কণিষ্ক

আজ কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক -এর সিংহাসনে আরোহণ, সাম্রাজ্য বিস্তার, সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চল, রাজধানী, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার, গ্রিক-ইরাণীয়-ভারতীয়-অন্যান্য মুদ্রা সম্পর্কে জানবো।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক প্রসঙ্গে কণিষ্কের সিংহাসনে আরোহণকাল, কণিষ্কের সাম্রাজ্য বিস্তার, কণিষ্কের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল, কণিষ্কের রাজধানী, কণিষ্কের দেবপুত্র উপাধি গ্ৰহণ, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে কণিষ্কের ভূমিকা, কণিষ্কের আমলে চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন, রবাতক শিলালিপিতে কণিষ্কের উল্লেখ, কণিষ্কের মুদ্রা, কণিষ্কের গ্ৰিক মুদ্রা, কণিষ্কের ইরানীয় মুদ্রা, কণিষ্কের ভারতীয় মুদ্রা, কণিষ্ক সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের বিবরণ, জনকল্যাণে কণিষ্কের ভূমিকা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক কণিষ্ক, কণিষ্কের আমলে নতুন শিল্পরীতি, কণিষ্কের আমলে গান্ধার শিল্প ও মথুরায় প্রাপ্ত কণিষ্কের মাথা কাটা মূর্তি।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক

ঐতিহাসিক চরিত্রকণিষ্ক
পূর্বসূরিকুজুল কদফিসেস
উত্তরসূরিহুবিস্ক
পিতাবিম কদফিসেস
ধর্মবৌদ্ধ ধর্ম
কুষাণ সম্রাট

ভূমিকা :- সর্বশ্রেষ্ঠ কুষাণ সম্রাট ছিলেন কণিষ্ক, যিনি তার সামরিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সিংহাসনে আরোহণ

কণিষ্কের সিংহাসন আরোহণের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। বেশিরভাগ পণ্ডিতই মনে করেন ৭৮ খ্রিস্টাব্দে “শকাব্দ” নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক। সেদিক থেকে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সাম্রাজ্যের বিস্তার

কণিষ্কের রাজত্ব তারিম দ্রোণীর তুরফান অঞ্চল থেকে গাঙ্গেয় সমতলভূমির পাটলিপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চল

গান্ধার এবং কাশ্মীর থেকে বারাণসী পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের রাজধানী

পুরুষপুর, কপিশা ও মথুরা ছিল কণিষ্কের রাজ্যের রাজধানী।

কণিষ্কের দেবপুত্র উপাধি গ্রহণ

সম্রাট অশোক -এর ‘দেবানামপিয়’ অ্যাখ্যা নিয়ে পালি সাহিত্যে যেমন নানা কাহিনী প্রচলিত আছে, সেরকম সম্রাট কণিষ্কেরও ‘দেবপুত্র’ উপাধি নিয়ে অনেক কথা ও কাহিনী তৈরি হয়।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার

বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম গান্ধার থেকে চীন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

কণিষ্কের আমলে চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন

বৌদ্ধধর্মের দুই সম্প্রদায় মহাযান ও হীনযানদের মধ্যে মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে সম্রাট কণিষ্ক একটি বৌদ্ধ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এটিই ছিল চতুর্থ তথা শেষ বৌদ্ধ সম্মেলন।

রবাতক শিলালিপিতে কণিষ্কের উল্লেখ

১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তান -এর রবাতক নামক স্থান থেকে আবিষ্কৃত ব্যাক্ট্রিয় ভাষায় গ্রিক লিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপি কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়।

  • (১) এই লিপির শুরুতেই লেখা আছে যে, নানা প্রভৃতি দেবতার ইচ্ছেয় কণিষ্ক একটি নতুন কালপঞ্জীর সূচনা করেন। কণিষ্ক গ্রিক ভাষা পরিত্যাগ করে ব্যাক্ট্রিয় ভাষারও প্রবর্তন করেন।
  • (২) এই লিপি অনুসারে, উজ্জয়িনী, সাকেত, কৌশাম্বী, পাটলিপুত্র ও শ্রী চম্পা নগরী পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
  • (৩) এই লিপির শেষে কণিষ্কের পিতৃপুরুষদের নাম পাওয়া যায়। এই লিপি থেকেই জানা যায় যে, কণিষ্কের প্রপিতামহ ছিলেন কুজুল কদফিসেস, পিতামহ ছিলেন ভীম তক্তো এবং পিতা ছিলেন বিম কদফিসেস।

কণিষ্কের মুদ্রা

  • (১) সম্রাট কণিষ্কের মুদ্রায় ভারতীয়, গ্রিক, ইরানীয়, সুমের ও ইলেম সংস্কৃতির পৌরাণিক চরিত্রগুলি স্থান পেয়েছে, যা কণিষ্কের সর্ব ধর্ম সহিষ্ণুতার প্রমাণ দেয়।
  • (২) কণিষ্কের রাজত্বের প্রথম দিকের মুদ্রায় গ্রিক পৌরাণিক চরিত্রের চিত্র সহ গ্রিক হরফ উৎকীর্ণ হয়েছে। এরপর তার মুদ্রাগুলিতে গ্রিক সংস্কৃতির বদলে ইরানীয় পৌরাণিক চরিত্র ও গ্রিক লিপির বদলে ব্যাক্ট্রিয় ভাষা স্থান পায়।
  • (৩) কণিষ্কের সকল মুদ্রায় তার শ্মশ্রুযুক্ত প্রতিকৃতি দেখা যায়। এই সকল চিত্রে তার পরণে লম্বা কোট ও বড় গোল জুতো, কোমরে লম্বা তরোয়াল এবং কাঁধ থেকে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের গ্রিক মুদ্রা

কণিষ্কের গ্রিক মুদ্রাগুলির এক পিঠে তার প্রতিকৃতি সহ গ্রিক লিপিতে বাসিলেউস বাসিলেওন কানিষ্কোউ কথাটি উৎকীর্ণ রয়েছে। মুদ্রাগুলির অপর পিঠে হেলিয়স, সেলেনে, আনেমোই ও হেফাইস্তোস প্রভৃতি গ্রিক পৌরাণিক দেবদেবীর চিত্র ও নাম উৎকীর্ণ রয়েছে।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের ইরানীয় মুদ্রা

কণিষ্কের পরবর্তী মুদ্রাগুলিতে গ্রিক দেব-দেবীর বদলে ইরানীয় দেব-দেবী স্থান পেয়েছে। তার মুদ্রায় যে সকল ইরানীয় পৌরাণিক চরিত্র স্থান পেয়েছে, তারা হলেন, অশি ভঙ্ঘুহি, অতর, মাহ, মিথ্র, মাজদা, বাতা-বায়ু প্রভৃতি।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের ভারতীয় মুদ্রা

কণিষ্কের আবিষ্কৃত মুদ্রাগুলির মধ্যে বৌদ্ধ মুদ্রাগুলির সংখ্যা অত্যন্ত দুর্লভ। এই সকল মুদ্রাগুলির এক পিঠে কণিষ্কের চিত্র ও অপর পিঠে গৌতম বুদ্ধ বা মৈত্রেয় বুদ্ধের চিত্র স্থান পেয়েছে।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের অন্যান্য মুদ্রা

কণিষ্কের অন্য সকল মুদ্রায় দেব-দেবীর প্রতিকৃতি পাশ থেকে খোদাই করা হলেও গৌতম বুদ্ধ বা মৈত্রেয় বুদ্ধের প্রতিকৃতি সামনে থেকে মুদ্রিত করা হয়েছে।

কনিষ্ক সম্পর্কে হিউয়েন সাঙের বিবরণ

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ -এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে কণিষ্ক এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। শুধু ভারতেই নয় ভারতের বাইরে চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি কাশগড়, খোটান, ইয়ারখন্দ অধিকার করেন।

জনকল্যাণে কণিষ্কের ভূমিকা

তক্ষশীলা দলিল থেকে জানা যায় যে, জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ কণিষ্ককে ‘দেবপুত্র’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি ব্যবসা বাণিজ্য ও কৃষির সম্প্রসারণেও উদ্যোগী ছিলেন।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক কণিষ্ক

বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ, বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধসাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীরা কণিষ্কের রাজত্ব কালেই ছিলেন।

কণিষ্কের আমলে নতুন শিল্পরীতি

সম্রাট কণিষ্কের সময়েই সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি ভিন্ন শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর সময়ে লাল বেলে পাথরে বুদ্ধ মূর্তি ছাড়াও মহাবীর -এর মূর্তিও গড়া হত।

কণিষ্কের রাজত্বকালে গান্ধার শিল্প

সম্রাট কণিষ্কের রাজত্ব কালে বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণে বিখ্যাত গান্ধার শিল্প রীতি গড়ে উঠেছিল।

কণিষ্কের মস্তকহীন মূর্তি

সম্রাট কনিষ্কের একটি মাত্র মূর্তি মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। সেটি কালের প্রবালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুণ্ডহীন ছিল। ফলে ইতিহাসের বইয়ে তাঁর যে ছবি পাওয়া যায়, তা হল সেই মুণ্ডহীন শরীরের প্রতিকৃতি।

সাহিত্যে কণিষ্ক

মস্তকহীন মূর্তির জন্য বাংলা ভাষায় সম্রাট কনিষ্ককে কবন্ধ অর্থে প্রায়শই ব্যবহার করা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কাকাবাবু সিরিজের ‘ভয়ংকর সুন্দর‘ উপন্যাসে কনিষ্কের মাথা কাটা যাওয়ার রোমাঞ্চকর কল্পকাহিনী লিখেছেন।

(FAQ) কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কণিষ্কের রাজধানী কোথায় ছিল?

পুরুষপুর বর্তমানে পেশোয়ার।

২. কণিষ্কের মূর্তি কোথায় পাওয়া গেছে?

মথুরাতে কণিষ্কের একটি যোদ্ধাবেশী মস্তকহীন মূর্তি পাওয়া যায়।

৩. কনিষ্ক কবে সিংহাসনে বসেন?

৭৮ খ্রিষ্টাব্দ।

Leave a Comment