মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা -র সময়কাল, কমিউনিস্ট পার্টির অবদান, বামপন্থার বিকাশ, শ্রমিক আন্দোলন, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার, কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান, সরকারের প্রতিক্রিয়া, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট হিসেবে শ্রমিক অসন্তোষ, হুইটলি কমিশন নিয়োগ, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়ন, ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা, মামলার রায়, গান্ধিজির ভূমিকা, বামপন্থী আদর্শ প্রসারে পরোক্ষ ভূমিকা, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ ও এই মামলার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানবো।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে বিতর্কিত আদালতের মামলা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার সময়কাল, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ভারতীয় ও বিদেশী, ভারতের কমিউনিস্টদের দমনের উদ্দেশ্যে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি ও মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯ খ্রি.)

ঐতিহাসিক ঘটনামিরাট ষড়যন্ত্র মামলা
সময়কাল১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ
অভিযুক্ত ভারতীয়মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পি. সি. যোশি প্রমুখ
অভিযুক্ত বিদেশিফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি, লেস্টার হাচিনসন
ফলাফলকমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ
মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা

ভূমিকা :- ভারত-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন ধারার আন্দোলন যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশেষ ধারা হল কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন।

কমিউনিস্ট পার্টির অবদান

ভারতে বামপন্থী শক্তি তথা কমিউনিস্ট পার্টি বিপুল সংখ্যায় কৃষক ও শ্রমিকদের যুক্ত করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির অবদানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

বামপন্থার বিকাশ

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ভারতে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং তখন থেকেই শ্রমিক অসন্তোষের সূত্র ধরে এ দেশে বামপন্থার বিকাশ শুরু হয়।

শ্রমিক আন্দোলন

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৯১৮ খ্রি. মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন ও ১৯২০ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (AITUC)” ভারতে শ্রমিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা

রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব (১৯১৭ খ্রি.) ভারতের বামপন্থীদের অনুপ্রাণিত করে। এর ফলে প্রথমে ১৯২০ সালে তাসখন্দে এম. এন. রায়, অবনি মুখার্জি প্রমুখের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় এবং ভারতে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিতহয়।

শ্রমিক আন্দোলনে জোয়ার

কমিউনিস্টরা কৃষক ও শ্রমিকদের ভারতের জাতীয় আন্দোলনে শামিল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তারা সাম্যবাদের প্রচার চালিয়ে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং শ্রমিক আন্দোলনে তীব্র জোয়ার আনে।

কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক এই অধিবেশনে যোগ দেয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে তাদের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করে।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার সম্পর্কে সরকারের প্রতিক্রিয়া

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অর্থাৎ বামপন্থার প্রসার এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য সরকার এদেশে বামপন্থার অগ্রগতি ও শ্রমিক আন্দোলনকে স্তদ্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ-

(১) শ্রমিক অসন্তোষ

ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপুরণে জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক্‌স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা প্রভৃতির দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রসার সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়।

(২) হুইটলি কমিশনের নিয়োগ

ক্রমাগত শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হুইটলি কমিশন’ (Whitley Commission) নিয়োগ করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে।

(৩) শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়ন

বড়োলাট লর্ড আরউইন তাঁর জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে ‘শিল্পবিরোধ বিল’ ও ‘জননিরাপত্তা বিল’ নামে শ্রমিক স্বার্থ-বিরোধী দুটি আইন পাসের উদ্যোগ নেন। শিল্পবিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক মালিক বিরোধ মীমাংসার কথা বলা হয়। জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

(৪) ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার

কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ ও তাদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৩ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা

কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের এই মামলা ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। অভিযুক্ত ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। এঁরা হলেন ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি এবং লেস্টার হাচিনসন।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন জওহরলাল নেহরু, এম. সিচাগলা প্রমুখ।

(১) মামলার রায়

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার দীর্ঘমেয়াদের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। যেসব কমিউনিস্ট নেতার দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড হয়েছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কে. এন. জোগেলকর, পি. সি. যোশি, এস. এ. ডাঙ্গে, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ।

(২) গান্ধীজীর ভূমিকা

কংগ্রেস নেতা গান্ধীজী মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।

(৩) বামপন্থী আদর্শের প্রসারে পরোক্ষসহায়তা

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে বামপন্থার প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছোলে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।

(৪) কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ

শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে (২৩ জুলাই) কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিক্রিয়া

এই মামলা হ্যারল্ড ল্যাস্কি, আইনস্টাইন, এইচ. জি. ওয়েলস প্রমুখ মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেশ-বিদেশে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সমালােচনার ঝড় ওঠে। পণ্ডিত নেহরু একে ‘জুডিসিয়াল স্ক্যানডেল’ বলে সমালােচনা করেন।

উপসংহার :- মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতীয় কমিউনিস্টদের সাময়িক দমিত করলেও তাদের অঙ্কুরে বিনাশ করতে পারেনি। কমিউনিস্টরা অচিরেই কংগ্রেস সমাজতন্ত্রীদলের মধ্যে থেকে শ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে পূর্ণ উদ্যমে ঝাপিয়ে পড়েন।

(FAQ) মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা কবে শুরু হয়?

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে।

২. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বিদেশিদের নাম লেখ।

ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি, লেস্টার হাচিনসন।

৩. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড হয় কাদের?

মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কে. এন. জোগেলকর, পি. সি. যোশি, এস. এ. ডাঙ্গে, ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ।

Leave a Comment