নবান্ন উৎসব

বাঙালির নবান্ন উৎসব প্রসঙ্গে অর্থ, প্রচলনের কারণ, সময়, নতুন অন্ন গ্ৰহণ, বর্তমান অবস্থা, বাংলাদেশে নবান্ন, ভারতে নবান্ন, নবান্ন উৎসবের বর্ণনা ও জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে জানবো।

হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব নবান্ন প্রসঙ্গে নবান্ন শব্দের অর্থ, নবান্ন উৎসব প্রচলনের কারণ, নবান্ন উৎসবের সময়, নবান্ন উৎসবের ঋতু, অগ্ৰহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব, নবান্ন উৎসবের দিন দেবীর পূজা, নবান্ন উৎসবে নতুন অন্ন গ্ৰহণ, নবান্ন উৎসব উপলক্ষে পালনীয়, নবান্ন উৎসবের বর্তমান অবস্থা, বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নবান্ন উৎসব, নবান্ন উৎসবের বর্ণনা, নবান্ন উৎসব সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের কবিতা।

হিন্দু সম্প্রদায়ের নবান্ন উৎসব

উৎসবনবান্ন উৎসব
ধরণবার্ষিক
পালনকারীহিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ
সময়অগ্ৰহায়ণ মাস
ঋতুহেমন্ত
নবান্ন উৎসব

ভূমিকা :- বাংলাদেশভারত -এর পশ্চিমবঙ্গ -এর ঐতিহ্যবাহী ধানের বা পিঠার উৎসব হল নবান্ন। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হল নবান্ন।

নবান্ন শব্দের অর্থ

বাঙালির উৎসব ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব বিশেষ।

নবান্ন উৎসব প্রচলনের কারণ

শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব হল নবান্ন। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যে কোনো ঋতুতে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। অধিক শস্যপ্রাপ্তি, বৃষ্টি, সন্তান ও পশুসম্পদ কামনা এই উৎসব প্রচলনের প্রধান কারণ।

নবান্ন উৎসবের সময়

সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদ্‌যাপনের প্রথা রয়েছে।

নবান্ন উৎসবে নতুন অন্ন গ্ৰহণ

এই নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

নবান্ন উৎসবের অঙ্গ কাকবলী

নবান্নের অঙ্গ হিসেবে একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা হল নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’।

পৌষ সংক্রান্তির দিন নবান্ন উৎসব

অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল। নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা।

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে পালনীয়

হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুসারে নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়।

নবান্ন উৎসবের বর্তমান অবস্থা

একসময় অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন হত, সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়।

বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব

  • (১) বাংলাদেশের বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার শালগ্রামসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে আবহমানকাল ধরে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়ে আসছে।
  • (২) ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন শুরু হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্‌যাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্‌যাপন করে। উৎসব বাংলা ৩ দিন ব্যাপি নবান্ন উৎসব আয়োজন করে আসছে রমনা বট মূলে।
  • (৩) সাংকৃতিক সংগঠন শোবিজ এন্টারটেইনমেন্ট রাজধানীর ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর বিগত ১২ বছর ধরে ৩ দিন ব্যাপি নবান্ন উৎসব ও পিঠা মেলা আয়োজন করে আসছে। এই উৎসবের ৩৩ টি স্টলে ২০০ ধরনের পিঠা থাকে।
  • (৪) উৎসব প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন সকাল ৭ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আয়োজন করা হয় নবান্নের নাচ, নবান্নের গান, লোকগীতি, লালন গীতি, বাউল গান, সাপ খেলা, বানর খেলা, লাঠি খেলা, নাগর দোলা, পুতুল নাচ, পালকি, পথ নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এই নবান্ন উৎসবের সমাপনী দিনে সেরা পিঠা শিল্পীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়।

ভারতে নবান্ন উৎসব

  • (১) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া সহ বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়।
  • (২) উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে নবান্ন উৎসব পালিত হয় বৈশাখ মাসে। সেখানে রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এই বৈশাখী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়।

নবান্ন উৎসব হিসেবে সাঁওতালদের সোহরায় উৎসব

সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদযাপন করে সোহরায় উৎসব। তারা সাতদিন সাত রাত গানবাজনা এবং মদ্যপানের মাধ্যমে এই উৎসব পালন করে।

নবান্ন উৎসবের বর্ণনা

  • (১) ঋতুবৈচিত্র্যে শীতের আগেই আসে হেমন্ত। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ কৃষাণীরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠে পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।
  • (২) পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙ্গালিদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম বর্ণ উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে।
  • (৩) অগ্রহায়ণের শুরুতেই আমাদের গ্রাম বাংলায় চলে নানা উৎসব, নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। বাঙালির বার মাসে তের পাবর্ণে এই উৎসব যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব।
  • (৪) হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দ। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে অগ্রহায়ণ কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে।
  • (৫) নবান্ন হল হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম খাবার। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ।
  • (৬) অগ্রহায়ণ এলেই মাঠজুড়ে ধানকাটার ধুম পড়ে যায়। এই সময়ে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটান কৃষাণ-কৃষাণীরা। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা।
  • (৭) যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকি ছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর, পায়েস সহ নানা উপাদান। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম।
  • (৮) নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। যেহেতু নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব তাই প্রতি বছর ঘুরেফিরে আসে নবান্ন উৎসব।
  • (৯) হাজার বছরের পুরনো এই উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন হয়ে আসছে। নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় গ্রামীণ মেলার। এইসব মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। আনন্দ দেখা যায় ছোটবড় সব বয়সের মানুষের মধ্যে।

নবান্ন উৎসব প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কবিতা

সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্ন ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায় উঠে এসেছে প্রকৃতির চিত্র। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেন,

“আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়

মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।”

কবির কবিতার লাইনের মতোই নবান্নে চিরায়ত বাংলার রূপ।

উপসংহার :- নবান্ন উৎসবে উপস্থিত থাকেন নবীন প্রবীণ সবাই। হরেক রকমের বাহারি সব খাবারের দোকানের পসরা দিয়ে বসানো হয় গ্রামীণ মেলা। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না, শহরের মানুষও এখন নবান্নের স্বাদ নিয়ে থাকে।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “নবান্ন উৎসব” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) নবান্ন উৎসব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নবান্ন উৎসব পালন করে কারা?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।

২. কোন ঋতুতে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়?

হেমন্ত।

৩. কোন মাসে নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়?

বাংলা অগ্ৰহায়ণ মাসে।

৪. নবান্ন কি?

‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব বিশেষ।

অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎসবগুলি

Leave a Comment