মতিলাল শীল

একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসংস্কারক, ব্যবসায়ী এবং দানশীল ব্যক্তি ছিলেন মতিলাল শীল (১৮০০-১৮৫৪)। তিনি কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। মতিলাল শীল বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন এবং সমাজের বিভিন্ন প্রগতিশীল কার্যক্রমে অবদান রাখেন। তাঁর দানশীলতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয়।

বিখ্যাত ব্যবসায়ী মতিলাল শীল

ঐতিহাসিক চরিত্রমতিলাল শীল
জন্ম ১৭৯২ খ্রি
জন্মস্থানকলকাতা, ব্রিটিশ ভারত
পেশাব্যবসায়ী, সমাজসংস্কারক
অবদানসমাজ সংস্কার, দানশীলতা, শিক্ষার প্রসার
উল্লেখযোগ্য কাজসমাজ সংস্কারে অর্থায়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান
বিশেষ পরিচিতিবিধবা বিবাহ প্রচারক
মৃত্যু১৮৫৪ খ্রি

মতিলাল শীল

ভূমিকা :- উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে বাংলার সমাজসংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ-এর অভ্যুদয় ঘটেছিল তার মূল প্রেরণা ছিল প্রধানতঃ সর্বতোমুখী সংস্কারচিন্তা। অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলা তথা ভারতের গণমানসে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী আধুনিক চিন্তা ও মননের আলোকপাত ঘটিয়েছিলেন যে সকল মুক্তবুদ্ধি জাতীয়তাবাদী মনীষী তাঁদের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও দীপ্তিমান ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী কিছু ব্যক্তিত্ব। এঁদের মধ্যে কর্মবীর মতিলাল শীল অন্যতম। বাঙালীর ইতিহাসে তাঁর কীর্তিকথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।

জনদরদী মতিলাল শীলের জন্ম

প্রাচীন কলকাতার উত্তরাঞ্চলে কলুটোলা পল্লীতে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে অতি সাধারণ এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম হয়েছিল মতিলালের। তাঁর পিতা চৈতন্যচরণ শীল ছিলেন সামান্য কাপড়ের ব্যবসায়ী। প্রতিদিনের সংসারিক ব্যয় নির্বাহ করে যৎসামান্য অর্থই তিনি সঞ্চয় করতে পারতেন।

মতিলাল শীলের ছেলেবেলা

মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃহারা হয়েছিলেন মতিলাল। আত্মীয়স্বজনদের প্রতারণার ফলে কেবল বসত ভিটেটুকু ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছুই পাননি তিনি। সেটুকু আঁকড়ে ধরেই কঠিন বাস্তবের সঙ্গে লড়াই শুরু হয় মতিলালের।

বিখ্যাত ব্যবসায়ী মতিলাল শীলের শিক্ষা

  • (১) সৌভাগ্যবশতঃ দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বাবু বীরচাঁদ শীল সেই সময়ে পিতৃহারা বালকের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁরই উৎসাহে ও চেষ্টায় পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। বাংলা আর অঙ্কের প্রাথমিক শিক্ষাটুক সেখানেই হয়েছিল।
  • (২) সেইকালের কলকাতায় সাধারণ পরিবারের শিশুদের শিক্ষালাভের বিশেষ সুযোগ সুবিধা ছিল না। অলিতে গলিতে আঙুলে গোনা দু-চারটে পাঠশালাই ছিল সম্বল। আর ছিল গুটিকয় ইংরাজি স্কুল। ইংরাজদের পরিচালিত সেই সব স্কুলে বাঙালি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরাই পড়তে পারত। অনেক বাড়িতে ছেলেদের জন্য ইংরাজ গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হত। তাঁরাই তাদের ইংরাজি ও বিলাতি চালচলনে দূরস্ত করে তুলতেন।
  • (৩) পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার পরে মতিলাল মার্টিন বোল নামে এক ইংরাজের ইংরাজি স্কুলে কিছুদিন পড়েন। তারপর তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় কলুটোলার মদন মাষ্টারের স্কুলে। এখানে ইংরাজি শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও ছিল। এই মদন মাষ্টারের স্কুলের পড়াশুনাটুকুই ছিল মতিলালের জীবনের একমাত্র সম্বল। পিতৃহীন দরিদ্র বালকের পক্ষে পড়াশুনায় এর বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না।

মতিলাল শীলের বিবাহ

অভিভাবক বাবু বীরচাঁদ শীলের উদ্যোগে কিশোর বয়সেই বিয়ে হয় মতিলালের। বিয়ের পর থেকেই তাঁর জীবনে সৌভাগ্যের উদয় হয়। ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নতির পথ খুঁজে পান তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরে শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে মতিলালকে তীর্থ ভ্রমণে যেতে হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে নানা তীর্থ পর্যটনের কালে বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় তাঁব। তার ফলে লোকচরিত্র ও লোকব্যবহার সম্পর্কে সম্যক অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি।

ব্যবসা শুরু করেন মতিলাল শীল

ফোর্ট উইলিয়ামে সামরিক অফিসারদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের মধ্য দিয়ে প্রথম অর্থোপার্জন শুরু করেন মতিলাল। সেই সঙ্গে খালি শিশি বোতল ও কর্কের ব্যবসায় শুরু করেন। এই ভাবে ভালই অর্থাগম হতে থাকে তাঁর। এসব কাজের মধ্যে দুই বছর বালিখালের চেক পোস্টে কাস্টমস দারোগা হিসেবেও কাজ করেন। ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হিসাবে সহজাত ব্যবসায় বুদ্ধি লাভ করেছিলেন তিনি। তার ফলে ব্যবসাক্ষেত্রে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে।

স্মিথসন সাহেবের বেনিয়ান মতিলাল শীল

ব্যবসার প্রয়োজনে অল্পদিনের মধ্যেই ইউরোপীয় বণিকসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। সেই সূত্রেই ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্মিথসন সাহেবের বেনিয়ান নিযুক্ত হন। কর্মতৎপরতা গুণে অল্পদিনের মধ্যেই আরও সাত আটটি ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর বেনিয়ানের দায়িত্ব তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। স্বক্ষেত্রে সেই সময় এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি যে, বিলাতের জাহাজী নাবিকরাও তাঁর মাধ্যমে জাহাজের মালপত্র কিনে নিশ্চিন্ত হত।

আমদানী রপ্তানীর ব্যবসায়ে লিপ্ত মতিলাল শীল

ক্রমে আমদানী রপ্তানীর ব্যবসায়ে লিপ্ত হন মতিলাল। ইউরোপ-এর বিভিন্ন দেশে এদেশের বিভিন্ন মাল পাঠাতেন তিনি। প্রধানতঃ দেশীয় রেশম, নীল, সোরা এবং চাল রপ্তানীর বদলে তিনি আমদানী করতেন বিদেশের কাপড় এবং লৌহজাত দ্রব্যাদি। প্রখর ব্যবসায় বুদ্ধি বলে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এই ব্যবসায়ে প্রভৃত অর্থ উপার্জন করেন। সফল বাঙালী ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রমে কলকাতার বণিকসমাজেরও মধ্যমনি হয়ে ওঠেন তিনি। মতিলালের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে বাবসায়ী হিসেবে বাঙালীর দক্ষতা ও প্রতিপত্তি নতুন মাত্রা পেল। অর্থোপার্জনের জন্য কখনও অসৎ পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করেন নি মতিলাল। সততাই ছিল তাঁর প্রধান মূলধন। সেই সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যবসায়ীসুলভ ঝুঁকি নেবার সাহস ও বিচক্ষণতা।

ডসনের কোম্পানি বন্ধ

  • (১) একবার, ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে হেনরী ডসন অ্যান্ড বেসটেল কোম্পানির অংশীদার মিঃ ডসন তাঁদের দুটি জাহাজ নব্বই হাজার টাকার বিনিময়ে মতিলালের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। জাহাজ দুটি মরিশাস ও রেঙ্গুন যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল।
  • (২) দুর্ভাগ্যক্রমে মি ডসন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেন। শর্ত অনুয়ায়ী মতিলাল জাহাজ দুটি ক্রয় করে নিলেন। মিঃ ডসন জাতে ইংরাজ। স্বভাবতঃই ইংরাজ শাসনাধীন ভারতে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তিরও অধিকারী।
  • (৩) মতিলালকে প্রভাবিত করার জন্য তিনি যথেষ্ট অনুনয় বিনয় শেষে হুমকি প্রদর্শন করতেও ছাড়লেন না। কিন্তু সাহসী মতিলাল কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেন নি। শেষ পর্যন্ত স্পর্ধিত ইংরাজ বণিক তাঁর কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। মতিলালের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দিকে ডসনের কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়।

মতিলাল শীলের দ্বারস্থ বিভিন্ন ব্যবসায়ী

এই সময়ে মতিলালের খ্যাতি প্রতিপত্তি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে প্রয়োজনে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ব্যবসায়ীরাও সাহায্যের জন্য তাঁর দারস্থ হতেন। বিদেশে মাল রপ্তানির ক্ষেত্রে যে কোনো জটিলতার সমাধান মতিলাল করতে সক্ষম ছিলেন।

রাধাকিষণ কোম্পানির সঙ্গে মতিলালের সম্পর্ক

  • (১) ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ একবার মথুরার লছমিচাঁদ রাধাকিষণ কোম্পানির মালিক দশ লক্ষ টাকার আফিম খরিদ করেন। কিন্তু যথাসময়ে উপযুক্ত সরকারি শুল্ক দিতে না পারায় সঙ্কটে পড়েন এবং মতিলালের শরণ নেন।
  • (২) সরকারি মহলে প্রভাব খাটিয়ে মতিলাল তাঁকে লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা করেন। কেবল তাই নয়, বাজেয়াপ্ত মালের পাওনা টাকা যাতে সরকারের কাছ থেকে ভদ্রলোক পেতে পারেন তার প্রতিশ্রুতিও আদায় করে দেন।
  • (৩) এই দুর্ঘটনার পরে কোম্পানিটির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। মতিলাল নামমাত্র সুদে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা ধার দিয়ে সেই যাত্রায় কোম্পানিটিকে রক্ষা করেন।
  • (৪) এই ভাবেই প্রথম লছমিচাঁদ রাধাকিষণ কোম্পানির সঙ্গে মতিলালের সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। পরে তাদের আমদানি রপ্তানির ব্যবসায়ের সমস্ত অধিকার তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করে।
  • (৫) এই কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করার সুফল ফলতেও বিলম্ব হল না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে তারা বড় বড় অর্ডার পেতে লাগলেন। অল্পদিনের মধ্যেই কোম্পানির অবস্থা ঘুরে গেল।

মতিলাল শীলের প্রচুর অর্থাগম

নানান কোম্পানির বেনিয়ান হিসাবে প্রচুর অর্থাগম হত মতিলালের। তিনি তার একটা বড় অংশ নিজের ব্যবসায় পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ করতেন। নানা ধরনের ব্যবসায় পুঁজি খাটিয়ে অর্থসম্পদ বৃদ্ধি করার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা ছিল তাঁর সহজাত। তাই একটার পর একটা ব্যবসায় তিনি বাড়িয়ে গেছেন অবলীলায় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য ছিল তাঁর করায়ত্ত।

জাহাজী ব্যবসায়ী মতিলাল শীল

  • (১) এরপর জাহাজী ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে তিনি বিদেশীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলেন। চিন ও ইউরোপের বিভিন্ন লাইনে মতিলালের জাহাজ চলাচল শুরু করল। সেই সময় ছোট বড় মিলিয়ে মোট তেরোটি জাহাজের মালিক হয়েছিলেন তিনি। অন্তর্দেশীয় জাহাজী ব্যবসায় তিনিই প্রথম বাষ্পীয়পোত ব্যবহার করেন।
  • (২) কলাকাতা বন্দরে যে সকল মালবাহী জাহাজ আসত, সেগুলিকে বঙ্গোপসাগরের মুখ থেকে হুগলী নদীতে নিয়ে আসা এবং পুনরায় সাগরের মুখে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করার জন্য মতিলাল টাগবোট বা টানা জাহাজ নামিয়েছিলেন। নব্বই অশ্বশক্তির এই জাহাজটির নাম ছিল বেনিয়ান।
  • (৩) কলকাতা বন্দরে টাগবোটের প্রচলন তিনিই প্রথম করেছিলেন। তাঁর কর্মকুশলতায় সেইকালে ইংরাজরাও বিস্ময় মেনেছিল। প্রতিপত্তি ও খ্যাতির দিক থেকে তিনি রুস্তমজী কাওয়াসজী ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন।

চায়ের ব্যবসা শুরু করেন মতিলাল শীল

  • (১) এরপর আসামের পাহাড়ি এলাকা থেকে সংগৃহীত চায়ের ব্যবসাতে নামলেন মতিলাল। তাঁর চেষ্টায় বিখ্যাত আসাম কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ আরম্ভ হল। ইতিপূর্বেই দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কার-টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন পরিচালিত হত তাদেরই তত্ত্বাবধানে।
  • (২) অতঃপর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হাজি ইস্পাহানি, রুস্তমজি কাওয়াসজি এবং মতিলালের সহযোগিতায় উক্ত দুটি কোম্পানি মিশে গিয়ে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে গঠিত হল আসাম কোম্পানি। এই কোম্পানির সমান সংখ্যক শেয়ারভোগী ছিলেন দ্বারকানাথ ও মতিলাল।

মতিলাল শীলের বন্ধকীর কারবার

জাহাজ ও চায়ের ব্যবসার পাশাপাশি বন্ধকীর কারবারেও অর্থ লগ্নি করতেন মতিলাল। এই কারবারে প্রচুর অর্থ উপার্জন হত তাঁর। এই সূত্রে বহু বড় বড় বিখ্যাত সম্পত্তি বাঁধা পড়ত তাঁর কাছে। ঝুঁকির ব্যবসাতে কখনও পিছপা হতেন না মতিলাল। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই হিসাব বানচাল হয়ে যেত। অনেকবারই লোকসানের কড়ি গুণতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু অর্থাগমের তুলনায় গুণাগারের পরিমাণ কখনোই বড় হতে পারে নি বলে উপার্জনের ঢল অব্যাহতই ছিল।

ভারতীয় বণিক সমাজের শীর্ষস্থানে মতিলাল শীল

সামান্য এক মাল সরবরাহকারী কারবারি থেকে নিজেকে বঙ্গীয় তথা ভারতীয় বণিক সমাজের শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন মতিলাল। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রভূত অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি।

বাবু সমাজের বিশৃঙ্খলায় মতিলাল শীলের উত্থান

  • (১) সেই যুগের কলকাতা জুড়ে গড়ে উঠেছিল বাবু সমাজ। নানা উপায়ে হঠাৎ বড়লোক হওয়া বাবুরা মাইফেল মজলিশের ফুর্তিতে অকাতরে অর্থ অপচয় করতেন। টাকার গরমে নানান হাস্যকর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন এই বাবু সমাজ।
  • (২) অর্থের অপচয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার রেওয়াজই হয়ে উঠেছিল বাবু সমাজের কালচার। ব্যাঙের বিয়ে, বেড়ালের বিয়ে, বুলবুলির লড়াই, পায়রা ওড়ানো প্রভৃতি নানা উপলক্ষে অঢেল অর্থ ব্যয় করতেন নব্যবাবুরা। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তাঁরা।
  • (৩) সমাজের অপরাপর মানুষদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দেবার মতো মানসিকতা তাদের কারোরই ছিল না। ফলে একদিকে যেমন বাবু সমাজ অর্থের অপচয়ে উন্মত্ত থাকত, অপরদিকে সমাজের সাধারণ মানুষ দারিদ্য ও অশিক্ষার অন্ধকারে হাবুডুবু খেত।
  • (৪) দুরবস্থার সুযোগে সাহায্যের অছিলায় এই সমাজে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল বিদেশী মিশনারীরা। নানা প্রলোভন সামনে রেখে তারা এদেশীয় হিন্দুদের খ্রিস্টান করে নিত। এই রকম এক সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেই উত্থান ঘটেছিল মতিলালের।
  • (৫) ঐশ্বর্য প্রাচুর্যের অহঙ্কারে তিনি কিন্তু বাবুসমাজের বেহিসেবি স্রোতে গা ভাসান নি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্তই সাদাসিধা মানুষ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ এক কপর্দকও খরচ করতেন না।

শিক্ষা প্রসারের কাজে মতিলাল শীল

  • (১) সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ তিনি অকাতরে ব্যয় করেছেন সমাজের দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষের কল্যাণে। শহর কলকাতাকে সুন্দর রূপ দেবার জন্যও তাঁর চেষ্টা ও অর্থব্যয়ের কার্পণ্য ছিল না। পশ্চিমের উন্নত জাতিসমূহের সঙ্গে মেলামেশার ফলে মতিলাল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, দেশের ও সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি বিধানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষার উন্নতি।
  • (২) তাই তিনি সর্বপ্রথম উদ্যোগ নিলেন শিক্ষা প্রসারের কাজে। সেইকালে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল হাতে গোনা। ওয়ারেন হেস্টিংস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি মাদ্রাসা। আর এশিয়াটিক সোসাইটি ও ফোর্ট উইলিয়ামে চলত দুটি কলেজ।
  • (৩) সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছেলেদের লেখাপড়া শেখার জন্য কয়েকজন বিত্তবান মানুষের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল হিন্দু কলেজ। প্রথমে চিৎপুরে গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে মাত্র ২০ জন ছাত্র নিয়ে ছিল এই স্কুল। সময়ান্তরে এই স্কুলেরই নাম হয় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি।
  • (৪) মতিলাল উদ্যোগী হলেন কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে। হিন্দু কলেজের পরিকল্পনা নেওয়া হল এবং কলেজের কাজ চালু হল ফিরিঙ্গি কমল বোসের বাড়িতে। কলেজ চালানোর জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং গঙ্গানারায়ণ দাস প্রমুখ। তবে খরচখরচার অধিকাংশ দায়িত্বই বহন করেছিলেন মতিলাল।

মতিলাল শীলের প্রতিষ্ঠিত কলেজ

  • (১) এরপর ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল নিজের বাড়িতেই শীলস কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই কলেজে একসঙ্গে পাঁচশ ছাত্রের পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শীলস কলেজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়েছিলেন।
  • (২) এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট-এর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি স্যার লরেন্স পিল, অ্যাডভোকেট জেনারেল সহ বহু আইনজীবী, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিশিষ্ট রাজপ্রতিনিধি জর্জ টমসন এবং রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
  • (৩) শীলস কলেজে প্রথমে মাইনে নেওয়া হত এক টাকা। বিনিময়ে বিনামূল্যে ছাত্রদের দেওয়া হত বইপত্র, খাতা পেন্সিল। পরে এখানে পড়াশুনা সম্পূর্ণ অবৈতনিক হয়ে যায় এবং কলেজের নাম হয় শীলস ফ্রি কলেজ। স্কুল বিভাগের বাইরে ফ্রি কলেজ বিভাগও কিছুদিন পরে চালু হয়েছিল।
  • (৪) কিন্তু পরিচালনার ত্রুটির জন্য কলেজ বিভাগ বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব হয় নি। তবে মতিলালের অর্থে গঠিত ট্রাস্ট্রিফান্ড থেকেই স্কুল পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব পালিত হত।
  • (৫) অবিলম্বেই শীলস কলেজের জন্য তৎকালীন হ্যালিডে স্ট্রিটে একটি প্রকান্ড দোতলা বাড়ি তৈরি হল এবং যথাসময়ে স্কুল স্থানান্তরিত হল। প্রসঙ্গতঃ হ্যালিডে স্ট্রিটের নাম পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে সেন্ট্রাল এভেনিউ। যার বর্তমান নাম চিত্তরঞ্জন এভিনিউ।

শীলস কলেজে শিক্ষক নিয়োগ

  • (১) শীলস কলেজ পরিচালিত হত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের তত্ত্বাবধানে। এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল সাতজন জেসুইট পাদ্রীর সঙ্গে কয়েকজন দেশীয় শিক্ষক। সেইকালে শিক্ষক হিসাবে জেসুইট পাদ্রীদের খুব সুনাম ছিল।
  • (২) নিজের কলেজে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশ্য ছিল মতিলালের। কিন্তু এক বছরের মাথাতেই ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে এই ইহুদী পাদ্রী শিক্ষকদের নিয়ে খুবই ঝামেলায় পড়ে গেলেন তিনি। অভিযোগ উঠল, দুপুরে টিফিনের সময় জেসুইট পাদ্রীরা নিজেদের খাদ্য নিষিদ্ধ মাংস ও বিয়ার মাঝেমাঝে ছাত্রদেরও খেতে দেন।
  • (৩) তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে নিষিদ্ধ মাংস আহার করলে জাতিচ্যুত হতে হত। মতিলাল অবিলম্বে এই সমস্যার প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করলেন। তিনি টিফিনে ছাত্রদের জন্য বিনামূল্যে খাবার দেবার ব্যবস্থা করলেন।
  • (৪) কেবল তাই নয় জেসুইট পাদ্রীদের অপসারণ করার জন্য সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। স্কুলে নিয়োগ করলেন সাধারণ ইউরোপীয় ও এশীয়ান শিক্ষকদের।
  • (৫) মতিলালের প্রতিষ্ঠিত শীলস কলেজে দেশের ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের ছেলেরাই পড়ার সুযোগ পেত। হিন্দু কলেজের আদলেই নানা বিষয়ে এখানে শিক্ষা দেওয়া হত। অনাথ ও দরিদ্র ছাত্ররা বিনামূল্যে স্কুল বোর্ডিং-এ থাকা ও খাওয়ার সুবিধা পেত।

ব্যবসায়ী মতিলাল শীল প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ

মতিলালের সহযোগিতা ও অর্থ সাহায্যে স্থাপিত হল হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হিন্দু কলেজের একটি ঘটনায় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। ঘটনাটি হল, হীরা বুলবুল নামে এক বারবনিতার ছেলেকে ভর্তি করা হয়েছিল হিন্দু কলেজে। ফলে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় অভিভাবকদের মধ্যে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলেজ পরিচালন সমিতিতে যে সকল অভিজাত হিন্দু সদস্য পদত্যাগ করলেন তাঁরা নিজেদের পরিবারের ছেলেদের কলেজ ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন। তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য অনেক ছাত্রই সরে পড়ল। পরে সকলের সমবেত উদ্যোগে এবং মতিলালের অর্থ সাহায্যে গড়ে তোলা হল হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ। এখানেও দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশুনার যাবতীয় ব্যয় বহন করতেন মতিলাল। মতিলালের বদান্যতায় এভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্যরক্ষায় মতিলাল শীলের অবদান

  • (১) কলকাতার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মতিলাল নগরের নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারেও যত্নবান হন। সেইকালের কলকাতা বর্তমানের একটি বড় গ্রামের চাইতে খুব একটা বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর ছিল না।
  • (২) ঝোপজঙ্গল চারদিকে, রয়েছে খানাখন্দ ডোবা। সেই সঙ্গে শহর ঘিরে কাঁচা নর্দমা। মশা আর মাছির উৎপাত নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বলা চলে। ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া আর পেটের রোগ। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অকালে বহুলোক প্রাণ হারাত।
  • (৩) নেটিভদের আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা শহরে বিশেষ না থাকলেও ফোর্ট উইলিয়ামে শ্বেতাঙ্গ ফৌজের রোগেশোকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য কলকাতায় প্রথম হাসপাতাল প্রেসিডেন্সি জেনারেল হসপিটাল প্রতিষ্ঠিত হযেছিল।
  • (৪) এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারী অনুদান ছিল মাত্র দু’হাজার টাকা। অবশিষ্ট সমস্ত খরচ দেশীয় জমিদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই নেওয়া হয়। তবুও এই হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গরাই অগ্রাধিকার পেত। নেটিভরা বড় একটা সেখানে চিকিৎসার সুযোগ পেত না।
  • (৫) দেশের লোকের ভরসা বলতে ছিল দেশীয় কবিবাজ ও হেকিমি ওষুধ। এদের সঙ্গে ছিল কিছু নেটিভ ডাক্তার। দেশীয় যেসব চিকিৎসককে ইংরাজ ডাক্তাররা তালিম দিয়ে দিতেন তাদেরই বলা হত নেটিভ ডাক্তার। শহরে কয়েক জায়গায় এই নেটিভ ডাক্তাররা ডিসপেনসারিও খুলেছিল।
  • (৬) চিকিৎসাব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল মেডিকেল কলেজ। এখানে জ্বরজারির চিকিৎসার জন্য খোলা হয়েছিল কুড়ি বেডের ফিভার হসপিটাল।
  • (৭) ফিভার হসপিটাল খোলার জন্য মতিলাল শীলের অবদান ছিল বিপুল। বারো হাজার টাকা মূল্যের বিশাল জমি দিয়েছিলেন তিনি। দান করেছিলেন নগদ একলক্ষ টাকা। দেশীয় তরুণরা যাতে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ায় উৎসাহিত হয় সেজন্য তিনি ছাত্রদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন। মতিলাল শীলের অর্থ সাহায্যে প্রসূতিদের জন্য এই সময় একটি আলাদা হাসপাতালও খোলা হয়।

পত্রিকায় মতিলাল শীল সম্পর্কে লেখনী

ব্যবসায়ী মতিলাল শীলের বদান্যতা ও মহানুভবতার কথা সেইকালে লোকের মুখে মুখে ফিরত। বিখ্যাত সমাচার দর্পণ পত্রিকা ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারির সংখ্যায় লিখেছিল ” জমিদারেরা তাদের পিত্রাদিশ্রাদ্ধে এবং বিবাহাদি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে থাকেন। আর সাধারণ লোকের দুরবস্থার দিকে তাঁদের নজর পড়ে না। সেক্ষেত্রে মতিলাল শীলের মাহাত্ম্য এই পত্রিকার মারফৎ জনমণ্ডলীর মধ্যে প্রকাশ পাইবার যোগ্য হইয়াছে।”

মতিলাল শীলের ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে মতিলাল ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। কিন্তু ধর্মের গোঁড়ামি তাঁর ছিল না। ধর্মের নামে বাহ্যিক আড়ম্বর তিনি পছন্দ করতেন না। অযথা অপব্যয় বলেই মনে করতেন। তাঁর কাছে দেশহিতৈষণা ও লোকসেবাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হত। এই জন্য সামাজিক কুসংস্কার দূর করার ব্যাপারেও মতিলাল উদ্যোগী হয়েছিলেন।

মতিলাল শীল কর্তৃক অতিথিশালা নির্মাণ

দেশের নিরন্ন দরিদ্র দুঃখী মানুষের জন্য মতিলাল নিজে বেলঘরিয়া অঞ্চলে একটি অতিথিশালা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দেশের ধনবান মানুষরাও যাতে দরিদ্রের দুঃখ দূর করার কাজে সচেষ্ট হয় সেজন্য তাঁদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “জমিদারদের বলি, নিজেদের উপার্জনের সবকিছু বিসর্জন না দিয়ে কিছু অংশ যদি এই দুর্দশাগ্রস্ত গরিব চাষীদের সাহায্য করেন, যেমন তাঁদের দশটি গাড়ির একটি ও একজোড়া বলদ বিক্রি করে এদের সাহায্যে ব্যয় করেন তাহলে অন্তত কিছু ঘর চাষা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারে।”

ধর্ম সম্পর্কে মতিলাল শীলের বক্তব্য

ধর্মীয় ব্যাপারে যারা নানা আড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অর্থব্যয় করেন তাঁদের ধর্মের মূল কথাগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন “দান বদান্যতা সকল দেশ সকল ধর্ম সকল জাতির মধ্যেই ধর্মমূলক প্রধান কৃত্যরূপে স্বীকৃত হয়েছে। আপনারা একবার আমাদের দেশের শত শত নিরন্ন ও বস্ত্রহীন লোকদের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। দরিদ্রের দারিদ্যমোচন, অন্নহীনকে অন্নদান, অশিক্ষিত জনগণের শিক্ষার ব্যবস্থা আমাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যকর্ম। এই পবিত্র কর্ম হইতে আমরা দূরে সরিয়া আছি। এইগুলির অনুষ্ঠানেই ধর্মসভার মুখ উজ্জ্বল হইবে।”

গঙ্গার মতিলাল ঘাট

দানবীর মতিলাল অনাথ ও বিধবাদের জন্য একটি স্থায়ী ধনভাণ্ডারও গঠন করেছিলেন। স্নানার্থীদের জন্য গঙ্গায় ঘাট নির্মাণ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বর্তমানে এই ঘাট মতিলাল ঘাট নামে পরিচিত।

হিন্দু বিবাহ আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক মতিলাল শীল

বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত হিন্দু বিবাহ আন্দোলনেরও সক্রিয় সমর্থক ছিলেন মতিলাল। বিধবা বিবাহ আইন পাশ হবার বহু আগে থেকেই তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবিষয়ে সচেষ্ট হন। আইন পাস হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তার পনেরো বছর আগেই ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে হরকরা পত্রিকায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যে হিন্দু যুবক কোনও বিধবাকে বিবাহ করবে তাকে দশ হাজার টাকার নগদ পুরস্কার দেওয়া হবে। তৎকালীন প্রাচীনপন্থী হিন্দু সমাজে মতিলালের এই ঘোষণা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরেও আলোড়ন তুলেছিল।

ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মতিলাল শীল

মতিলাল শীল বহু জনহিতকর কাজের জন্য মহাত্মা মতিলাল শীল বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। জীবদ্দশায় বহু ধন তিনি উপার্জন করেছেন এবং জনকল্যাণের কাজে সেই অর্থ অকাতরে ব্যয় করেছেন। জীবনে কখনও অর্থ উপার্জনের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করেন নি। তাঁর এই ধারা তাঁর বংশধরদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।

দানশীল মতিলাল শীলের উত্তরাধিকারী

ব্যবসায়ী মতিলালের পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন হীরালাল শীল। দানশীলতার জন্য তিনিও দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দেশে আকাল বা দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অন্নসত্র খুলে লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষকে ক্ষুধার অন্নদান করেছেন। প্রতিদিন তিন হাজার মানুষ সেখানে খেতে পেত।

মতিলাল শীলের মৃত্যু

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৬৩ বছর বয়সে খ্যাতকীর্তি মতিলাল শীলের মৃত্যু হয়।

উপসংহার :- অক্লান্ত পরিশ্রম বুদ্ধিবল ও বিচক্ষণতার সাহায্যে অতি সাধারণ অবস্থা থেকে সমাজের শীর্ষস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মতিলাল। স্বোপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিত্ত তিনি অকাতরে ব্যয় করেছিলেন দরিদ্র অশিক্ষিত দেশবাসীর কল্যাণে। তথাকথিত বাবুকালচারের যুগে মতিলাল ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আদর্শ পুরুষ।

(FAQ) মতিলাল শীল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১। মতিলাল শীল কে ছিলেন?

মতিলাল শীল একজন বিশিষ্ট বাঙালি সমাজসংস্কারক ও ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি ১৯শ শতকে কলকাতায় সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

২। মতিলাল শীল কোন বিষয়ে অবদান রাখেন?

মতিলাল শীল সমাজ সংস্কার, বিধবা বিবাহ প্রচার, শিক্ষাক্ষেত্রে দান এবং গরিব ও বিধবাদের সাহায্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

৩। মতিলাল শীল কাদের সহযোগী ছিলেন?

তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং তার বিধবা বিবাহ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন।

৪। মতিলাল শীলের প্রধান অবদান কী?

সমাজে শিক্ষার প্রসার এবং বিধবা ও গরিব নারীদের জন্য সহায়তা প্রদান ছিল তাঁর প্রধান অবদান।

৫। মতিলাল শীলের মৃত্যু কবে হয়?

মতিলাল শীল ১৮৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

৬। মতিলাল শীল কেন স্মরণীয়?

দানশীলতা, সমাজ সংস্কারে অবদান এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মতিলাল শীল ইতিহাসে স্মরণীয়।

Leave a Comment