মেকলে মিনিট

মেকলে মিনিট বা মেকলের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি হিসেবে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের নিযুক্তি, মেকলে মিনিটের পটভূমি, শিক্ষাদান বিষয়ে দুই দল তৈরি, প্রাচ্যবাদী, প্রাশ্চাত্যবাদী, লর্ড মেকলের প্রস্তাব, মেকলের বক্তব্য, মেকলে মিনিটের বক্তব্য ও সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানবো।

মেকলে মিনিট

ঐতিহাসিক ঘটনামেকলে মিনিট
প্রবর্তকটমাস ব্যারিংটন মেকলে
প্রবর্তন কাল২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ
গভর্নর জেনারেললর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক
মেকলে মিনিট

ভূমিকা:- উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫ খ্রিঃ) সরকারি শিক্ষানীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এই সময় টমাস ব্যাবিংটন মেকলে নামে এক খ্যাতনামা পণ্ডিত তাঁর আইন সচিব হয়ে ভারত -এ আসেন এবং তিনি ‘কমিটি অব পাবলিক ইনষ্ট্রাকশনের সভাপতি, নিযুক্ত হন।

মেকলের মিনিটের পটভূমি

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন -এ ভারতীয় শিক্ষা খাতে ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়। এই টাকা ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে প্রাচ্য শিক্ষা না আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পূর্বে বিতর্ক দেখা দেয়, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিতর্ক নামে পরিচিত।

শিক্ষাদান বিষয়ে দুই দল

এই সময় কমিটি প্রাচ্য রীতি ও প্রতীচ্য রীতিতে শিক্ষাদান সম্পর্কে দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক দলকে বলা হত প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট (Orientalist) এবং অপর দলটি ছিল পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট (Anglicist)।

(১) প্রাচ্যবাদী

প্রাচ্য বিদ্যার সমর্থকদের বলা হত প্রাচ্যবাদী।এদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক ও উইলসন। তাঁরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে শিক্ষাদানে আগ্রহী ছিলেন।

(২) পাশ্চাত্যবাদী

পাশ্চাত্য বিদ্যার সমর্থকদের পাশ্চাত্যবাদী বলা হয়।পাশ্চাত্যবাদের উগ্ৰ সমর্থক ছিলেন মেকলে। তার সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ। 

বিতর্কের অবসান

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই বিরোধের নিষ্পত্তি জন্য ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয় যার পরবর্তী সময়ে সভাপতি হন টমাস বাবিংটন মেকলে। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সমর্থন জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক এর কাছে একটি প্রস্তাব দেন।

লর্ড মেকলের প্রস্তাব

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাব (Minutes) বড়লাটের কাছে পেশ করেন। এই প্রস্তাব মেকলে মিনিট নামে।

মেকলের বক্তব্য

  • (১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে ‘দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা’ বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
  • (২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোনও বৈজ্ঞানিক চেতনা নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (Oriental learning was completely inferior to European learning”)।
  • (৩) তাঁর মতে, “ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা-প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।
  • (৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ‘ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
  • (৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা “রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ। তারাই পরে জনগণের মধ্যে নতুন জ্ঞান প্রচার করবে এবং ইংরেজি শিক্ষার ফলে ভারতে নবজাগরণ আসবে।”

মেকলের মিনিটের বক্তব্য

মেকলে তাঁর ‘মিনিট’ বা প্রস্তাবে বলেন যে,

  • (১) প্রাচ্যের শিক্ষা বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় সম্পূর্ণ নিকৃষ্ট।
  • (২) প্রাচ্যের সভ্যতা দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপবিত্র। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত।
  • (৩) এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটলে ‘ক্রমনিম্ন পরিস্রুত নীতি’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুসারে তা ক্রমশ সাধারণ দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
  • (৪) পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে যারা রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ’।

মেকলে মিনিট সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত

ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রেক্ষাপটে ‘মেকলে মিনিট’ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। শেষপর্যন্ত মেকলে মিনিটের সুপারিশ মেনেই বড়োলাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

উপসংহার:- টমাস মেকলে ছিলেন উগ্ৰ পাশ্চাত্যবাদী। জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সুপারিশ করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক তাঁর সুপারিশকেই কার্যত সিলমোহর দিলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের বাধা দূর হয়।

(FAQ) মেকলে মিনিট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. লর্ড মেকলে কে ছিলেন?

গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব ও কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি।

২. মেকলে মিনিট কে কবে ঘোষণা করেন?

লর্ড মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি।

৩. মেকলে মিনিট ঘোষণার সময় গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।

Leave a Comment