নববাবুবিলাস

নববাবুবিলাস গ্ৰন্থ, গ্ৰন্থের রচয়িতা, প্রকাশকাল, বিষয়বস্তু, ব্যঙ্গ রস পরিবেশন, অস্পষ্ট কাহিনীধারা, গ্ৰন্থের বিভাগ ও বিশেষ স্থান অর্জন সম্পর্কে জানবো।

নকশা জাতীয় রচনা নববাবুবিলাস

বৈশিষ্ট্যনকশা জাতীয় রচনা
লেখকভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকাল১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ
মূল বিষয়বাবু সমাজের অন্ধকার দিক
নববাবুবিলাস

ভূমিকা :- ‘নববাবুবিলাস’ একটি ব্যঙ্গকৌতুক নকশা। ইংরেজি শিক্ষা ভাল করে প্রচলিত হবার আগেকার কলকাতার হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা অর্ধশিক্ষিত নব্যবাবুদের আচার-ব্যবহার ও নৈতিক জীবনযাত্রার প্রতি সেটায়ার বা ব্যঙ্গ-চিত্র ছিল ‘নববাবুবিলাস’

নববাবুবিলাস গ্রন্থের রচয়িতা

গ্ৰন্থটির রচয়িতা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) ছিলেন লেখক, সাংবাদিক, কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অন্যতম নেতা। স্বশিক্ষিত ভবানীচরণ ফার্সী, সংস্কৃত ও ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের প্রকাশকাল

১৮২৫ সালে নববাবুবিলাস প্রমথনাথ শর্মণ ছদ্মনামে প্রকাশিত।

প্রথম বাংলা উপন্যাস নববাবুবিলাস

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও আশুতোষ ভট্টাচার্য এই গ্ৰন্থটিকে ‘প্রথম বাংলা উপন্যাস’-এর মর্যাদা দিলেও, অধিকাংশ সমালোচক একটি কৌতুক নকশা হিসাবেই ব্যাখ্যা এর করেছেন।

সৃজনশীল গদ্য রচনায় নববাবুবিলাস

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস রচনা না করলেও, তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সৃজনশীল গদ্য লেখেন।

বাবু সভ্যতার বিকাশ বর্ণনায় নববাবুবিলাস

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার বুকে বাবু সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

  • (১) ইংরেজদের সাহচর্যে ব্যবসায় ও ভূমিব্যবস্থার সূত্রে তখন শিক্ষিত ধনী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
  • (২) ইংরাজি শিক্ষার সদর্থক দিকগুলি তাদের আয়ত্ত ছিল না, কেবল সামন্তযুগীয় লাম্পট্য ও উচ্ছৃঙ্খলতাকেই তারা সংস্কারমুক্ত আধুনিকতার নামে পুনর্বার আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছিল।
  • (৩) সেই দিক থেকে ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে মদমত্ত হঠাৎ নবাবদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের গ্লানি উন্মােচিত হয়েছে।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের মূল বিষয়

নববাবুবিলাস-এর মূল উপজীব্য উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের বহু সমালোচিত বাবু সংস্কৃতির অন্ধকার দিকটি।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের মাধ্যমে কথাসাহিত্যের সূচনা

‘নববাবুবিলাস’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত প্রথম বাংলা কথাসাহিত্য।

পথপ্রদর্শক রূপে নববাবুবিলাস

পরবর্তীতে প্যারীচাঁদ মিত্র আলালের ঘরের দুলাল নামে যে প্রথম বাংলা উপন্যাস প্রকাশ করেন, নববাবুবিলাস তার পথ দেখিয়েছিল।

নববাবুবিলাস গ্রন্থে নব্য ধনীদের বিদ্রুপ

নববাবুবিলাস গ্রন্থে তিনি নব্যধনীদের অসংযমী জীবনযাত্রাকে বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করেন।

নববাবুবিলাস গ্রন্থে ব্যঙ্গ রস পরিবেশন

গদ্যে-পদ্যে, তৎসম শব্দসমাবেশে ও চটুল কথ্যরীতিতে বর্ণসংকর ও চমকপ্রদ ভাষাবিন্যাসের মধ্য দিয়ে ভবানীচরণের তির্যক ব্যঙ্গরস পরিবেশিত হয়েছে ‘নববাবুবিলাসে’।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের অস্পষ্ট কাহিনীধারা

‘নববাবুবিলাসে’ একটি অস্পষ্ট কাহিনীধারা পরিলক্ষিত হয়। নববাবুর পূর্বপুরুষের ধনার্জন রহস্য থেকে শুরু করে তার বিদ্যাশিক্ষা, অমাত্য পরিবৃত বিষয়কর্ম, বাবুদর্শনে দীক্ষালাভ ইত্যাদি বিস্তৃতভাবে এখানে বর্ণিত। নিদারুণ জীবন পরিণতির মধ্যে নববাবুর বৃত্তান্ত পরিসমাপ্ত হয়েছে।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের ঋণ প্রদান

প্যারীচাঁদ মিত্রের আলাল সম্পূর্ণরুপেই ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাস’ – এর কাছে ঋণী।

নববাবুবিলাস গ্রন্থটির ভাগ

এই গ্ৰন্থটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। – অঙ্কুর খণ্ড, পল্লবখণ্ড, কুসুমখণ্ড ও ফল খণ্ড।

  • (১) গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে মঙ্গলকাব্যের ধাঁচে রচিত ‘বন্দনা’, ‘গণপতি বন্দনা’ ও ‘দেবী সরস্বতীর বন্দনা’ দিয়ে। এরপর অঙ্কুর খণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের অঙ্কুর অধ্যায়ে সেকালের উচ্ছৃঙ্খল যুবসমাজের ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাপ্রণালীর প্রতি কৌতুক কটাক্ষ নিক্ষেপ করা হয়েছে।
  • (২) পল্লবখণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের পল্লব অধ্যায়ে নব্যবাবুদের কুসঙ্গে পড়ার চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে।
  • (৩) কুসুমখণ্ড -এ বাবুর নব্যবাবু নামধারণ, বেশ্যাগমন ও বিলাসব্যসনের সুচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
  • (৪) ফল খণ্ড অর্থাৎ বাবুরূপ বৃক্ষের ফল অধ্যায়ে বাবুপত্নীর বিরহ, খেদোক্তি ও অন্তিমে করুণ পরিণতির বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্ব নববিবিবিলাস

পরে নববিবিবিলাস নামে ভবানীচরণ এই গ্রন্থের একটি দ্বিতীয় পর্বও রচনা করেন। এটি পূর্ব গ্রন্থেরই পরিপূরক। এটি গদ্যে রচিত। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে বাবুদের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণিত। এই অবস্থায় তাদের বিবিদের মধ্যেও লাম্পট্য ও উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকটিত হতে বাধ্য। ‘নববিবিবিলাসে’ সেই সামাজিক ক্লেদ ব্যঙ্গের কষাঘাতে উন্মােচিত। এই গ্রন্থটিতে লেখক ভােলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন।

নববাবুবিলাস গ্রন্থের সমালোচনা

ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, “ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গ আখ্যানগুলি অর্ধশিক্ষিত ধনী সন্তানদের কুৎসিত আমোদ-প্রমোদের কথা সাধুভাষায় বলা হলেও উদ্দেশ্য তত সাধু ছিল না। বাইরে থেকে এসব নকশায় রঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও গল্পের আমেজ থাকলেও ভিতরে ছিল ‘পর্নো’ (porno)-কেচ্ছা-কেলেংকারি। সমাজের কুরীতি দেখিয়ে সভ্যভব্য মানসিকতা সৃষ্টি, এই জন্যই ভবানীচরণ ও অন্যান্য নকশাকারেরা কলম ধরেছিলেন; কিন্তু রোগের চেয়ে ঔষধই হয়েছিল প্রাণঘাতী।”

নববাবুবিলাস গ্রন্থটির বিশিষ্ট স্থান লাভ

উনিশ শতকের কলকাতার বাবু কালচারের একটি উলঙ্গ রূপ চিত্রিত করে বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসে এই গ্রন্থটি এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে।

উপসংহার :- ‘নববাবুবিলাস’-এর চারটি খণ্ডে প্রমথনাথ যে উনিশ শতকীয় বাংলা তথা কলকাতার এক জীবন্ত ছবি এঁকেছেন, সরিয়ে দিয়েছেন মুখ আর মুখোশের আড়াল তা আর বুঝতে দেরি হয় না।

(FAQ) নববাবুবিলাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ‘নববাবুবিলাস’ কার লেখা?

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

২. ‘নববাবুবিলাস’ কী জাতীয় রচনা?

একটি ব্যঙ্গকৌতুক নকশা

৩. ‘নববাবুবিলাস’ প্রকাশিত হয় কোন ছদ্মনামে?

প্রমথনাথ শর্মণ।

Leave a Comment