মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা

বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁর লক্ষ্য, তথ্যসূত্র, বাংলার অবস্থা, বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সমস্যা, জায়গির বাজেয়াপ্ত, মালজামিনি ব্যবস্থা, ইজারাদার, যদুনাথ সরকারের অভিমত ও তার মতের সমালোচনা, নানকর ও জলকর, হিন্দুদের নিয়োগ, জমি জরিপ, রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা, তকাভি ঋণ প্রদান ও তার ভূমিরাজস্ব নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনামুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা
পরিচিতমালজামিনি ব্যবস্থা
প্রবর্তকমুর্শিদকুলি খাঁ
প্রচলিত অঞ্চলবাংলা
মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা

ভূমিকা :- অষ্টাদশ শতকের বাংলার ইতিহাসে মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। এটি তাঁর নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, দক্ষতা ও উদ্যোগের বহিঃপ্রকাশ।

ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে মুর্শিদকুলি খাঁর লক্ষ্য

তাঁর প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত ও গতিশীল করে তোলা।

মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্যসূত্র

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য আমাদের হাতে নেই। এইব্যাপারে যে সব গ্রন্থ থেকে সাহায্য পাওয়া যায় সেগুলি হল –

  • (১) সলিমউল্লাহ -এর লেখা ‘তারিখ-ই-বাঙ্গালা’।
  • (২) গোলাম হোসেন সলিমের ‘রিয়াজ-উস্-সালাতিন’।
  • (৩) এনায়েতউল্লাহ-র ‘আহকাম-ই আলমগিরি এবং
  • (৪) জেমস্ গ্রান্ট রচিত ‘অ্যানালিসিস অফ দি ফিনান্সেস অব বেঙ্গল’ (‘Analysis of the Finances of Bengal’)।

মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্যসূত্রের অসুবিধা

এই সব গ্রন্থগুলি ব্যবহারেও নানা অসুবিধা আছে কারণ উল্লিখিত গ্রন্থগুলির বক্তব্যে নানা অসামঞ্জস্য, অস্পষ্টতা ও পরস্পর-বিরোধিতা লক্ষ্যণীয়।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময় বাংলার অবস্থা

  • (১) ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ যখন ‘দেওয়ান’ হিসেবে বাংলায় আসেনতখন বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ অনিয়মিত, অনিয়ন্ত্রিত ও চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ।
  • (২) বস্তুত মোগল শাসনের সূচনা থেকে ঔরঙ্গজেব -এর শেষ জীবন পর্যন্ত রাজস্ব-সংক্রান্তব্যাপারে বাংলায় কখনোই কোনও সুনিয়ন্ত্রিত নীতি গ্রহণ করা হয় নি।
  • (৩) আকবর -এর রাজস্ব-মন্ত্রী টোডরমল -এর উত্তর ভারতীয় রাজস্ব নীতি (‘জাবৎ’) বাংলায় প্রবর্তনকরা সম্ভব হয় নি।
  • (৪) জাহাঙ্গীরশাহজাহান -এর রাজত্বকালে বাংলায় অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহ চলার ফলে সেখানে কোনও সুষ্ঠু রাজস্ব নীতি প্রবর্তন করা সম্ভব ছিল না।
  • (৫) ঔরঙ্গজেবের আমলের সুবিখ্যাত ‘সুবাদার’ মিরজুমলা বা শায়েস্তা খান-ও এই ব্যাপারে কিছু করতে পারেন নি।

মুর্শিদকুলি খাঁর সময় বাংলায় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সমস্যা

বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় তখন নানা ধরনের সমস্যাছিল।যেমন –

  • (১) ভূমিরাজস্ব থেকে তখন সরকারের কোনও আয় ছিল না। সরকারের সকল ‘খালিসা’ জমি সরকারি কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জায়গির হিসেবে বন্টিত হয়ে যাওয়ায় সরকারের নিজস্ব কোনও জমি ছিল না। এক্ষেত্রে সরকারি আয়ের একমাত্র উৎস ছিল ‘সায়ির’ বা বাণিজ্য শুল্ক।
  • (২) বাংলার পুরোনো জমিদারবর্গ, যাঁদের ওপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল। তাঁরা অনেকেই দুর্নীতি পরায়ণ, অলস ও অপদার্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আদায়িকৃত রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দিতেন না এবং স্বাধীন নৃপতির মতো আচরণ করতেন।
  • (৩) দীর্ঘদিন ধরে জমি জরিপ না হওয়ায় সরকারের প্রকৃত কত রাজস্ব পাওয়া উচিত তা জানার উপায় ছিল না। জমিদাররা জমির পরিমাণ কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিতেন।
  • (৪) রাজস্ব বিভাগে কোনও শৃঙ্খলা না থাকায় কর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। মুসলিম জমিদাররা সরকারকে ঠিক মতো রাজস্ব দিতেন না। তাঁরা নিজেদের শাসকশ্রেণীর লোক বলে মনে করতেন এবং রাজস্বের জন্য চাপ দিলে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসতেন।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ কর্তৃক জায়গির বাজেয়াপ্ত

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হন। স্যার যদুনাথ সরকার মুর্শিদকুলির ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর রচনা থেকে জানা যায় যে, রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যেমন –

  • (১) ‘জায়গির’ হিসেবে কর্মচারীদের প্রদত্ত সব জমি বাজেয়াপ্ত করে তিনি সেগুলিকে ‘খালিসা’ বা সরকারের‘খাস’ জমিতে পরিণত করেন। জায়গিরচ্যুত কর্মচারীদের তিনি উড়িষ্যার অনাবাদি, অনুন্নত ও অনধিকৃত বালুকাময় ও জঙ্গলে ঢাকা অঞ্চলে জমি দেন।
  • (২) রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব জমিদারদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নিলামের ভিত্তিতে নিযুক্ত ইজারাদারদের ওপর অর্পিত হয়।

মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার অন্য নাম মালজামিনি ব্যবস্থা

ইজারাদাররা নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব (মাল) প্রদানের ‘জামিন’ বা অঙ্গীকারকরে একটি ‘চুক্তিপত্র’ প্রদান করতেন। সেই কারণে মুর্শিদকুলি খাঁ-র ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ‘মালজামিনি ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় ইজারাদার

এই ব্যবস্থায় জমিদাররা জমি হারালেন না, কিন্তু তাঁরা নবনিযুক্ত ইজারাদারদের অধীনে রইলেন। আসলে এই সময় জমিদাররা এমন অলস ও অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁদের দিয়ে আর নিয়মিত অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছিল না। এই কারণে মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁদের মাথার ওপর ইজারাদারদের বসিয়ে দেন।

মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে যদুনাথ সরকারের অভিমত

স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, এই ব্যবস্থার ফলে কালক্রমে অনেক জমিদার নিশ্চিহ্ন হয়ে যান এবং এই সব নবনিযুক্ত ইজারাদাররাই জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এইভাবে মুর্শিদকুলি বাংলার জমিদারি ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন আনেন।

যদুনাথ সরকারের মতামতের সমালোচনা

  • (১) বলা বাহুল্য, ডঃ আবদুল করিম স্যার যদুনাথের এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন যে, আমাদের হাতে এমন কোনও তথ্য নেই, যার দ্বারা বলা যায় যে, ইংরেজদের মতো মুর্শিদকুলিও সর্বোচ্চ নিলামদারদের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করতেন।
  • (২) অবশ্য এটাহতেই পারে যে, মুর্শিদকুলির আমলের কোনও ইজারাদার পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বড় জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
  • (৩) ‘আহকাম্-ই-আলমগিরি-তে যে ‘মালজামিনি’ ব্যবস্থার উল্লেখ আছে তা মুর্শিদকুলির আমলে বাংলাদেশ-এ আদৌ প্রচলিত ছিল কিনা, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
  • (৪) এই ব্যবস্থা বাংলায় চালু থাকলেও তা ঔরঙ্গজেবের আমলের অর্থাৎ মুর্শিদকুলির জীবনের সূচনা-পর্বের।
  • (৫) সলিমউল্লাহ ও গ্রান্টের রচনা থেকে জানা যায় যে দীর্ঘকাল বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করার পর ১৭২২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মুর্শিদকুলি তাঁর নিজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
  • (৬) ডঃ আবদুল করিম -এর মতে তিনি বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় বিরাট কোনও পরিবর্তন আনেন নি।

মুর্শিদকুলি খাঁর নানকর ও জলকর ব্যবস্থা

উচ্ছেদ হওয়া প্রাচীন জমিদারদের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি ‘নানকর’ (অনুন্নত জমি), ‘বনকর’ (জঙ্গল ব্যবহারের অধিকার), ‘জলকর’ (নদীর জল ব্যবহারের অধিকার) প্রভৃতির বন্দোবস্ত করেন।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর দ্বারা হিন্দুদের ইজারাদার পদে নিয়োগ

বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ইজারাদার হিসেবে হিন্দুদেরই বেশি পছন্দ করতেন এবং তাঁদেরই অধিক সংখ্যায় নিযুক্ত করতেন।কারণ, হিন্দু জমিদাররা নিয়মিত কর প্রদান করতেন এবং তাঁরা ছিলেন নম্র, ভীত ওকর্তব্যপরায়ণ।

মুর্শিদকুলি খাঁর অপছন্দ মুসলিম জমিদার

অন্যদিকে মুসলিম জমিদার বা ইজারাদাররা কর্তব্য কর্মে যথেষ্ট অবহেলা দেখাতেন এবং তাঁদের সঙ্গে মোগল রাজকর্মচারীদের ঘনিষ্ঠতার কারণে মুর্শিদকুলির পক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে সর্বদা ব্যবস্থা-গ্রহণ সম্ভব হত না।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর জমি জরিপ ব্যবস্থা

তিনি রাজ্যের সকল জমি জরিপ করে জমির উৎপাদিকা শক্তি ও কৃষকের কর প্রদানের ক্ষমতা বিবেচনা করে ভূমিরাজস্বের পরিমাণ স্থির করতেন।

মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে সলিমউল্লাহের অভিমত

ঐতিহাসিক সলিম উল্লাহ বলেন যে, মুর্শিদকুলির আমলে ব্যাপক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জমি জরিপ করা হয়।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে আব্দুল করিমের অভিমত

  • (১) জমি জরিপের ব্যাপারে ডঃ আবদুল করিম ভিন্ন মত পোষণ করেন। গোলাম হোসেন-এর রচনার ওপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, এই সময় সব জমি জরিপ করা হয় নি।
  • (২) কেবলমাত্র যে সব জমিদার রাজস্ব প্রদানে গাফিলতি করতেন, তাঁদের জমি ইজারাদারদের মধ্যে পুনর্বণ্টনের সময় জরিপের প্রয়োজন হয়।
  • (৩) নিয়মিত  রাজস্ব-প্রদানকারী ও অনুগত জমিদারদের জমি জরিপ করা হয় নি। এছাড়া, মোগল আমলের পূর্ব থেকে জমিদারির স্বত্ব ভোগকারি ‘পেশকাশি’ জমিদারদের জমিও জরিপহয় নি।
  • (৪) ডঃ করিম বলেন যে, কিছুটা জরিপের ভিত্তিতে, কিছুটা পুরোনো নথিপত্রের সাহায্যে মুর্শিদকুলি অনেকটাই নিখুঁতভাবে জমির পরিমাণ স্থির করার চেষ্টা করেন।

মুর্শিদকুলি খাঁর রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা

  • (১) মুর্শিদকুলি খাঁ অতি কঠোরভাবে রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ জমিদারদের কাছারি বা দেওয়ানখানায় বন্দি করে রাখতেন এবং তাঁদের কোনও আহার ও পানীয় দেওয়া হত না।
  • (২) অনেকের পায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হত, অনেককে মল-মূত্র পূর্ণ গহ্বরে ফেলে বৈকুণ্ঠ স্নান করানো হত, আবার অনেককে স্ত্রী-পুত্র সহ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হত।
  • (৩) সলিমউল্লাহ-র মতে, এই শাস্তি ছিল ‘বর্বরতার নামান্তর। এই প্রসঙ্গে বলা উচিত যে, কর্মচারীদের মধ্যে কেউ বেশি রাজস্ব দাবি করলে তিনি তা বরদাস্ত করতেন না।
  • (৪) রাজস্ব আদায়ে মুর্শিদকুলির অত্যাচার নিয়েও ডঃ আবদুল করিম আপত্তি করেছেন। বলা হয় যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করলেও তিনি নির্দয় বা অমানবিক ছিলেন না।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ‘তকাভি’ ঋণ দান

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শস্যহানি হলে রাজস্ব ছাড়ের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া, প্রজার বিপদে ‘তকাভি’ নামক ঋণেরও ব্যবস্থা ছিল।

মুর্শিদকুলি খাঁর প্রশাসনিক বিভাজন

রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি কয়েকটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই ভাগগুলি হল –

  • (১) সমগ্র দেশকে তিনি ১৩ টি চাকলা’ বা বিভাগে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক ‘চাকলা’-র দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন ‘আমিল -এর হাতে।
  • (২) প্রশাসনিক সুবিধার জন্য তিনি বড় জমিদারি গঠনে উৎসাহ দিতেন। তাঁর আমলে বাংলায় ৬টি এবং বিহারে ৩টি বড় জমিদারি গড়ে ওঠে। বড় বড় জমিদারি গঠনের ফলে রাজস্ব আদায়ে অনেক সুবিধা হয়।
  • (৩) বড় জমিদারির পাশাপাশি তাঁর আমলে অসংখ্য ছোট জমিদারিও টিকে ছিল।

নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ফলাফল

মুর্শিদকুলি খাঁ-র ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বাংলার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই ব্যবস্থার ফলে নবাব সরকার, জমিদার, প্রজা – সবারই মঙ্গল হয়।

(ক) সরকারের ক্ষেত্রে মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব

  • (১) সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং আয় সুনির্দিষ্ট হয়। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা-র আমলে রাজস্বের যে পরিমাণ ছিল, মুর্শিদকুলি তার ওপর সাড়ে তেরো শতাংশ হারে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন।
  • (২) এই যুগে ভূমিরাজস্বের হার ছিল খুবই কম। তা সত্ত্বেও এই বর্ধিত আয়ের জন্য দায়ী ছিল কৃষি ও বাণিজ্যের প্রসার। এছাড়া, নানা প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় হ্রাস এবং দুর্নীতি বন্ধ করে তিনি সরকারি আয় বৃদ্ধি করেন।
  • (৩) সরকারি আয় সুনির্দিষ্ট হওয়ায় সরকারের যথেষ্ট সুবিধা হয়। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের জন্য তিনি নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জলপথ ও স্থলপথে চোর ডাকাতের উপদ্রব বন্ধের জন্যও নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

(খ) জমিদারদের ক্ষেত্রে মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব

স্যার যদুনাথ সরকারের মতে মুর্শিদকুলি খাঁ-র ব্যবস্থার ফলে প্রাচীন জমিদার পরিবারগুলি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাংলার জমিদারি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।

ডঃ নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ ও ডঃ আবদুল করিম এই ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন যে, জমিদারি ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পরিবর্তে তিনি তা আরও শক্তিশালী করে তোলেন।

(গ) হিন্দুসমাজের উপর মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রভাব

পূর্বে সুবাদাররা দিল্লি ও আগ্রার মুসলিমদের এনে বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। মুর্শিদকুলি সর্বপ্রথম ঐ সব গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের নিয়োগ করে বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন।

(ঘ) সাধারণ মানুষের কাছে মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব

বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনও এই ব্যবস্থার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। যেমন –

  • (১) স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, এতদিন দিল্লি থেকে আগত দুই জোঁক—সুবাদার ও দেওয়ানের দ্বারা বাংলা শোষিত হত, কিন্তু মুর্শিদকুলি খাঁ একই সঙ্গে দেওয়ান ও সুবাদার হওয়ায় বাংলার মানুষ এই দ্বৈত শোষণ থেকে রক্ষা পায়।
  • (২) এই সময় চালের দাম ছিল খুবই সস্তা – টাকায় চার থেকে পাঁচ মন – তা সত্ত্বেও প্রজার জীবনে শান্তি ছিল না, অভাব ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী।
  • (৩) মুর্শিদকুলি নিয়মমাফিক রূপার মুদ্রায় দিল্লিতে এক কোটি টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। এর ফলে বাংলায় গুরুতর অর্থ-ঘাটতি দেখা দেয়।

(ঙ) কৃষকদের উপর মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব

  • (১) বাংলায় তখন সাধারণ কেনাকাটা চলত কড়ি দিয়ে, কিন্তু চাষিকে রাজস্ব মেটাতে হত রৌপ্যমুদ্রায়। এর ফলে দরিদ্র চাষি নামমাত্র মূল্যে মহাজনের কাছে ফসল বিক্রি করে রৌপ্যমুদ্রা সংগ্রহ করত। তাই অভাব ও অন্নাভাব ছিল দরিদ্র কৃষকেরনিত্যসঙ্গী।
  • (২) কবি ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে যে ‘ভিখারি শিবের’ বর্ণনা দিয়েছেন তা আসলে বাংলার অন্নহীন কৃষকের নিপীড়িত আত্মা।

উপসংহার :- অসুবিধা সত্ত্বেও বলতে হয় যে, কৃষি ও কৃষকের উন্নতির দিকে মুর্শিদকুলির দৃষ্টি ছিল। জমির উৎপাদিকা শক্তি দেখে ও জমি জরিপ করে তিনি রাজস্ব নির্ধারণ করতেন, অত্যাচারী কর্মচারীদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতেন, প্রয়োজনে কৃষি-ঋণ দিতেন এবং সর্বোপরি তিনি প্রজাদের মনে একটি নিরাপত্তাবোধ সঞ্চার করতে সক্ষম হন।

(FAQ) মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব কে ছিলেন?

মুর্শিদকুলি খাঁ।

২. বাংলায় প্রচলিত মুর্শিদকুলি খাঁ-র ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা কি নামে পরিচিত?

মালজামিনি ব্যবস্থা।

৩. মুর্শিদকুলি খাঁ ইজারাদার হিসেবে কাদের বেশি পছন্দ করতেন?

হিন্দুদের।

Leave a Comment