শিবাজির সাথে মুঘলদের সংঘাত

শিবাজির সাথে মুঘলদের সংঘাত প্রসঙ্গে শায়েস্তা খাঁর অভিযান, শায়েস্তা খাঁর পরাজয়, শায়েস্তা খাঁর বদলি, জয়সিংহ ও দিলির খাঁর বাহিনী, জয়সিংহের রণপরিকল্পনা, শিবাজীর আত্মসমর্পণ, পুরন্দরের সন্ধি, স্থায়ী শত্রুতা, শিবাজীকে বন্দী, শিবাজীর পলায়ন, শিবাজী-মুঘল সন্ধি, শিবাজীর অপমান, শিবাজীর মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ, শিবাজীর অভিষেক, নৌবহর গঠন, আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি সম্পর্কে জানবো।

শিবাজির সাথে মুঘলদের সংঘাত

ঐতিহাসিক ঘটনাশিবাজি-মুঘল সংঘাত
সময়কাল১৬৬০-১৬৮০ খ্রি
মারাঠা নেতাশিবাজি
মুঘল সম্রাটঔরঙ্গজেব
পুরন্দরের সন্ধি১৬৬৫ খ্রি
শিবাজির সাথে মুঘলদের সংঘাত

ভূমিকা :- শিবাজীর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও রাজ্য জয়ের কথা দিল্লীতে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কানে পৌঁছায়। এই সময় ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান হয়।

শিবাজির বিরুদ্ধে শায়েস্তা খাঁর অভিযান

  • (১) ঔরঙ্গজেব তার সিংহাসন নিষ্কণ্টক হলে তাঁর মাতুল শায়েস্তা খাঁকে দক্ষিণে শিবাজীকে দমনের জন্য ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে নিয়োগ করেন। শায়েস্তা খাঁ ছিলেন চতুর এবং অভিজ্ঞ প্রশাসক ও সেনাপতি। শায়েস্তা খাঁ মারাঠাদের বিভিন্ন স্থান থেকে বিতাড়িত করে মুঘল থানা বসিয়ে দেন এবং পুণায় তাঁর প্রধান শিবির বসান।
  • (২) তিনি মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বারা শিবাজী অধিকৃত গ্রামগুলি ছারখার করতে থাকেন। রাজপুত রাজা যশোবন্ত সিংহ ১০ হাজার রাজপুত সেনাসহ শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে যোগ দিলে শিবাজীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়। মারাঠারা বাধ্য হয়ে পুণা থেকে পিছিয়ে যায়।

শিবাজির নিকট শায়েস্তা খাঁর পরাজয়

  • (১) সুশৃঙ্খল, সুসজ্জিত মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব একথা চতুর শিবাজী বুঝতে পারেন। শিবাজী মুঘল সেনার মনোবল নষ্ট করার পরিকল্পনা করেন। শিবাজী রাত্রের অন্ধকারে একদল সাহসী সেনা নিয়ে শায়েস্তা খাঁর শিবিরে হানা দেন।
  • (২) শিবাজীর অতর্কিত আক্রমণে বাধা দিতে গিয়ে শায়েস্তা খাঁর হাতের একটি আঙুল কাটা পড়ে, তাঁর পুত্র আবুল ফৎ নিহত হন। শায়েস্তা খাঁর এই পরাজয়ে মুঘল সেনার মনোবল নষ্ট হয়।

ঔরঙ্গজেব কর্তৃক শায়েস্তা খাঁর বদলি

সম্রাট ঔরঙ্গজেব বিরক্ত হয়ে শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবাদার পদে বদলী করেন এবং যুবরাজ মুয়াজ্জমকে দক্ষিণের সুবাদার পদে নিয়োগ করেন।

শিবাজীর সুরাট বন্দর লুঠ

শিবাজী সুরাট বন্দর লুঠ করে ১ কোটি টাকা পান। সুরাটের বিখ্যাত ইসমাইলী বণিক বারজী ভোরার যথা সর্বস্ব তিনি লুঠ করেন। শিবাজীর নৌবহর ভারত থেকে মক্কা গামী জাহাজ লুঠ করে।

শিবাজির বিরুদ্ধে জয়সিংহ ও দিলির খাঁর বাহিনী

এরপর ঔরঙ্গজেব তাঁর বিখ্যাত রাজপুত সেনাপতি জয়সিংহকে দক্ষিণে সহ সুবেদার নিয়োগ করেন। সেনাপতি জয়সিংহ ছিলেন অত্যন্ত চতুর, সাহসী ও রণদক্ষ সেনাপতি। ঔরঙ্গজেব অপর এক বিখ্যাত সেনাপতি দিলীর খাঁকে জয়সিংহের সাহায্যে পাঠালে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি পায়।

মারাঠা নায়ক শিবাজির বিরুদ্ধে জয়সিংহের রণ পরিকল্পনা

  • (১) জয়সিংহ খুব মাথা খাটিয়ে শিবাজীর বিরুদ্ধে রণ-পরিকল্পনা তৈরি করেন। তিনি কূটনীতির দ্বারা বিজাপুরকে শিরাজীর পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। তিনি জায়গীর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কোনো কোনো মারাঠা সর্দারকে নিজ পক্ষে আনেন।
  • (২) জাঞ্জিবার সিদ্দি ও ইউরোপীয় বণিকদের তিনি মুঘলের পক্ষভুক্ত করে শিবাজীর পালাবার পথ বন্ধ করে দেন। তিনি আফজল খাঁর পুত্র ফজল খাঁকেও মুঘলের পক্ষভুক্ত করেন। তিনি বর্ষা সমাগমের আগেই শিবাজীকে পরাভূত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার ব্যবস্থা করেন।
  • (৩) মহারাষ্ট্রের হৃদপিণ্ড পুণায় তিনি শিবাজীকে ঘিরে ফেলে তাঁকে পরাজিত করার পরিকল্পনা করেন। তিনি বাদশাহের সম্মতিক্রমে সেনা পরিচালনা ও রণপরিকল্পনার সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নেন। অপর সেনাপতিদের তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করেন।

শিবাজীর আত্মসমর্পণ

এর পর জয়সিংহ শিবাজীকে পুরন্দর দুর্গে অবরোধ করে ফেলেন এবং বাইরে থেকে এই দুর্গে সাহায্য আসার সকল পথ বন্ধ করেন। মুঘল কামান দুর্গের ওপর অবিশ্রান্ত তোপ দেগে দুর্গের দেওয়াল ভেঙে ফেললে শিবাজী বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করেন।

মোঘলদের সাথে শিবাজির পুরন্দরের সন্ধি

১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে পুরন্দরের সন্ধির দ্বারা মুঘলের সহিত শিবাজীর শান্তি স্থাপিত হয়। এই সন্ধির অনুযায়ী,

  • (১) শিবাজী মুঘল সম্রাটকে ২৩টি দুর্গ ও বার্ষিক ২০ লক্ষ টাকা রাজস্বের জায়গা ছেড়ে দেন।
  • (২) শিবাজীর হাতে থাকে ১২টি দুর্গ ও ৫ লক্ষ টাকা আয়ের ভূমিখণ্ড।
  • (৩) শিবাজী বাদশাহের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন। তাঁর পুত্র শম্ভুজী মুঘল দরবারে ৫ হাজারী মনসবদারের পদে নিযুক্ত হবেন বলা হয়।
  • (৪) বিজাপুরের বিরুদ্ধে মুঘলের আসন্ন যুদ্ধে শিবাজী মুঘলকে সাহায্য করতে অঙ্গীকার করেন।
  • (৫) একটি গোপন শর্তে স্থির হয় যে, যদি শিবাজী বিজাপুরের অধীন পায়েনঘাট ও বালাঘাট আসন্ন মুঘল-বিজাপুর যুদ্ধে দখল করেন এবং যদি সম্রাট তাঁকে এই অঞ্চল দিতে সম্মতি দেন, তবে তিনি সম্রাটকে এজন্য দুই কোটি টাকা দিবেন।

মোঘলদের সাথে শিবাজির স্থায়ী শত্রুতা

পুরন্দরের সন্ধির শেষের দুই শর্তের দ্বারা কূটবুদ্ধি জয় সিংহ, শিবাজী ও বিজাপুর সুলতানের মধ্যে স্থায়ী শত্রুতা সৃষ্টি করেন।

শিবাজীকে বন্দী

  • (১) জয় সিংহের পরামর্শে শিবাজী মুঘল রাজধানী আগ্রায় যান এবং ঔরঙ্গজেবের দরবারে পুত্র শম্ভুজী সহ উপস্থিত হন। জয় সিংহ শিবাজীকে সম্মানজনক শর্ত দ্বারা তাঁর সঙ্গে আপোষ করার জন্য সমুচিত পরামর্শ দেন।
  • (২) ঔরঙ্গজেব এই পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। দরবারে ঔরঙ্গজেব তাকে ৫ হাজারী মনসবদারের সারিতে দাঁড়াতে আদেশ দিলে, শিবাজী অপমানিত বোধ করে প্রতিবাদ করেন। সম্রাটের আদেশে জয়পুর ভবনে তাকে ও শম্ভুজীকে নজরবন্দী করা হয়।

মারাঠা নেতা শিবাজীর পলায়ন

মীর বকসী আমিন খান প্রচুর উপঢৌকন পেয়ে শিবাজীর পাহারা শিথিল করেন। জয় সিংহের পুত্র রাম সিংহ শিবাজীকে পালাতে সাহায্য করেন। শিবাজী কৌশলে রক্ষীদের নজর এড়িয়ে আগ্রা থেকে পুত্রসহ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে দক্ষিণে পালিয়ে আসেন।

শিবাজী-মুঘল সন্ধি

ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রাথমিক ক্রোধ ত্যাগ করে শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযান না পাঠিয়ে নিরস্ত থাকেন। উত্তর-পশ্চিমে ইউসুফজাই বিদ্রোহের জন্য সম্রাট শিবাজীর দিকে মন দিতে পারেন নি। রায়গড়ে ফিরে আসার পর শিবাজী ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। উভয় পক্ষে কিছুকাল শান্তি অব্যাহত থাকে।

পুরন্দরের সন্ধি ভঙ্গ

পুরন্দরের সন্ধি শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। এই সন্ধি ভেঙে পড়ার কারণ ছিল যে, শিবাজী এই সন্ধিকে মুঘলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের স্থায়ী সমাধান মনে করতেন না। ঔরঙ্গজেবও এই সন্ধিকে আপাতত যুদ্ধ বিরতির ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু মনে করতেন না।

শিবাজীর অপমান

মারাঠা নায়ক শিবাজীর আগ্রা যাত্রার সময় জয় সিংহ শিবাজীকে মুঘল কোষাগার থেকে ১ লক্ষ টাকা দেন। এখন মুঘল রাজস্ব কর্মচারী শম্ভুজীর জায়গীর থেকে সেই ১ লক্ষ টাকা কেটে নিলে শিবাজী অপমানিত জ্ঞান করেন।

শিবাজীর মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ

তিন বছর শান্তি রক্ষার পর ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী পুনরায় মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ ও লুঠপাট আরম্ভ করেন। তিনি একে একে পুরন্দর, কল্যাণ, সিংহগড় প্রভৃতি দুর্গগুলি মুঘলের হাত থেকে উদ্ধার করেন। জিঞ্জি, ভেলোর, কর্ণাটকের কিছু অংশ তিনি অধিকার করেন। ১৬৭০ খ্রীঃ শিবাজী দ্বিতীয় বার সুরাট বন্দর লুঠ করেন।

শিবাজীর অভিষেক

১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজীর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন হয়। রায়গড়ে তিনি ‘ছত্রপতি’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।

শিবাজির নৌবহর গঠন

তিনি মহারাষ্ট্রের সমুদ্র উপকূল নিজ অধিকারে রাখার জন্য পোন্ডা ও কারবার অধিকার করেন এবং জাঞ্জিরার আরব বণিক সিদ্দিদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। এজন্য তিনি একটি নৌবহর গঠন করেন।

শিবাজির আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি

১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডার হিন্দু মন্ত্রী মদন্নার উদ্যোগে শিবাজী গোলকুন্ডার সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ হন। তিনি জিঞ্জি, ভেলোর, কর্ণাটকের ও মহীশূরের এক বিরাট অঞ্চল দখল করেন। এর ফলে তাঁর আর্থিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার :- এইভাবে রাজ্য বিস্তারে কাজে লিপ্ত থাকার সময় ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল বিখ্যাত মারাঠা নেতা শিবাজী মৃত্যুবরণ করেন।

(FAQ) শিবাজির সাথে মুঘলদের সংঘাত সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শিবাজীর সময়কালে মুঘল সম্রাট কে ছিলেন?

ঔরঙ্গজেব।

২. পুরন্দরের সন্ধি কখন হয়?

১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে।

৩. শিবাজীর অভিষেক হয়?

১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রায়গড় দুর্গে।

৪. শিবাজীর মৃত্যু কখন হয়?

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment