(৩) অষ্টাদশ লুইয়ের শান্তিবাদী নীতি

সেনাবাহিনী অষ্টাদশ লুইয়ের শান্তিবাদী নীতি পছন্দ করছিল না। নব-প্রতিষ্ঠিত বুরবোঁ শাসনে কৃষকরা সামন্তপ্রভু ও গির্জার শোষণের সম্ভাবনা দেখছিল। অষ্টাদশ লুই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও জনগণ তা বিশ্বাস করে নি।

(৪) বিজয়ী শক্তিবর্গের বিতণ্ডা

নেপোলিয়নের নির্বাসনের পর বিজয়ী শক্তিবর্গ ভিয়েনা নগরীতে এক সম্মেলনে মিলিত হন। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপে প্রাক্-বিপ্লব পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা। ইতালি, পোল্যান্ড ও রাইন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে প্রবল বিতণ্ডা শুরু হয়। ফ্রান্স ও ফ্রান্সের বাইরে এই পরিস্থিতি নেপোলিয়নকে উৎসাহিত করে।

নেপোলিয়নের ফ্রান্স অভিযান

পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা মার্চ ১০৫০ জন সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের কানে শহরে উপস্থিত হন।

কৃষক ও সাধারণ মানুষের নেপোলিয়নকে অভ্যর্থনা

এরপর তিনি রাজধানী প্যারিস অভিমুখে যাত্রা করলে কৃষক ও সাধারণ মানুষ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানায়।

গ্ৰিনোবল নগরে নেপোলিয়নের প্রবেশ

তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরিত সেনাবাহিনীও তাঁর পক্ষে যোগদান করে। ফলে বিনাবাধায় নেপোলিয়ন গ্ৰিনোবল নগরে প্রবেশ করেন।

নেপোলিয়নের ঘোষণা

তিনি ঘোষণা করেন যে, তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্য হল দেশত্যাগী অভিজাতদের হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করা, কৃষকদের মালিকানা-স্বত্ব নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি স্থাপন ও বিদেশি শত্রুর হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করা।

নেপোলিয়নের সিংহাসন লাভ

এরপর তিনি লিয়ঁ নগরীতে প্রবেশ করে নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। অষ্টাদশ লুই ইংল্যান্ড-এ পলায়ন করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ তিনি প্যারিসে প্রবেশ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

নেপোলিয়নের একশত দিবসের রাজত্ব

এই সময় তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত মোট একশো দিন ক্ষমতায় ছিলেন। এই ঘটনা একশত দিবসের রাজত্ব (Reign of Hundred Days’) নামে পরিচিত। নেপোলিয়নের এই সাফল্যের কারণ হিসেবে ফরাসি সেনাবাহিনী ও জনগণের সমর্থনের কথা বলা যায়।

নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে মিত্রপক্ষের পরিকল্পনা

নেপোলিয়নের আগমন সংবাদ পাওয়া মাত্র মিত্রপক্ষের প্রতিনিধিরা নিজেদের বিবাদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁকে বাধা দিতে অগ্রসর হয়। তাঁকে ‘আইন-বহির্ভূত ব্যক্তি’ বলে ঘোষণা করা হয় এবং মিত্রপক্ষ তিনদিক থেকে ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনা করে। যথা –

  • (১) ডিউক অফ ওয়েলিংটনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী ও ব্লুকারের নেতৃত্বে প্রাশিয়ার বাহিনী উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করে।
  • (২) জার প্রথম আলেকজান্ডার -এর নেতৃত্বাধীন রাশিয়া -র বাহিনী পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করে।
  • (৩) শোয়ারজেনবার্গ-এর নেতৃত্বে অস্ট্রিয়ার বাহিনী পশ্চিম দিক থেকে ফ্রান্সের উপর আক্রমণ চালানো শুরু করে।

ওয়াটার্লুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরিণতি

নেপোলিয়ন লিঞ্জি ও কোয়াটার ব্রাস-এর যুদ্ধে জয়যুক্ত হলেও ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুন ব্রিটিশ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন ও প্রাশিয় সেনাপতি ব্লুকার-এর হাতে ওয়াটার্লুর যুদ্ধে (Battle of Waterloo) পরাজিত হন। এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের প্রায় ৩৭ হাজার, ব্রিটেনের ১৩ হাজার এবং প্রাশিয়ার ৬ হাজার সেনা নিহত হয়।

নেপোলিয়নের নির্বাসন

তিনি ১৫ই জুলাই ব্রিটিশ নৌশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁকে ফ্রান্স থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে মধ্য আটলান্টিকের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়।

নেপোলিয়নের মৃত্যু

১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে মাত্র ৫২ বছর বয়সে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন জীবনে থাকাকালীন নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়।

প্যারিসের দ্বিতীয় সন্ধি

নেপোলিয়নের পতন -এর পর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে প্যারিসের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

সন্ধির শর্ত

প্যারিসের দ্বিতীয় সন্ধি দ্বারা স্থির হয় যে,

  • (১) ফ্রান্সকে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের সীমানায় ফিরে যেতে হবে।
  • (২) তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য মিত্রপক্ষের একদল সেনা ফ্রান্সে মোতায়েন থাকবে।
  • (৩) ফ্রান্সকে ৭০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

উপসংহার:- পরাজিত ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর তিনটি চুক্তি হয়। প্যারিসের প্রথম সন্ধি, ভিয়েনা চুক্তি এবং প্যারিসের দ্বিতীয় সন্ধি।

(FAQ) নেপোলিয়নের একশ দিনের রাজত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. একশো দিনের রাজত্ব কী?

নির্বাসন জীবন থেকে ফিরে এসে নেপোলিয়ন ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ২০শে মার্চ থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত মোট একশো দিন ক্ষমতায় ছিলেন। এই ঘটনা একশত দিবসের রাজত্ব নামে পরিচিত।

২. নেপোলিয়নকে প্রথমে কোথায় নির্বাসন দেওয়া হয়?

এলবা দ্বীপে।

৩. ওয়াটার্লুর যুদ্ধ কবে হয়?

১৮ জুন, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ।

৪. কোথায় কখন নেপোলিয়নের মৃত্যু হয়?

৫ মে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ।

Leave a Comment