মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে বাহাদুর শাহের নেতৃত্ব ও নির্বাসন, মহাবিদ্রোহে নানা সাহেবের নেতৃত্ব, মহাবিদ্রোহে তাঁতিয়া তোপির নেতৃত্ব, মহাবিদ্রোহে বেগম হজরত মহলের নেতৃত্ব, মহাবিদ্রোহে কুনওয়ার সিং-এর নেতৃত্ব, মহাবিদ্রোহে রাণী লক্ষ্মীবাই-এর নেতৃত্ব ও মৌলবি আহম্মদুল্লার নেতৃত্ব প্রদান সম্পর্কে জানবো।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রসঙ্গে মহাবিদ্রোহে দুর্বল নেতৃত্ব, মহাবিদ্রোহের প্রধান নেতা, মহাবিদ্রোহের সময় মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, মহাবিদ্রোহে কানপুরের নেতা নানাসাহেব ও তাতিয়া টোপি, মহাবিদ্রোহে অযোধ্যার নেতা বেগম হজরৎ মহল, মহাবিদ্রোহে ঝাঁসির নেতৃত্ব রাণী লক্ষ্মীবাঈ, মহাবিদ্রোহে বিহারের নেতা কুনওয়ার সিং, তাতিয়া টোপির প্রকৃত নাম, মহাবিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণকারি হিউ রোজ।

মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব

বিষয়মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব
দিল্লির মহাবিদ্রোহের নেতাদ্বিতীয় বাহাদুর শাহ
কানপুরে মহাবিদ্রোহের নেতানানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপি
অযোধ্যায় মহাবিদ্রোহের নেতাবেগম হজরত মহল
ঝাঁসীতে মহাবিদ্রোহের নেতারাণী লক্ষ্মীবাই
বিহারে মহাবিদ্রোহের নেতাকুনওয়ার সিং
মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব

ভূমিকা :- মহাবিদ্রোহের বিদ্রোহী সিপাহিরা দিল্লির গদিচ্যুত বাদশা আশি বছরের বৃদ্ধ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-কে মহাবিদ্রোহের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মোগল রাজবংশের উত্তরাধিকারী এবং অখণ্ড হিন্দুস্থানের প্রতীক হিসেবে তাঁর নামেই এই বিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল।

বাহাদুর শাহের নেতৃত্ব

নানা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভীতি, সম্রাট বাহাদুর শাহ পদের প্রলোভন এবং সিপাহিদের চাপে দোদুল্যচিত্তে তিনি এই মহাবিদ্রোহে যোগ দেন। তিনি ছিলেন এই মহাবিদ্রোহের নামসর্বস্ব নেতা মাত্র, বস্তুত তাঁর হাতে কোনও ক্ষমতাই ছিল না এবং নেতৃত্ব দেওয়ার কোনও শক্তিও তাঁর ছিল না।

দরবার গঠন

দশজন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি ‘দরবার’-এর হাতে এই দায়িত্ব অর্পিত হয় এবং এর প্রধান ছিলেন বেরিলি-র ব্রিটিশ গোলন্দাজ বাহিনীর একজন সাধারণ সুবেদার বখত খান।

দুর্বল নেতৃত্ব

ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, যে নেতৃবৃন্দের দ্বারা মহাবিদ্রোহ পরিচালিত হয়েছিল তার মধ্যে সম্ভবত বাহাদুর শাহ-ই ছিলেন সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি। বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে তাঁর মতো জরাগ্রস্ত, দুর্বল ও দোদুল্যচিত্ত ব্যক্তির উপস্থিতি মহাবিদ্রোহকে দুর্বল করে তোলে।

বাহাদুর শাহকে গ্রেপ্তার

ব্রিটিশ সেনা দিল্লি পুনরুদ্ধারের পর হুমায়ুন -এর সমাধিস্থান থেকে বাহাদুর শাহ ও তাঁর পরিবারবর্গকে গ্রেপ্তার করে। ব্রিটিশ অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট হডসন অকারণে বাদশাহের দুই পুত্র ও পৌত্রদের গুলি করে হত্যা করেন।

বাহাদুর শাহের নির্বাসন

বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে বার্মার মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ৮৭ বছর বয়সে তিনি সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নানাসাহেব

  • (১) কানপুরে মহাবিদ্রোহের নেতা ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দত্তকপুর গোবিন্দ ধন্দ পন্থ। তিনি নানাসাহেব’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
  • (২) বিদ্রোহী সিপাহিদের সাহায্যে তিনি কানপুর থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে নিজেকে ‘পেশোয়া’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে বাদশার ‘সুবাদার হিসেবে অভিহিত করেন।
  • (৩) তাঁর দুই বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন তাঁতিয়া তোপি ও হাতিম আজিমুন্না। নানাসাহেবের পক্ষে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত ছিল তাঁতিয়া তোপির ওপর।
  • (৪) ইংরেজরা কানপুর দখল করলে নানাসাহেব অযোধ্যার বেগমের হয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করেন। মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতায় তিনি হতাশ হন নি। নতুন করে সংগ্রাম শুরুর আশায় তিনি নেপাল -এ যান। সম্ভবত সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
  • (৫) ইংরেজরা তাঁকে এত ভয় করত যে বিদ্রোহ দমিত হওয়ার বহুদিন পরেও তারা নানাসাহেবের খোঁজে সারা হিন্দুস্থান তোলপাড় করেছিল।

তাঁতিয়া তোপি

  • (১) নানা সাহেবের অতি বিশ্বস্ত অনুচর এবং গেরিলা যুদ্ধের সফল নায়ক তাঁতিয়া তোপি-র প্রকৃত নাম হল রামচন্দ্র পাণ্ডুরঙ্গ তোপি।
  • (২) ইংরেজদের হাতে কানপুরের পতনের পর তিনি ঝাঁসির রানির সাহায্যে অবতীর্ণ হন এবং মধ্যভারতের এক বিরাট অংশে তাঁর কার্যধারা পরিচালনা করেন।
  • (৩) পরবর্তীতে একের পর এক পরাজয় আসতে থাকে। হতাশ তাঁতিয়া তোপি অরণ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে এক বিশ্বাসঘাতক তাঁকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়। বিচারের নামে প্রহসন করে ইংরেজরা তাঁকে ফাঁসি দেয়। তিনি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেন।

বেগম হজরত মহল

  • (১) লর্ড ডালহৌসি অযোধ্যা দখলের পর অযোধ্যার নবাবকে কলকাতায় নির্বাসিত করেন। এই অবস্থায় বিদ্রোহ শুরু হলে বেগম হজরৎ মহল তাঁর নাবালক পুত্র বিরজিস কাদির-কে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে বিদ্রোহ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
  • (২) লক্ষ্ণৌ বিদ্রোহের মূল নায়িকা ছিলেন বেগম হজরত মহল। লক্ষ্ণৌয়ের সিপাহি এবং অযোধ্যার জমিদার ও কৃষকদের সাহায্যে তিনি এক সর্বাত্মক বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে তোলেন।
  • (৩) নিরুপায় ইংরেজরা ‘রেসিডেন্সি’-তে আশ্রয় গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের ‘রেসিডেন্সি অবরোধ ব্যর্থ হয়। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল লক্ষ্ণৌ পুনর্দখল করেন। বেগম সাহেবা নেপালে আশ্রয় নেন।

রাণী লক্ষ্মীবাই

  • (১) ঝাঁসিতে বিদ্রোহ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বহন করেন মহাবিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেত্রী ঝাঁসির তরুণী বিধবা রাণী লক্ষ্মীবাঈ।
  • (২) ভারত ইতিহাসের অন্যতমা শ্রেষ্ঠ বীর রমণী হিসেবে রাণী লক্ষ্মীবাঈ স্মরণীয়া হয়ে আছেন। তাঁর শৌর্য, বীর্য, সাহসিকতা ও রণনৈপুণ্য ভারতবাসীকে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দেবে।
  • (৩)ইংরেজ সেনাপতি হিউ রোজ তাঁকে বিদ্রোহীদের মধ্যে সর্বোত্তমা ও সর্বাপেক্ষা সাহসিনী’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, তিনি ছিলেন বিদ্রোহীদের মধ্যে একমাত্র পুরুষ’ (‘the only man among the rebels’)।
  • (৪) হিউ রোজের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাদল ঝাঁসি আক্রমণ করলে তিনি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।এমনকী ঝাঁসির মহিলারাও সেদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
  • (৫) ইংরেজ সেনা ঝাঁসি দখল করলে পরাজিত লক্ষ্মীবাঈ তাঁতিয়া তোপির সঙ্গে মিলিত হয়ে ইংরেজের মিত্র সিন্ধিয়ার রাজ্য গোয়ালিয়র দখল করেন।
  • (৬) সিন্ধিয়া আগ্রায় পলায়ন করে ইংরেজদের আশ্রয়গ্রহণে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত রাণীর উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এবং ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন কাল্পির যুদ্ধে তিনি বীরোচিত মৃত্যুবরণ করেন।

কুনওয়ার সিং

  • (১) বিহারে বিদ্রোহের মুখ্য সংগঠক ছিলেন রাজপুত বীর কুনওয়ার সিং। তিনি ছিলেনআরার নিকটবর্তী জগদীশপুরের ভূতপূর্ব জমিদার।
  • (২) বিদ্রোহের কালে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েও যুবার মতো সাহস ও বীরত্ব সহকারে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি ছিলেন অসাধারণ সমর-নিপুণ ও কুশলী সংগঠক।
  • (৩) তিনি অযোধ্যা ও মধ্যভারতেও বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। আরার কাছে এক যুদ্ধে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল নিজ গৃহে পরলোকগমন করেন।

মৌলবি আহম্মদুল্লা

  • (১) ‘ফৈজাবাদের মৌলবি’ নামে পরিচিত হলেও মৌলবি আহম্মদুল্লা ছিলেন মাদ্রাজের অধিবাসী এবং সেখানেই তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে প্রচার চালাতেন।
  • (২) মৌলবি আহম্মদুল্লা উত্তর ভারতের ফৈজাবাদেও তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী প্রচার শুরু করেন। মহাবিদ্রোহ শুরু হলে তিনি অযোধ্যার অন্যতম অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন।
  • (৩) তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য কোম্পানি ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ইংরেজের অনুগ্রহভাজন জনৈক রাজার হাতে তিনি নিহত হন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরাও মৌলবির দেশপ্রেম, শৌর্য, বীর্য ও রণকৌশলের প্রশংসা করেছেন।

উপসংহার :- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ভারতের আধুনিক ইতিহাস -এ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিদ্রোহী সিপাহিদের সাহসিকতা এবং আত্মবিসর্জন ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবজনক দিক।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিদ্রোহী সিপাহিরা কাকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেন?

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে।

২. বিহারে মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে?

কুনওয়ার সিং।

৩. মহাবিদ্রোহের সময় ঝাঁসির রাণী কে ছিলেন?

রাণী লক্ষ্মীবাই।

৪. অযোধ্যায় মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে?

বেগম হজরত মহল।

৫. ফৈজাবাদে মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন কে?

মৌলবি আহম্মদুল্লা।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment