নালন্দা

আজ আমরা নালন্দা -র অবস্থান, নামকরণ, নালন্দার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তি, নালন্দা মহাবিহার, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত শহর নালন্দার অবস্থান, বিকাশ, ইতিহাস, গুপ্ত যুগের বৌদ্ধ মহাবিহার প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তাঁর ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জানুন।

বৌদ্ধ মহাবিহার নালন্দা

অবস্থাননালন্দা জেলা, বিহার, ভারত
ধরনবৌদ্ধ মহাবিহার
এলাকা১২ হেক্টর (৩০ একর)
প্রতিষ্ঠিতখ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী
প্রখ্যাত শিক্ষকশীলভদ্র
নালন্দা

ভূমিকা :- নালন্দা ছিল প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে (অধুনা ভারতের বিহার রাজ্য) অবস্থিত একটি খ্যাতনামা মহাবিহার।

নালন্দার অবস্থান

বিহারের রাজধানী পাটনা শহরের ৯৫ কিলোমিটার (৫৯ মাইল) দক্ষিণপূর্বে এবং বিহার শরিফ শহরের কাছে নালন্দা অবস্থিত।

নালন্দা সম্পর্কে জানতে উৎস

বর্তমান কালে নালন্দা মহাবিহার সম্পর্কে জানা যায় মূলত হিউয়েন সাং ও ইৎ সিং প্রমুখ পূর্ব এশীয় তীর্থযাত্রীদের ভ্রমণ-বিবরণী থেকে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নালন্দা

খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ঐতিহ্যবাহী স্থান নালন্দা

বর্তমানে নালন্দা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত।

প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাচীন ভারতে বৈদিক শিক্ষার উৎকর্ষ তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা প্রভৃতি বৃহদায়তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইতিহাসবিদগণ ভারতের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন।

নালন্দার বিকাশ

মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণের এবং পরবর্তীকালে কনৌজ -এর সম্রাট হর্ষবর্ধন -এর পৃষ্ঠপোষকতায়।

নালন্দায় বিদেশী পণ্ডিত ও ছাত্র

খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন নালন্দায় ভারত ছাড়াও তিব্বত, চীন, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত ও ছাত্ররা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতেন।

নালন্দার পৃষ্ঠপোষক শৈলেন্দ্র রাজবংশ

পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে, ইন্দোনেশিয়ার শৈলেন্দ্র রাজবংশও এই মহাবিহারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিল।

স্মিথের বক্তব্য

ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ মনে করেন যে, নালন্দার ইতিহাস হল মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই ইতিহাস। হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ-বিবরণীতে নালন্দার অবদান হিসেবে যে সকল পণ্ডিতের নাম করেছেন, তাঁদের অনেকেই মহাযান দর্শনের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

নালন্দায় সকল ছাত্রই মহাযান এবং বৌদ্ধধর্ম -এর আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতেন। সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, ভেষজবিদ্যা ও সাংখ্য দর্শনও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

নালন্দার ধ্বংসসাধন

আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে মুসলমান মামলুক বাহিনী সম্ভবত নালন্দা লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। এটি পরিত্যক্ত হয় এবং বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়।

নালন্দায় খননকার্য

উনিশ শতাব্দীতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ প্রাথমিকভাবে এই প্রত্নস্থলে খননকার্য চালায়।

  • (১) ১৯১৫ সালে প্রথম এখানে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু হয় এবং ১২ হেক্টর জমিতে সুবিন্যস্ত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি মন্দির আবিষ্কৃত হয়।
  • (২) ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে প্রচুর ভাস্কর্য, মুদ্রা, সিলমোহর ও উৎকীর্ণ লিপিও আবিষ্কৃত হয়। এগুলির কয়েকটি নিকটবর্তী নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে রক্ষিত আছে।

আধুনিক নালন্দা

বর্তমানে নালন্দা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ তীর্থপর্যটন পথের অন্যতম গন্তব্যস্থল।

নালন্দার নাম-ব্যুৎপত্তি

‘নালন্দা’ নামটির ব্যুৎপত্তি সংক্রান্ত একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে।

  • (১) চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং-এর মতে, এই নামটি এসেছে “ন অলম দা” কথাটি থেকে। এই কথাটির অর্থ “উপহার দানে যার বিরাম নেই” বা “অবিরত দান”।
  • (২) চীনা পর্যটক ইৎ সিং অবশ্য বলেছেন যে, ‘নালন্দা’ নামটি ‘নাগ নন্দ’ নামে এক সাপের নাম থেকে এসেছে। উক্ত সাপটি স্থানীয় এক পুষ্করিণীতে বাস করত।
  • (৩) নালন্দায় খননকার্য পরিচালনাকারী হীরানন্দ শাস্ত্রী বলেছেন যে, এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ‘নাল’ (পদ্মের মৃণাল) পাওয়া যেত। তাই ‘নালন্দা’ নামটির আদি অর্থ ছিল ‘যা নাল অর্থাৎ পদ্মের মৃণাল প্রদান করে’।

নালন্দার প্রাচীন ইতিহাস

প্রাচীনকালে নালন্দা ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। মগধের রাজধানী রাজগৃহ (অধুনা রাজগির) হয়ে যে বাণিজ্যপথটি চলে গিয়েছিল, নালন্দা সেই পথের ধারেই অবস্থিত ছিল।

মহাবীর ও নালন্দা

কথিত আছে, জৈন ধর্ম -এর তীর্থঙ্কর মহাবীর ১৪টি চতুর্মাস নালন্দায় অতিবাহিত করেছিলেন।

গৌতম বুদ্ধ ও নালন্দা

গৌতম বুদ্ধ নালন্দার নিকটবর্তী পাবরিক নামক আম্রবনে উপদেশ দান করেছিলেন বলেও জানা যায়।

সারিপুত্ত ও নালন্দা

বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্যের অন্যতম সারিপুত্ত নালন্দা অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই নির্বাণ লাভ করেন।

লামা তারানাথের বক্তব্য

  • (১) সপ্তদশ শতাব্দীতে তিব্বতি লামা তারানাথ লিখেছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় সারিপুত্তের চৈত্যের স্থানে একটি বৃহৎ মন্দির নির্মাণ করান।
  • (২) তিনি লিখেছেন যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে মহাযান দার্শনিক নাগার্জুন ও তাঁর শিষ্য আর্যদেব ছিলেন নালন্দার ব্যক্তিত্ব। নাগার্জুন নালন্দার অধ্যক্ষও হয়েছিলেন।
  • (৩) তারানাথের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীর আগেও নালন্দা ছিল বৌদ্ধধর্ম চর্চার একটি উদীয়মান কেন্দ্র। কিন্তু এই ধরনের তথ্যের সপক্ষে কোনও পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

ফাহিয়েনের নালন্দা ভ্রমণ

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন ভারতে এসে সারিপুত্তের পরিনির্বাণ স্থল ‘নালো’ পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি সেখানকার উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হিসেবে একটি মাত্র স্তুপেরই নাম করেন।

গুপ্তযুগে নালন্দা

নালন্দা মহাবিহারের নথিবদ্ধ ইতিহাসের সূচনা ঘটেছে গুপ্তযুগে।

  • (১) একটি সিলমোহর থেকে জানা যায় যে, এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শক্রাদিত্য নামে এক রাজা। শক্রাদিত্য হলেন গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্ত (রাজত্বকাল আনুমানিক ৪১৫-৪৫৫)। নালন্দায় তাঁর মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • (২) শক্রাদিত্য বা প্রথম কুমারগুপ্তের উত্তরসূরি বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য ও বজ্র পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি মঠ ও মন্দির নির্মাণ করিয়ে নালন্দা মহাবিহারকে প্রসারিত ও পরিবর্ধিত করেন।
  • (৩) হিউয়েন সাং ও অপর এক কোরীয় তীর্থযাত্রী উল্লেখ করেছেন যে, পর্যন্যবর্মণ এই স্থানে একটি সঙ্ঘারাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  
  • (৪) নরসিংহগুপ্ত (বালাদিত্য) মহাযান দার্শনিক বসুবন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি নালন্দায় একটি সঙ্ঘারাম এবং ৩০০ ফুট উঁচু একটি বিহার নির্মাণ করান। এই বিহারে বুদ্ধের একটি মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
  • (৫) হিউয়েন সাং-এর মতে, এই বিহারটি ছিল “বোধিবৃক্ষের তলায় নির্মিত মহাবিহারটির” অনুরূপ। তিনি আরও লিখেছেন যে, বালাদিত্যের পুত্র বজ্রও “ভক্তিসমাহিত চিত্তে” একটি সঙ্ঘারাম নির্মাণ করান।

গুপ্তোত্তর যুগে নালন্দা

গুপ্তোত্তর যুগে দীর্ঘকাল যাবৎ বহু রাজা “ভাস্করদের দক্ষতাকে ব্যবহার করে” নালন্দায় নতুন নতুন বিহার, মঠ ও মন্দির নির্মাণ করিয়ে যান।

নালন্দায় একদ্বারবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণ

কোনও এক সময়ে “মধ্য ভারতের এক রাজা” নালন্দা মহাবিহার চত্বরের অট্টালিকাগুলিকে পরিবেষ্টন করে একদ্বারবিশিষ্ট উচ্চ একটি প্রাচীর নির্মাণ করান।

রাজা পূর্ণবর্মণ ও নালন্দা

পূর্ণবর্মণ নামে আরেক জন রাজা (ইনি সম্ভবত মৌখরী রাজবংশ -এর রাজা, যাঁকে “অশোক-রাজার বংশের শেষ বংশধর বলা হয়) ৮০ ফুট উঁচু তামার একটি বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করান। তিনি সেই মূর্তির জন্য ছয়টি ধাপবিশিষ্ট একটি বেদিও নির্মাণ করিয়েছিলেন।

হর্ষবর্ধন ও নালন্দা

গুপ্ত সাম্রাজ্য -এর পতনের পর নালন্দা মহাবিহারের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কনৌজ -এর সম্রাট হর্ষবর্ধন

  • (১) হর্ষবর্ধন বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং নিজেকে নালন্দার ভিক্ষুদের দাস মনে করতেন।
  • (২) তিনি মহাবিহারের মধ্যে পিতলের একটি মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং ১০০টি গ্রাম থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব নালন্দার জন্য মঞ্জুর করেছিলেন।
  • (৩) হর্ষবর্ধন উপরিউক্ত গ্রামগুলির ২০০ জন গৃহস্থকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা যেন মহাবিহারের ভিক্ষুদের চাহিদা অনুসারে রোজ চাল, মাখন ও দুধ সরবরাহ করেন।
  • (৪) নালন্দার প্রায় এক হাজার ভিক্ষু কনৌজে হর্ষবর্ধনের রাজকীয় উপাসনা সভায় উপস্থিত থাকতেন।

নালন্দায় হিউয়েন সাং

চীনা তীর্থযাত্রী ভিক্ষু হিউয়েন সাং ভারত পর্যটন করেন ৬৩০ থেকে ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে।

  • (১) ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথমবার নালন্দায় এসেছিলেন। এরপর ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার নালন্দায় আসেন।
  • (২) নালন্দার মঠে তিনি প্রায় দুই বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন। নালন্দায় তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।
  • (৩) নালন্দায় তাঁর ভারতীয় নামকরণ করা হয়েছিল ‘মোক্ষদেব’। নালন্দার তদনীন্তন অধ্যক্ষ শীলভদ্রের অধীনে তিনি সেখানে অধ্যয়ন করেন। সেই যুগে যোগাচার মতটি অংশত চীনে প্রচারিত হয়েছিল।
  • (৪) হিউয়েন সাং মনে করতেন যে, শীলভদ্র যোগাচার বিষয়ে এক অতুলনীয় শিক্ষক এবং তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করতে পেরে তাঁর বিদেশযাত্রার শ্রম সার্থক হয়েছে।
  • (৫) বৌদ্ধশাস্ত্র ছাড়াও হিউয়েন সাং নালন্দায় ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই মহাবিহারে শিক্ষাদানও করেন।
  • (৬)নালন্দায় অবস্থানকালে হিউয়েন সাং তাঁর বাসকক্ষের জানলার বাইরের দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,

“সম্পূর্ণ মহাবিহারটি ইষ্টকনির্মিত একটি প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই প্রাচীরটি সমগ্র মহাবিহারটিকে বাইরে থেকে ঘিরে রেখেছে। একটি দ্বার দিয়ে এই মহৎ মহাবিহারে প্রবেশ করতে হয়। মাঝে অন্যান্য আটটি সভাগৃহ সেই মহাবিহার থেকে পৃথক অবস্থায় আছে। সুসজ্জিত স্তম্ভ ও পরি-সদৃশ্য স্তম্ভশীর্ষগুলি একত্রে সূচালো পর্বতশীর্ষের ন্যায় সন্নিবেশিত। মনে হয় যেন, মানমন্দিরগুলি কুয়াশায় এবং স্তম্ভশীর্ষের কক্ষগুলি মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে।

  • (৭) চীনে প্রত্যাবর্তনকালে হিউয়েন সাং ২০টি অশ্বপৃষ্ঠে ৫২০টি পেটিকায় করে ৬৫৭টি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ (যার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল মহাযান ধর্মগ্রন্থ) ও ১৫০টি সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যান।
  • (৮) তিনি নিজে ৭৪টি গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর চীনে প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী ৩০ বছরে অন্তত এগারো জন চীনা ও কোরীয় পর্যটক নালন্দায় এসেছিলেন

হয়ুই লির বক্তব্য

হিউয়েন সাং-এর জীবনীকার হয়ুই-লি লিখেছেন যে,

  • (১) নালন্দায় মহাযান দর্শনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হত বলে কয়েকজন স্থবির এই মহাবিহারটিকে পছন্দ করতেন না।
  • (২) কথিত আছে যে, রাজা হর্ষবর্ধন ওড়িশা পরিদর্শনে গেলে তাঁরা নালন্দাকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্য রাজার নিন্দা করেন।
  • (৩) নালন্দায় যে ‘আকাশকুসুম’ দর্শনের শিক্ষা দেওয়া হয় তার উপহাস করেন এবং বলেন যে, হর্ষবর্ধনের উচিত একটি কাপালিক মন্দিরেরও পৃষ্ঠপোষকতা করা।
  • (৪) হর্ষবর্ধন এই কথা নালন্দার অধ্যক্ষকে জানালে তিনি সাগরমতি, প্রজ্ঞারশ্মি, সিংহরশ্মি ও হিউয়েন সাং-কে ওড়িশার ভিক্ষুদের মত খণ্ডন করার জন্য প্রেরণ করেন।

নালন্দায় ইৎ সিং

ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণবিবরণী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তীর্থযাত্রী ইৎ সিং শ্রীবিজয়ে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন এবং ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন।

  • (১) ইৎ সিং ভারতে চোদ্দো বছর অতিবাহিত করেছিলেন। এর মধ্যে দশ বছর তিনি কাটিয়েছিলেন নালন্দা মহাবিহারে।
  • (২) ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন চীনে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন সঙ্গে করে ৪০০টি সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে যান। তারপরেই সেগুলি অনূদিত হয়।
  • (৩) ইৎ সিং তাঁর বিবরণ নিবদ্ধ রেখেছিলেন মূলত বৌদ্ধধর্মের উৎসভূমি ভারতে সেই ধর্মের চর্চা ও মঠের ভিক্ষুদের প্রথা, রীতিনীতি ও নিয়ম-নির্দেশিকার বর্ণনার মধ্যেই।
  • (৪) ইৎ সিং লিখেছেন যে, ২০০টি গ্রামের (হিউয়েন সাং-এর সময় এই গ্রামের সংখ্যা ছিল ১০০টি) রাজস্বের আয় থেকে নালন্দার রক্ষণাবেক্ষণ চলত।
  • (৫) তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, নালন্দা মহাবিহারে আটটি সভাগৃহ ও প্রায় ৩০০টি কক্ষ ছিল।

ইৎ সিং-এর বর্ণনায় নালন্দার দৈনন্দিন জীবন

ইৎ সিং লিখেছেন যে, নালন্দার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিল সকলের দ্বারা আচরিত একাধিক অনুষ্ঠান।

  • (১) প্রতিদিন সকালে একটি ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে স্নানের সময় নির্দেশ করা হত। এই ঘণ্টাধ্বনি শুনে শতাধিক বা সহস্রাধিক ভিক্ষু নিজ নিজ বিহার থেকে বেরিয়ে চত্বরের মধ্যস্থ বা পার্শ্বস্থ একাধিক বিশালাকায় জলাধারে উপস্থিত হতেন এবং স্নান করতেন।
  • (২) এরপর আরেকটি ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে বুদ্ধপূজার সময় নির্দেশ করা হত। সন্ধ্যায় ‘চৈত্যবন্দনা’ অনুষ্ঠিত হত। চৈত্যবন্দনার অঙ্গ ছিল ‘তিন পর্বের সেবা’, নির্দিষ্ট স্তোত্র, শ্লোক ও ধর্মগ্রন্থের নির্বাচিত অংশ পাঠ। এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত মহাবিহারের কেন্দ্রস্থলে অনুষ্ঠিত হত।
  • (৩) ইৎ সিং লিখেছেন যে, নালন্দার অধিবাসীদের সংখ্যা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রতিদিন এক স্থানে সকলের সমাবেশ কঠিন ছিল। তাই একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়। এই অনুষ্ঠানে একজন পুরোহিত ধূপ ও পুষ্পবহনকারী সাধারণ ভৃত্য ও শিশুদের সঙ্গে করে একটি সভাগৃহ থেকে অন্য সভাগৃহে গিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতেন। গোধূলির মধ্যেই এই অনুষ্ঠান শেষ হত।

পালযুগে নালন্দা

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন। পাল রাজবংশ ছিল একটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজবংশ।

  • (১) পালবংশের রাজত্বকালে নালন্দায় অনুশীলিত মহাযান মতবাদের সঙ্গে বজ্রযান নামে পরিচিত মহাযান দর্শনের তন্ত্র-প্রভাবিত একটি মতবাদের মিশ্রণ ঘটে।
  • (২) নালন্দা মহাবিহার গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করত এবং সেই উত্তরাধিকার ছিল বহু-প্রশংসিত। পাল সম্রাটরা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের শাসনকালে নালন্দার আদলে জগদ্দল, ওদন্তপুরী, সোমপুর ও বিক্রমশিলায় চারটি মহাবিহার গড়ে ওঠে।
  • (৩) পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল নালন্দা থেকে মাত্র ৬ মাইল (৯.৭ কিমি) দূরে ওদন্তপুরী মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • (৪) নালন্দায় প্রাপ্ত উৎকর্ণ লিপিগুলি থেকে জানা যায়, গোপালের পুত্র ধর্মপাল ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখ্য, তিনি বিক্রমশিলা মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
  • (৫) পালযুগে নালন্দার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধর্মপালের পুত্র দেবপাল। তিনি সোমপুর মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। নালন্দার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে পাওয়া একাধিক ধাতুমূর্তিতে দেবপালের উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • (৬) দেবপালের উৎকীর্ণ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, সুবর্ণদ্বীপ -এর (অধুনা ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা) শৈলেন্দ্র-বংশীয় রাজা বলপুত্রদেব “নালন্দার বহুমুখী উৎকর্ষে আকৃষ্ঠ হয়ে” সেখানে একটি মঠ নির্মাণ করেন এবং সেটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেবপালের কাছে পাঁচটি গ্রামের রাজস্ব অনুমোদন করার অনুরোধ জানান। দেবপাল তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।
  • (৭) ঘোসরাওয়ান উৎকীর্ণ লিপিটি হল দেবপালের সমসাময়িক কালের অপর একটি উৎকীর্ণ লিপি। এই লিপি থেকে জানা যায়, তিনি বীরদেব নামে এক বৈদিক পণ্ডিতকে অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বীরদেব পরবর্তীকালে নালন্দার অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
  • (৮) বহু শিলালিপি ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে জানা যায় যে, পাল রাজন্যবর্গ উদারভাবে নালন্দার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তবে পালযুগে অন্যান্য মহাবিহারগুলি নালন্দা থেকে অনেক শিক্ষিত ভিক্ষুকে গ্রহণ করায় নালন্দা একক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
  • (৯) পালযুগে বৌদ্ধধর্মের উপর বজ্রযানের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। নালন্দার উপরেও তার প্রভাব পড়েছিল। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অতীতে মহাযান মতবাদকে কেন্দ্র করে এক উদার উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল, সেই নালন্দা মহাবিহার ধীরে ধীরে তান্ত্রিক মতবাদ ও জাদুবিদ্যার অনুশীলনে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে।
  • (১০) তারানাথ সপ্তদশ শতাব্দীতে যে ইতিহাস গ্রন্থটি রচনা করেন, তাতে দাবি করা হয়েছে যে, নালন্দা সম্ভবত কোনও এক সময় বিক্রমশিলা মহাবিহারের অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীনেও এসেছিল।

মহাবিহার নালন্দা

  • (১) নালন্দা মহাবিহারের যে অংশে আজ পর্যন্ত খননকার্য চালানো হয়েছে, তার আয়তন শুধুমাত্র দৈর্ঘ্যে ১,৬০০ ফুট (৪৮৮ মি) ও প্রস্থে ৮০০ ফুট (২৪৪ মি) বা প্রায় ১২ একর।
  • (২) মধ্যযুগে নালন্দার আয়তন আরও বড়ো ছিল। নালন্দা মহাবিহার একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি। এটির বৈশিষ্ট্য হল একটি প্রকাণ্ড প্রাচীর ও তার একটিমাত্র প্রবেশ্বদ্বার।
  • (৩) নালন্দায় আটটি পৃথক চত্বর ও দশটি মন্দির ছিল। সেই সঙ্গে অনেকগুলি ধ্যানকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষও ছিল।
  • (৪) নালন্দা ছিল একটি আবাসিক মহাবিহার। এখানে ছাত্রদের বহুশয্যাবিশিষ্ট বাসকক্ষও ছিল।
  • (৫) খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীন নালন্দা মহাবিহারে ১০,০০০ ছাত্র ও ২,০০০ শিক্ষক ছিলেন। চীনা তীর্থযাত্রীদের মতে অবশ্য নালন্দার ছাত্রসংখ্যা ছিল ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ জনের মধ্যবর্তী।
  • (৬) সব ধরনের বিষয় এখানে অধীত হত। কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য ও তুরস্ক থেকে ছাত্র ও পণ্ডিতেরা এখানে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করতে আসতন।

হিউয়েন সাং-এর বর্ণনায় নালন্দা মহাবিহার

হিউয়েন সাং-এর বিবরণীতে সপ্তম শতাব্দীর নালন্দা মহাবিহারের একটি বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।

  • (১) তিনি লিখেছেন কীভাবে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ স্তম্ভ, সভাগৃহ, হার্মিক ও মন্দিরগুলিকে “আকাশে কুয়াশার উপর উড্ডয়নশীল” বলে মনে হত, যাতে নিজেদের কক্ষ থেকে ভিক্ষুরা “বায়ু ও মেঘের জন্মদৃশ্যের সাক্ষী থাকতে পারতেন”।
  • (২) হিউয়েন সাং লিখেছেন মঠগুলির চারিপাশে একটি নীল হ্রদ প্রবাহিত থাকত। সেই হ্রদে ভেসে থাকত পূর্ণ-প্রস্ফুটিত নীল পদ্ম। সুন্দর সুন্দর লাল কনক ফুল এখানে ওখানে দুলত, আর আম্রকুঞ্জের বাইরে অধিবাসীরা তাঁদের গভীর ও নিরাপদ আশ্রয় লাভ করতেন।

নালন্দার গ্রন্থাগার

নালন্দা মহাবিহারে গ্ৰন্থাগারের অস্তিত্ব ছিল।

  • (১) ইৎ সিং যে দশ বছর নালন্দায় অতিবাহিত করার পর প্রচুর গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, সেই বিষয়ে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এই মহাবিহারে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল।
  • (২) প্রথাগত তিব্বতি সূত্র অনুসারে, নালন্দার গ্রন্থাগারটির নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’ (‘ধর্মের হাট’)। তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এই গ্রন্থাগারটি অবস্থিত ছিল। ভবনগুলির নাম ছিল ‘রত্নসাগর’ (‘রত্নের মহাসাগর’), ‘রত্নোদধি’ (‘রত্নের সমুদ্র’) ও ‘রত্নরঞ্জক’ (‘রত্নখচিত’)।
  • (৩) রত্নোদধি ছিল নয়টি তলবিশিষ্ট ভবন। এখানেই পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র ও গুহ্যসমাজ রক্ষিত ছিল।
  • (৪) নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারে ঠিক কত বই ছিল তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে, সেখানে লক্ষাধিক গ্রন্থ ছিল।
  • (৫) গ্রন্থাগারে শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থের পুঁথিই রক্ষিত ছিল না। বরং ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলিও ছিল।
  • (৬) ইতিহাসবিদগণের অনুমান, নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারটির একটি শ্রেণিবিন্যাস ক্রম ছিল এবং এই ক্রমটি সংস্কৃত ভাষাবিদ পাণিনির শ্রেণিবিন্যাস ক্রমের ভিত্তিতে বিন্যস্ত হয়েছিল।
  • (৭) বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি খুব সম্ভবত ত্রিপিটকের প্রধান তিনটি বিভাগের (বিনয় পিটক, সুত্ত পিটক ও অভিধম্ম পিটক) ভিত্তিতে বিন্যস্ত ছিল।

নালন্দা মহাবিহারের শিক্ষাক্রম

  • (১) হিউয়েন সাং-এর জীবনগ্রন্থে হয়ুই-লি লিখেছেন যে, নালন্দার সকল ছাত্রই মহাযান ও বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন।
  • (২) তাঁরা বেদ, ‘হেতুবিদ্যা’ (ন্যায়শাস্ত্র), ‘শব্দবিদ্যা’ (ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব), ‘চিকিৎসাবিদ্যা’ (ভেষজবিদ্যা), জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত অন্যান্য গ্রন্থ (অথর্ববেদ) ও সাংখ্য দর্শন অধ্যয়ন করতেন।
  • (৩) হিউয়েন সাং নিজে শীলভদ্র ও অন্যান্যদের কাছে একাধিক বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ছাড়াও ন্যায়শাস্ত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত বিতর্ক ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হত।
  • (৪) নালন্দা মহাবিহারের প্রত্যেক ছাত্রকে দর্শনের সকল শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ন্যায়শাস্ত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করতে হত এবং সেই সঙ্গে তাঁকে বৌদ্ধধর্মের সপক্ষে যুক্তি দর্শিয়ে অন্যান্য মত খণ্ডন করতে হত।
  • (৫) এছাড়াও অনুমান করা হয় যে, নালন্দায় আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও নগর-পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয় শিক্ষাদান করা হত।
  • (৬) প্রথাগত তিব্বতি বিশ্বাস অনুসারে, নালন্দায় “চারটি ডক্সোগ্রাফি” (তিব্বতি:গ্রুব-মথা) শিক্ষাদান করা হত। – সর্বাস্তিবাদ বৈভাষিক, সর্বাস্তিবাদ সৌত্রান্তিক মধ্যমক, নাগার্জুনের মহাযান দর্শন, চিত্তমাত্রা, অসঙ্গ ও বসুবন্ধুর মহাযান দর্শন

মহাবিহার নালন্দার ছাত্র

হিউয়েন সাং-এর হিসাব অনুসারে, সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দায় প্রায় ১৫১০ জন শিক্ষক ছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রায় ১০০০ জন সূত্র ও শাস্ত্রের ২০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন, ৫০০ জন ৩০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন এবং মাত্র ১০ জন ৫০টি সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন।

নালন্দা মহাবিহারের শিক্ষক  

হিউয়েন সাং নিজে ছিলেন সেই অল্পসংখ্যক শিক্ষকদের অন্যতম যাঁরা ৫০টি বা ততোধিক সংকলন ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সেই সময় অধ্যক্ষ শীলভদ্রই কেবলমাত্র সূত্র ও শাস্ত্রের সকল প্রধান সংকলনগুলি অধ্যয়ন করেছিলেন।

নালন্দা মহাবিহারের প্রশাসন

  • (১) চীনা ভিক্ষু ইৎ সিং লিখেছেন যে, নালন্দার সকল অধিবাসী ভিক্ষুর সম্মতিসাপেক্ষে কাজকর্ম ও প্রশাসন পরিচালনা-সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। এই ক্ষেত্রে তাঁরা একত্রে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন ।
  • (২) কার্যসম্পাদনের জন্য ভিক্ষুদের সমবেত হয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হত। তারপর তাঁর বিহারপালকে আদেশ করতেন, তিনি যাতে অধিবাসী সকল ভিক্ষুর কাছে গিয়ে গিয়ে করজোড়ে বিষয়টি নিবেদন ও বিজ্ঞাপিত করেন।
  • (২) একজন ভিক্ষুরও সম্মতি না পাওয়া গেলে প্রস্তাবটি গৃহীত হত না। তাঁকে মতপ্রকাশ করার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হত না। যদি কোনও ভিক্ষু সকল অধিবাসীর সম্মতি ব্যতিরেকে কিছু করতেন, তবে তাঁকে বলপূর্বক মঠ ছাড়তে বাধ্য করা হত।
  • (৩) কোনওদিন বিষয়ে মতানৈক্য হলে তাঁরা সম্মতি অর্জনের জন্য (অপর গোষ্ঠীর সম্মুখে) যুক্তি প্রদর্শন করতে পারতেন। সম্মতি অর্জনের জন্য বলপ্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টি করা হত না।

নালন্দা মহাবিহারের প্রশাসন সম্পর্কে হিউয়েন সাং

বিখ্যাত নালন্দা মহাবিহারের প্রশাসন প্রসঙ্গে হিউয়েন সাং লিখেছেন যে,

  • (১) এই পূতচরিত্র ব্যক্তিত্বদের সকলের জীবন স্বাভাবিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হত সর্বাধিক ভাবগম্ভীর ও কঠোরতম অভ্যাসের মাধ্যমে। তাই মঠের সাতশো বছরের ইতিহাসে কেউই শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি।
  • (২) রাজা মঠের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের চিহ্ন বর্ষণ করতেন এবং একশো শহর থেকে আহৃত রাজস্ব ধার্মিকদের ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করতেন।

বৌদ্ধধর্মের উপর নালন্দা মহাবিহারের প্রভাব

নালন্দা মহাবিহার বৌদ্ধ ধর্মের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

  • (১) তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও বজ্রযান উভয় শাখারই একটি বড়ো অংশের উৎস হল নালন্দার শিক্ষক-পরম্পরা ও প্রথা-রীতিনীতি।
  • (২) খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচারে প্রধান ভূমিকা নেন নালন্দার বিশিষ্ট পণ্ডিত শান্তরক্ষিত। তিব্বতের রাজা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি সাম্যেতে একটি মঠও প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তরক্ষিত ছিলেন সেই মঠের প্রথম অধ্যক্ষ।
  • (৩) শান্তরক্ষিত ও তাঁর শিষ্য কমলশীল দর্শনের প্রাথমিক শিক্ষাদান করেছিলেন। উল্লেখ্য, কমলশীলও ছিলেন নালন্দা মহাবিহারের পণ্ডিত।
  • (৪) ৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের রাজা নালন্দা মহাবিহার থেকে পদ্মসম্ভবকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁকেই তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মনে করা হয়।
  • (৫) ভারতীয় দার্শনিক ন্যায়শাস্ত্রের অন্যতম বৌদ্ধ প্রবর্তক পণ্ডিত ধর্মকীর্তি নালন্দা মহাবিহারে যে বৌদ্ধ পরমাণুবাদ শিক্ষা দেওয়া হত, তার অন্যতম আদি তাত্ত্বিক ছিলেন।
  • (৬) ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া ও জাপানে অনুসৃত মহাযান সহ বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য শাখাগুলিও নালন্দা মহাবিহারেই বিকাশ লাভ করেছিল।
  • (৭) একাধিক গবেষকের মতে, পূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ সুত্র সুরঙ্গমা সূত্র সহ কয়েকটি মহাযান ধর্মগ্রন্থ নালন্দায় প্রচলিত মতবাদের অনুসারী।
  • (৮) এই সূত্রের সাধারন মতবাদটি অবশ্যই নালন্দায় গুপ্তযুগের শেষভাগে যে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেওয়া হত, তার অনুগামী। সেই সময়েই সূত্রটি অনূদিত হয়েছিল।

নালন্দার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ববর্গ

নালন্দা মহাবিহারের সাথে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত ছিলেন বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।

  • (১) প্রথাগত সূত্র থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীতে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ দুজনেই নালন্দায় এসেছিলেন। তাছাড়া নালন্দা হল বুদ্ধের অন্যতম বিখ্যাত শিষ্য সারিপুত্রের জন্ম ও নির্বাণলাভের স্থান।
  • (২) আর্যভট্ট, নাগার্জুন (শূন্যতা ধারণার সূত্রায়নকারী, আর্যদেব (নাগার্জুনের ছাত্র), অতীশ (মহাযান ও বজ্রযান পণ্ডিত), চন্দ্রকীর্তি (নাগার্জুনের ছাত্র), ধর্মকীর্তি (নৈয়ায়িক), ধর্মপাল, দিগ্নাগ (বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রের প্রবর্তক), শীলভদ্র (হিউয়েন সাংয়ের শিক্ষক), (হিউয়েন সাং (চীনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী), ইৎ সিং (চীনা বৌদ্ধ পর্যটক) প্রমুখ।

নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসপ্রাপ্তি ও অবলুপ্তি

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের সঙ্গে নালন্দা মহাবিহারের গুরুত্ব কমতে থাকে।

  • (১) খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন স্থান পর্যটনের সময় হিউয়েন সাং লক্ষ্য করেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাসও পেয়েছিলেন।
  • (২) কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার-অনুষ্ঠান ও জাদুবিদ্যা-কেন্দ্রিক তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম অন্তর্ভুক্ত হয়।
  • (৩) ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিকদের পুনঃরুত্থান হয় এবং একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের রাজ্যচ্যুতি ঘটে । ফলে সেই সময় বৌদ্ধধর্মের রাজনৈতিক, দার্শনিক ও নৈতিক প্রভাব কমে এসেছিল।
  • (৪) খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমানেরা বৌদ্ধ মঠগুলি আক্রমণ করে। এটিই ছিল ভারতে বৌদ্ধধর্মের উপর শেষ আঘাত। এ জ্ঞানপীঠকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল।
  • (৫) বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পড়ে নালন্দা। প্রথমবার স্কন্দগুপ্ত -এর সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) মিহিরকুল -এর নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হুনরা নালন্দা আক্রমণ করে। তারা বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরের বংশধররা নালন্দাকে পুণর্গঠন করেছিলেন।
  • (৬) খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি গোষ্ঠীপতি বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমণের সেনানায়ক নিযুক্ত হয়। বিহার সীমান্তের দুটি গ্রাম খিলজির হাতে সমর্পিত হয়েছিল। এই গ্রামদুটি রাজনৈতিকভাবে কার্যত মালিকানাহীন অঞ্চলে পরিণত হয়।
  • (৭) সুযোগ বুঝে খলজি বিহারে লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই কাজের জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার দুইই দেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খলজি বিহারের একটি দুর্গ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেটি দখল করতে সক্ষমও হন।
  • (৮) এই দুর্গের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাদের সকলেরই মস্তক ছিল মুণ্ডিত। তাঁদের সকলকে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রচুর বই ও বইয়ের বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর জানা যায়, সেই দূর্গ ও শহরটি ছিল একটি মহাবিদ্যালয়। হিন্দুদের ভাষায় তাঁরা সেটিকে বলতেন একটি মহাবিদ্যালয়, যার বিহারে অবস্থান।

নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ

পতনের পর নালন্দা প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছিল।

  • (১) ১৮১১-১৮১২ সাল নাগাদ স্থানীয় অধিবাসীরা সেই অঞ্চলে ধ্বংসস্তুপের একটি বিরাট চত্বরের দিকে ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিলনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, তিনি সেই ক্ষেত্রটিতে সমীক্ষা চালান। যদিও তিনি মাটি ও ভগ্নাবশেষের সেই স্তুপকে ঐতিহাসিক নালন্দা মহাবিহার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি।
  • (২) আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম ও সদ্যগঠিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ১৮৬১-১৮৬২ সালে এখানে একটি সরকারি সমীক্ষা চালায়।
  • (৩) ১৯১৫ সালের আগে এ এস আই এই ক্ষেত্রটিতে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু করেনি। এই খননকার্য শেষ হয় ১৯৩৭ সালে। দ্বিতীয় দফায় খননকার্য ও পুনঃসংস্কার সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ ও ১৯৮২ সালে।
  • (৪) নালন্দার ধ্বংসাবশেষ যে জমির উপর অবস্থিত তার দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে ১,৬০০ ফুট (৪৮৮ মি) এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৮০০ ফুট (২৪৪ মি)।
  • (৫) খননকার্যের ফলে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় সজ্জিত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি প্রধান মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি ১০০ ফু (৩০ মি) প্রশস্ত পথ উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত ছিল। এই পথের পশ্চিম দিকে ছিল মন্দিরগুলি এবং পূর্ব দিকে ছিল মঠগুলি।
  • (৬) অধিকাংশ স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে এই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, বিভিন্ন সময়ে এই স্থাপনাগুলি নির্মিত হয়। পুরনো ভবনের ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন ভবনও নির্মিত হয়েছিল। অনেক ভবনেই অন্তত একবার অগ্নিকাণ্ডের চিহ্ন বর্তমান রয়েছে।
  • (৭) নালন্দার সবকটি মঠই নকশা ও সাধারণ গঠনভঙ্গিমার দিক থেকে অনেকটা একই রকম। এগুলির নকশা আয়তাকার। এগুলির কেন্দ্রে ছিল একটি চতুষ্কোণাকার অঙ্গন, যেটি একটি বারান্দা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকত। বারান্দাটি আবার বাইরের দিক থেকে ভিক্ষুদের বাসের জন্য নির্মিত কক্ষের বহিঃস্থ সারির দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকত।
  • (৮) কেন্দ্রীয় কক্ষটির মুখ ছিল অঙ্গনটির প্রবেশপথের দিকে। এই কক্ষটি ছিল মন্দিরকক্ষ। এটির নির্মাণশৈলী এমন ছিল যাতে ভবনটিতে প্রবেশ মাত্রেই মন্দিরকক্ষটির দিকে দৃষ্টি যায়।
  • (৯) প্রায় সবকটি মঠের মুখ ছিল পশ্চিম দিকে এবং সেগুলির পয়ঃপ্রণালীর মুখ ছিল পূর্ব দিকে। সিঁড়িগুলি ভবনগুলির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে নির্মিত হয়েছিল।
  • (১০) অসংখ্য ভাস্কর্য, ম্যুরাল, তামার পাত, উৎকীর্ণ লিপি, সিলমোহর, মুদ্রা, ফলক, মৃৎপাত্র এবং পাথর, ব্রোঞ্জ, ও টেরাকোটায় নির্মিত শিল্পকলা নালন্দার ধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • (১১) বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বুদ্ধের মূর্তি, অবলোকিতেশ্বর, জম্ভল, মঞ্জুশ্রী, মারীচি ও তারার মূর্তি।
  • (১২) ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে বিষ্ণু, শিব-পার্বতী, গণেশ, মহিষাসুরমর্দিনী ও সূর্য – এই সকল ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে।

নালন্দার উদ্বর্তিত পুঁথি

বিখ্যাত নালন্দা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভিক্ষুরা কিছু পুঁথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এগুলির কয়েকটি এখনও পাওয়া যায়। লস এঞ্জেলস কাউন্টি মিউজিয়াম অফ আর্ট, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইয়ারলুং জাদুঘর প্রভৃতি সংগ্রহশালায় তা রক্ষিত আছে।

নালন্দা পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা

নালন্দা মহাবিহারের পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়।

  • (১) ১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিহার সরকার প্রাচীন মহাবিহারটির অনুকরণে পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নব নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ সালে এটি একটি পরিগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়।
  • (২) ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর নালন্দার নিকটবর্তী রাজগিরে ১৫ জন ছাত্র নিয়ে একটি আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষাবর্ষের সূচনা ঘটে।প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়।
  • (৩) ভারত সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাপ্রাঙ্গন গঠনের জন্য ৪৫৫ একর জমি এবং ২৮২৮ কোটি টাকা (প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অনুমোদন করে। চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশের সরকারও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে অর্থসাহায্য করে।

পর্যটন কেন্দ্র নালন্দা

বর্তমানে নালন্দা বিহার রাজ্যের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ভারত ও বিদেশের প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। বৌদ্ধ পর্যটন পথেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্যস্থল হল নালন্দা।

নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহালয়

নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে দর্শকদের সুবিধার জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ একটি জাদুঘর পরিচালনা করে।

  • (১) এই জাদুঘরে নালন্দা ও নিকটবর্তী রাজগির থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী প্রদর্শিত হয়েছে।
  • (২) ১৩,৪৬৩টি প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে মাত্র ৩৪৯টিই দর্শকরা দেখার সুযোগ পান। এগুলি চারটি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়।

নালন্দায় অবস্থিত হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল

ইন্দো-চীনা যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল হল। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের সম্মানার্থে এই সভাঘরটি স্থাপিত হয়েছে। এই সভাঘরে হিউয়েন সাংয়ের মাথার খুলির একটুকরো হাড় প্রদর্শিত হয়েছে।

নালন্দা মাল্টিমিডিয়া মিউজিয়াম

বেসরকারি উদ্যোগে নালন্দার ধ্বংসাবশেষের কাছে Nalanda Multimedia Museum নামে আরেকটি জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। এই জাদুঘরে নালন্দার ইতিহাস ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন ও অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।

উপসংহার :- আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের হাজারো বছর পূর্বে ভারতবর্ষের মাটিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম এবং বর্তমানকালের প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিশ্ববিদ্যালয় হল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

(FAQ) নালন্দা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নালন্দা মহাবিহার কোথায় অবস্থিত?

প্রাচীন ভারতে মগধ রাজ্যে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যে)।

২. নালন্দা মহাবিহার কে প্রতিষ্ঠা করেন?

গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমার গুপ্ত।

৩. নালন্দা মহাবিহার কোন গুপ্ত সম্রাটের আমলে তৈরি হয়?

প্রথম কুমার গুপ্ত।

৪. কোন সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

গুপ্ত যুগে।

৫. নালন্দা মহাবিহারে লেখা তালপাতার পুঁথিটির নাম কি?

অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা।

৬. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে ধ্বংস করেন?

ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি।

Leave a Comment